ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

বাসন্তি শাড়ি খোপায় গাঁদা ফুলের দিন....

ঊর্মি মাহবুব, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৬
বাসন্তি শাড়ি খোপায় গাঁদা ফুলের দিন.... ছবি: রাজিব / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: বাসন্তি শাড়ি, খোপায় গাঁদা ফুল। আর কপালে লাল টিপ।

বাঙালীর নারীর পূর্ণ রূপ যেন ফুটে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শাহবাগ, বাংলা একাডেমি এলাকা জুড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুল তলায় ভিড়টা একটু বেশি। সেখানেই বসন্তবরণের মূল আয়োজন।
 
আজি এ বসন্তে... গান দিয়েই বসন্তবরণ শুরু হয়। এরপর ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় লেগেছে যে প্রাণসহ অনেক গানের ভেলায় বসন্ত যেন ভাসতে থাকে হাসিমুখে।
 
তরুণ প্রাণের এক অপূর্ব মিলনমেলায় পরিণত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা চত্ত্বর। বয়সে প্রবীণরাও সাজসজ্জা ও প্রাণের দিকে থেকে কিছুক্ষণের জন্য হয়ে উঠেছিলেন তরুণ।

কেউবা এসেছেন মায়ের সাথে কেউবা আবার মেয়ের সাথে। এমনই একজন আছমা ইসলাম (৫০)। পেশায় শিক্ষিকা। বাংলানিউজকে তিনি বললেন, আমাদের সময় এতোটা ঘটা করে বসন্ত উৎসব হতো না। কিন্তু এখন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বসন্তকে বরণ করা হয়। আমার মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মেয়ের সঙ্গেই এখানে এসেছি।
 
নিজের ছোট্ট শিশুটিকে কোলে নিয়েই মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন নওরিন জাহান। মেয়ে সেতুর বয়স মাত্র তিন বছর। পড়েছে বাসন্তি রঙের জামা। মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে মেয়েরও বাদ যায়নি মাথার ফুল।
 
বসন্ত বরণের অনুষ্ঠানে দেখা মেলে ভিনদেশিদেরও। তারাও এসেছেন বাঙালীয়ানা সাজে।
 
গানের পাশাপাশি চলছে নৃত্য অনুষ্ঠানও। নুপুরের ঝংকার জানান দিয়ে যাচ্ছে বসন্তের আগমনের কথা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির শিশুরা পরিবেশন করে একাধিক নৃত্য। তাদের উপস্থাপনা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেন দর্শকরা।
 
গান নাচের পাশাপাশি আয়োজন করা হয় আবৃত্তির। দেশের প্রোথিতযশা আবৃত্তি শিল্পী গোলাম সারোয়ারের আবৃত্তিতে মুগ্ধ সবাই। অনেকেই নিয়ে আসেন প্রেমের কবিতা।

অনুষ্ঠানে নব দম্পতিদেরও দেখা যায়। স্ত্রীরা বাসন্তি আর লাল রঙের শাড়ির সাথে মিলিয়ে স্বামীরা পড়ে এসেছেন লাল পাঞ্জাবী।
 
বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভিড় বাড়তে থাকে।

মেয়েদের সাজ যেনো শেষ হতেই চায় না। তবে তা নিয়ে চিন্তাও নেই। বসন্ত বরনের অনুষ্ঠানে এসে হাতের কাছেই মিলে যাচ্ছে ফুল। তাতে বেড়েছে ফুলের খুচরা বিক্রি। কেউবা বিক্রি করছেন ফুলের তৈরি মাথার ব্যান্ড, কেউবা বিক্রি করছেন হাত আর গলার মালা। দাম নিয়ে মাথাব্যথা নেই ক্রেতা বিক্রেতা কারোরই।
 
বিক্রেতারা চেষ্টা করছেন দুটি পয়সা আয় করতে। ক্রেতারও বসন্তের শুভক্ষণে এসে কার্পন্যের ধার ধারছেন না। ফুলের তৈরি মাথার ব্যান্ড বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা করে। কোনো কোনো বিক্রেতা আবার তার দাম হাকাচ্ছেন ১০০ টাকা। হাতের মালার দাম নেয়া হচ্ছে ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকার মধ্যে। অনেক বিক্রেতা আবার বিক্রি করছেন খুচরো ফুল। কেউবা বিক্রি করছেন গোলাপ, কেউবা আবার আবার বেলী। এসব ফুলের দাম পড়ছে ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা।
 
তবে এবারের বসন্ত বরণ অনুষ্ঠানে দেখা মেলে ছবি তোলার অন্যরকমের এক কারিগরের। সাধারণত কক্সবাজার, পতেঙ্গা এলাকায় ভাড়াটে ফটোগ্রাফারদের দেখা মেলে। যারা পর্যটকদের ছবি তুলে আয়ের উৎস খুঁজে নেন। কিন্তু এবারের বসন্ত বরণের অনুষ্ঠানে চারুকলা অনুষদের আঙিনায় দেখা মেলে এমনই সব ফটোগ্রাফারদের। বন্ধু বা পরিবারের সবার ছবি তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন অনুষ্ঠানে আগতদের কাছে। কিন্তু এতে খুব একটা আগ্রহী নন বসন্ত বরণকারীরা।

নিজেরাই নিজেদের ছবি তুলতে বেশি আগ্রহী তারা। কখনোবা ঝড়া পাতার সাথে কেউবার আবার গাছের সাথে কেউবার আবার ধুলোতে বসেই তুলে নিচ্ছে নিজের পছন্দনীয় ছবি। অনেকেই আবার চারুকলা অনুষদের তৈরি নানা ভাষকর্য্যরে পাশে তুলছেন ছবি। স্মৃতির পাতায় ভালো সময়গুলো ধরে রাখার চেষ্টা। সেলফি তুলতে ব্যস্ত অনেককেই নজরে আসে এই অনুষ্ঠানে।
 
সকাল যখন ১০ টা ছুঁই ছুঁই তখন মঞ্চ থেকে ঘোষণা আসে যে, বাসন্তি র‌্যালি হবে। সবাইকে র‌্যালীতে অংশ নেয়ার আহ্বান। সবাই যেন একটু নড়েচড়েই র‌্যালীতে অংশ নেয়ার চেষ্টা করলেন। ১০ টায় র‌্যালী শুরু হলো চারুকলা অনুষদ থেকে। শত শত মানুষ। সবার পোশাকই বাসন্তি রঙের ছোঁয়া। মাথায় ফুল। হাতে ফুল। গলায় ফুল। বাসন্তি র‌্যালীটি টিএসসি চত্ত্বর ঘুরে আবার আসে চারুকলা অনুষদেই। সকালের অনুষ্ঠানের এখানেই ইতি। কিন্তু পুরো দিনের অন্ষ্ঠুানে ইতি নয়। বিকালেও রয়েছে অনুষ্ঠান। এতো তাড়াতাড়ি বসন্ত বরণ কি শেষ হয়! বিকালের অনুষ্ঠানেও রয়েছে গান, নাচ, কবিতা, আবৃত্তি।
 
মাঝখানে দল বেধে সবাই ঘুরতে বেড়িয়ে পড়ে সোহরোওয়ার্দি উদ্যান, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। বইমেলাই যার গন্তব্য। এছাড়াও টিএসসি, শহীদ মিনার এলাকায় ভীড় বাড়তে থাকে।
 
ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রয়েছে। তবে যারা আগেই পাশ করে গেছে তাদেরও গন্তব্য পুরোনো ক্যাম্পাস।  
 
নাহিদ, সানি, ফাহিম, রনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। দুই বছর আগে এমবিএ শেষে করে চাকরি করছেন প্রত্যেকেই। কিন্তু একসাথে আর আড্ডা দেয়া হয় না সময়ের অভাবে। পহেলা ফাল্গুন যেন সেই সুযোগ এনে দিয়েছে এই ছেলে-মেয়েদের।

ফাহিম বলেন, চাকরি করলে যা হয় আরকি! ছুটির দিনগুলোতে বাসায় সময় দিতে হয়। কিন্তু আজ পহেলা ফাল্গুন হওয়ায় আমরা সবাই পরিবার পরিজন নিয়ে এসেছি। সকালে চারুকলার অনুষ্ঠানে ছিলাম। বিকালের অনুষ্ঠানেও থাকব। তাই এখন ঘুরতে বেড়িয়েছি। নিজের ক্যাম্পাস বলে কথা! বলেই হেসে উঠলেন ফাহিম।
 
এসব কারণে বিক্রি বেড়েছে চায়ের দোকানগুলোরও। টিএসসির স্থানীয় চা বিক্রেতা আনিস জানালেন সকাল থেকে চা বানিয়ে ফুরসত মিলছে না তার।
 
বলেন, আজ ভোর থেকে বিক্রি শুরু হইছে। প্রতি বছরই এই দিনে এমনই হয়। অনেক মানুষ আসে। আই শনিবার হওয়ায় অন্যবারের তুলনায় লোক আরো বাড়ছে। লোক যতো বাড়ে আমার মনও ততো ভালো হয়। কারন বেচা বিক্রি ভালো হয়।
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্ত্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সাবেক ছাত্রদের উপস্থিতিতে মুখরিত হয়ে থাকে গোটা এলাকা।
 
তবে পহেলা ফাল্গুনকে কেন্দ্র করে শাহবাগ থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত রিকসা ভাড়া দ্বিগুন হয়েছে বলে জানালেন নীলা।
 
তিনি বলেন, শাহবাগ থেকে টিএসসি পর্যন্ত ভাড়া সাধারনত ১০ টাকা। কিন্তু আজ রিকসা চালকরা যেন জোট বেঁধেছেন। ২০ টাকার নিচে কেউ যাবেন না। ছোট বাচ্চা নিয়ে এসেছি। হেঁটে যাই কি করে!

অন্যদিকে শাহবাগ এলাকা থেকে নীলক্ষেপ পর্যন্ত রিকসায় যেতে ভাড়া গুনতে হবে ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকা। এসব বিষয়ে রিকসা চালকদের কট্টর যুক্তিও রয়েছে বটে।
 
রিকসা চালক জামাল বললেন, ভাই রাস্তায় জ্যাম। আর প্রতিদিনতো আমরা কামাই করতে পারি না। আজ একদিনতো যদি একটু ভাড়া বেশি নেই তাইলে কি কিছু বলা উচিত।

জামাল বলেন, আমাদেরও উৎসব করতে মন চায়। পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে যাইতে মন চায়। আর আমাদের এই আয় ছাড়াতো কোনো আয় নেই। তাই আজ একটু ভাড়া বেশি, এই আরকি।
 
পহেলা ফাল্গুনকে কেন্দ্র করে শাহবাগ থেকে টিএসসি পর্যন্ত যাওয়ার ফুটপাতে খুচরা ব্যবসায়ের পসরা বসেছে।
 
রয়েছে ফুলের দোকান, বইয়ের দোকান, ঝালমুড়ি, খাদ্যসামগ্রী, শীতবস্ত্র, চুরি, বেলুনের দোকান। শিশুদের মূল আকর্ষণের স্থানে রয়েছে বেলুন আর খেলনা সামগ্রী।
 
শিশুদের এসব বেলুনের দাম ব্যবসায়ীরা রাখছেন ৪০ টাকা থেকে ৬০ টাকা। নানা রঙের নানা আকৃতির বেলুন। কোনো বেলুন লাল তো কোনটা নীল। রয়েছে হলুদ, আকাশী, বেগুনি রঙের বেলুন।
বেলুনের গায়ে রয়েছে নানা ছবি আকা। কোনটার গায়ে বল আকাতো কোনটার গায়ে কার্টুন। এ নিয়ে বেশি খুশি শিশুরা।
 
দিন বাড়ার সাথে সাথে নারীদের ভিড় বাড়তে থাকে চুরির দোকানগুলোতে। রেশমি চুরি, কাচের চুরি, খাচ কাটা চুরির পসরা। হরেক রঙের চুরি। এসব চুরির মধ্যে রেশমি চুরির চাহিদা সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।

বেশির ভাগ চুরি বিক্রেতাই নারী। এমনই একজন নাসরীন। একাধারে সব চুরির দাম বলে যান নাসরীন। রেশমী চুরির দাম ৪০ টাকা, কাচের চুরি ৩০ টাকা, খাচ কাটা চুরি ৬০ টাকা, প্লাস্টিকের চুরি ৩০ টাকা। তবে আজ হলুদ বা বাসন্তি রঙের রেশমি চুরির চাহিদা সবচেয়ে বেশি বলে জানান নাসরিন। এসব চুরি নাসরিন চকবাজার থেকে কিনে আনেন।
 
বসন্ত বরণকে কেন্দ্র করে বেড়েছে বই বিক্রিও। ফুটপাতের বই বিক্রেতা বলেন, আইজ পহেলা ফাল্গুন। লোকজন শাহবাগ এলাকায় বেশি আসতেছে। আর যেদনি লোকজন বেশি আসে সেদিন স্বাভাবিকভাবেই বই বিক্রি বাড়ে।
 
বই, চুরি বিক্রি পাশাপাশি বিক্রি হচ্ছে রাস্তার অস্থায়ী খাবার জমজমাট ব্যবসা। এর মাঝে রয়েছে ঝাল মুড়ি, ভেলপুড়ি, হাওয়ার মিঠাই। ভেলপুড়ির দাম পড়বে এক একটি ৫ টাকা। ঝালমুড়ি কিনতে ক্রেতাদের ব্যয় করতে হবে অন্তত ১০ টাকা। শিশুদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে নানা রঙের হাওয়ার মিঠাই। গোলাপি, সাদা, আকাশী রঙের হাওয়ার মিঠাই নিয়ে ক্রেতাদের সামনে হাজির হচ্ছেন বিক্রেতারা। এসব হাওয়ার মিঠাই এর দাম পড়ছে ২০ টাকা থেকে ৩০ টাকা।
 
পহেলা ফাল্গুনকে কেন্দ্র করে শাহবাগের ফুলের দোকানে বিক্রি বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ফুলের তোড়া, মালা, হাতের মালা, খোপার মালার যেন জুড়ি নেই। কেউবা আবার উপহারের জন্য নিচ্ছেন ফুলের তোড়া।
 
শাহবাগের ফুল বিক্রেতা জানান, বিশেষ দিন হলেই ফুল বিক্রি বেড়ে যায়। আর পহেলা ফাল্গুন ফুলের জন্যই তো খ্যাত। তাই খুচরা ও পাইকারী উভয় ধরনের বিক্রিই আমাদের বাড়ে। বছরের উল্লেখযোগ্য পরিমান ফুলের বিক্রি হয় এই ফেব্রুয়ারি মাসে। তার কারণ এই পহেলা ফাল্গুন আর ২১ ফেব্রুয়ারি। সাধারন দিনের তুলনায় এই দিনে আমাদের ফুল বিক্রি ১০ গুন বেশি হয়।
   
দুপুর দুইটা থেকে বসন্ত বরণকারী ফিরতে শুরু করেন চারুকলা অনুষদে। কারন বসন্ত বরনের বিকালের অনুষ্ঠান শুরু তিনটা থেকে। মঞ্চের সামনে সুবিধা মতো জায়গা নিতে আগেভাগেই চলে আসেন বসন্ত বরনকারীরা।   অনুষ্ঠানে প্রস্তুতিও চলে আগে ভাগেই। দুপুর ৩ টা থেকে  অনুষ্ঠান শুরু হয় যা চলবে রাত অবধি। দুপুর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন আরো মুখরিত হয়ে উঠে। একদিকে বসন্তবরনকারী অন্যদিকে বইপ্রেমীদের আগমনে গোটা দিনই মুখরিত হয়ে রয়েছে শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্ত্বর ও শহীদ মিনার এলাকা।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৪ ঘন্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৬
ইউএম/এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।