ঢাকা, শুক্রবার, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২৪ মে ২০২৪, ১৫ জিলকদ ১৪৪৫

ফিচার

যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে শ্রীমঙ্গলের খেলনা

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৬
যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে শ্রীমঙ্গলের খেলনা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): মেয়েরা বসে রয়েছে অর্ধ-গোলাকৃতি হয়ে। সবারই খেলনা তৈরির ব্যস্ততা।

কেউ বুনছেন সুতো, কেউবা সুতোর বুনন ঠিকঠাক কিনা তা শেষবারের মতো পরখ করে দেখছেন। কার খেলনা সবচেয়ে ভালো হলো- এ নিয়ে মৃদু আলোচনায়ও চলছে।

এ খেলনাটি বিশেষ ধরনের পুতুল। যা শিশুরা মুখে নিলেও কোনো ক্ষতি হয় না। বাংলাদেশি এ খেলনাটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। এ চাহিদাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববাজারে সিলেটের শ্রীমঙ্গল হয়ে উঠেছে একটি উজ্জ্বল নাম। মহাসাগরের বুকের উপর দিয়ে বাংলাদেশি নারীদের পরম মমতায় নির্মিত পুতুলগুলো পৌঁছে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের শিশুদের হাতে।

সম্প্রতি শ্রীমঙ্গল উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ পাচাউন গ্রামে গিয়ে দেখা মিললো হাতে তৈরি পুতুলের এ কর্মযজ্ঞ। নিরলস কাজ করে চলেছেন নুরুন্নেসা বেগম, রিমা বেগম, সুরশ্রী ভৌমিক, অর্পিতা চক্রবর্তী, সুরভী ভৌমিক, রুবিনা আক্তার, জমিলা, সামেলারা।

ক্রেলের যোগাযোগ কর্মকর্তা ইলিয়াস মাহমুদ পলাশ বলেন, হাতে বুনন প্রশিক্ষণ সোসাইটির উদ্যোগে এবং ক্রেল (ক্লাইমেট রেজিলিয়ান ইকোসিস্টেমস অ্যান্ড লাভলিহুডস) প্রকল্পের সহায়তায় স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীসহ গ্রামীণ নারীদের খেলনা তৈরির ওপর দু’মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা এখন অবসর সময়ে ঘরে বসে বসেই পুতুল তৈরি করে অতিরিক্ত অর্থ আয় করছেন।

মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী সুরশ্রী ভৌমিক বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি আমরা প্রতিদিন দু’ঘণ্টা করে সময় দেই। আমাদের ভালোই লাগছে কাজটি করতে। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী রয়েছে।

নুরুন্নেসা বেগম বলেন, আমাদের খেলনাগুলো বানাতে বেশ কষ্ট হয়। যদি আমাদের দৈনিক পারিশ্রমিকটা বাড়ানো হয় তবে খুব ভালো হতো। প্রশিক্ষক্ষণের সময় আমরা প্রায় দুই শতাধিক আইটেম তৈরি করেছি। আমাদের আইটেমগুলো হলো অক্টোপাস, কেটার পিলার, জিরাফ, পেঁচা।  

ক্রেল কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বুনন এই দলের সদস্য পঞ্চাশজন। ‘দক্ষিণ পাচাউন-১’ এবং ‘দক্ষিণ পাচাউন-২’ এই দু’টি গ্রুপে যথাক্রমে পঁচিশজন করে ভাগ করা রয়েছে। তারা সবাই প্রতিদিন দু’ঘণ্টা করে দু’মাসের একটি প্রশিক্ষণ নিয়ে পুতুলগু তৈরি করছেন।

তিনি আরও বলেন, এই দুই গ্রুপই একশোটি ‘অক্টোপাস’ খেলনা তৈরির অর্ডার পেয়েছে। প্রতি পিস তৈরির মজুরি হিসেবে ত্রিশ টাকা পাবেন। সুতা, সুইসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে। যদি তারা ঠিকঠাকভাবে চালিয়ে যেতে পারেন তাহলে বছরখানেক পরে একেক জন প্রতিমাসে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারবেন।    

গ্রামীণ নারীদের এমন কর্মসংস্থান প্রসঙ্গ মো. মনিরুজ্জামান বলেন, হাওর-বিল এলাকার মানুষকে প্রাকৃতিক জলাশয়ের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিকল্প পেশায় যুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবন-জীবিকার মান্নোয়নে এ কার্যক্রমটি বিশেষভারে পরিচালিত হচ্ছে।

প্যাবেল-চাইল্ড এর নির্বাহী পরিচালক এবং ‘হাতে বুনন’ কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়কারী হুমায়ুন কবির বাংলানিউজকে জানান, আমাদের বাংলাদেশি মেয়েদের হাতে তৈরি এই বিশেষ পুতুলগুলো পৃথিবীর প্রায় সাইত্রিশটি দেশে রফতানি করা হয়। তবে আমাদের মূল উৎপাদনের শতকরা ৮০ ভাগ পুতুল রফতানি হয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াতে। এই তিনটি দেশেই মূলত আমাদের মেজর-মার্কেট।

তিনি বলেন, একেকটি দেশের জন্য একেকভাবে আমরা পাঠাই। যুক্তরাজ্যে মাসে আমাদের দু’টো শিপমেন্ট যায়। অস্ট্রেলিয়াতে প্রতি মাসে একটি এবং যুক্তরাষ্ট্রে দুই মাস পরপর একটি করে। এটা নির্ভর করছে ওই দেশগুলোয় আমাদের নিজস্ব ডিলারদের ক্যাশ-ফ্লো’র উপর।

নিজেদের নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের সবকটি জেলাতেই আমাদের একাধিক সেন্টার অবস্থিত। দেশব্যাপী ১৩২টি সেন্টার রয়েছে আমাদের। তবে আমাদের হাতে বুননের হাব অফিস হচ্ছে ঢাকায়। শ্রীমঙ্গলের মতো সারাদেশ থেকে এই পণ্যগুলো ঢাকায় আসে। তারপর এগুলোকে উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে ওয়াশ করে লেভেল বসিয়ে প্যাক করে বিদেশে রফতানি করা হয়।

১৩২টি সেন্টার থেকে প্রতি মাসে আমাদের গড়ে এক লাখ পণ্য আসে। একেকটি পণ্যকে আমরা একেকটি ইউনিট বলি। শ্রীমঙ্গলে যে প্রোডাক্টগুলো তৈরি হচ্ছে সেগুলো একদম ছোট আইটেম। বাচ্চাদের বয়সের সঙ্গে ভাগ করে আমাদের পণ্যগুলো কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। আমাদের কোনো লোকাল সেল নেই। একদম শতভাগ এক্সপোর্ট অরিয়েন্টেড প্রোডাক্টস বলে জানান এই কর্মকর্তা।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়ের প্রতি হুমায়ুন কবির নজর টেনে বলেন, ‘বিডি এনিমেল’ নামে আমরা বাংলাদেশের বিশেষ বিশেষ বন্যপ্রাণীগুলো খেলনা আকারে তৈরি করে বিদেশি শিশুদের হাতে তুলে দেই। যেমন- রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হাতি, টিকটিকি প্রভৃতি। এই আইমেটগুলোকে আমরা ওয়ার্ল্ডওয়াইড প্রমোট করছি।

প্রতিটি খেলনার গায়ের লেভেলে লেখা থাকে ‘দিস প্রোডাক্ট মেইড ইন বাংলাদেশ’। এছাড়াও প্রতিটি খেলানার সঙ্গেই ‘বাংলাদেশি পতাকা’ থাকে। যেনো শিশুরা বুঝতে পার, এটা বাংলাদেশের তৈরি। এভাবেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের দেশের নাম।

বাংলাদেশ সময়: ১১২১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৬
বিবিবি/এসএনএস

 

 

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।