ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

বর্ষায় পর্যটক টানছে মিরসরাইয়ের বুনো ঝরনা

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৩১ ঘণ্টা, জুলাই ৯, ২০১৮
বর্ষায় পর্যটক টানছে মিরসরাইয়ের বুনো ঝরনা মিরসরাইয়ের বুনো ঝরনা। ছবি: বাংলানিউজ

মিরসরাই (চট্টগ্রাম): রোববার (৮ জুলাই) ভোর সাড়ে ৫টা, ফেনী রেলস্টেশনের দুই নম্বর প্লাটফর্মের একটি টঙ দোকানে ২০ থেকে ২৫ জন তরুণদের জটলা।

সবার পিঠেই ব্যাকপ্যাক। দূর থেকেই বোঝা যায় তারা ঘুরতে বের হয়েছেন।

কিন্তু প্রশ্ন জাগে তাদের গন্তব্য কোথায়? কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই সবার উত্তর একটাই চট্টগ্রামের মিরসরাই তাদের গন্তব্য।

বর্ষায় ঝরনার ঠাণ্ডা জলে গা ভেজাবেন সবাই, এসেছেন ঢাকা থেকে। মিরসরাই সীতাকুন্ড থামবে এমন লোকাল ট্রেনের অপেক্ষা করছেন সবাই। উপভোগ করবেন বুনো পাহাড়ি সব ট্রেইলের অ্যাডভেঞ্চার। প্রতিবার বর্ষা মৌসুমে এভাবেই পর্যটকে সরগরম হয়ে উঠে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বুনো ও জল প্রপাতগুলো।  মিরসরাইয়ের বুনো ঝরনা।  ছবি: বাংলানিউজপ্রকৃতিতে চলছে বর্ষাকাল। অবিরাম বৃষ্টিতে পাহাড়ের বৃক্ষরাজি লাভ করে নব যৌবন। পাহাড়ের বুক চিরে রুপবতী ঝরনা দেখতে চাইলে বর্ষাকালের যেন বিকল্প নেই। ভরা বর্ষাতেই ঝরনা বা জলপ্রপাতগুলো সুপ্ত থাকার পর যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠে।

ট্রাভেলাররা এ সময়টাতেই এসব জায়গায় ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন, কারণ ঝরনা বা জলপ্রপাতগুলোর আসল সৌন্দর্য দেখা যায় এ সময়েই। এমন বর্ষায় প্রকৃতি যেন তার সবটুকু রূপ ঢেলে দিয়েছে মিরসরাইয়ের বুনো পাহাড়ি এলাকার ঝরনাগুলোতে। মিরসরাই ঘুরে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়লয়ের ছাত্র রায়হান আহমেদ এমনটাই জানালেন।

পাথরের পর পাথর পেরিয়ে স্বচ্ছ জলের ধারা পড়ছে গড়িয়ে। সবুজের অরণ্য মাড়িয়ে ঝরনাধারার স্রোতধারা কল কল শব্দে নেমে যায় সমতলে। নাম না জানা লতাপাতা-গুল্ম, বাঁশবন, বুনোফুল ও ফলের গাছ আর নিভৃত ঝিরিপথের অপার সৌন্দর্য যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের এই বুনো ঝরনাধারা আর জল প্রপাতগুলো।

রুপসী ঝরনা: মিরসরাইয়ের বড় দারোগারহাটের উত্তরে পাহাড়ের কোলে অবস্থিত রুপসী ঝরনা। এক কথায় দৃষ্টিনন্দন। মিরসরাইয়ের অন্যান্য ঝরনাগুলোর চেয়ে এই ঝরনায় যাওয়া অনেকটাই সহজ, এবং  সৌন্দর্য্যে কোনো অংশেই অন্যান্য ঝরনার চেয়ে কম নয়। এই ঝরনার যাওয়ার পথে দৃষ্টিনন্দন ছড়া, দু'পাশের দণ্ডায়মান পাহাড়, সবুজ প্রকৃতি, গুহার মতো ঢালু ছড়া, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন অপরুপ ঝরনা, রুপসীর সৌন্দর্যকে অন্যান্য ঝরনা থেকে আলাদা করেছে। মিরসরাইয়ের বড় দারোগারহাট বাজার থেকে আধা কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলে রেললাইন। রেললাইন পেরুলেই  মেঠো পথ, সেই মেঠো পথ ধরে একটু হাঁটলেই পাহাড়ের পাদদেশ। বাঁ দিকে ৫০ গজ হাঁটলেই চোখে পড়বে একটি ছড়ার। সেই ছড়াই রুপসীর প্রবেশপথ। ছড়া ধরে দশ মিনিট হাঁটলেই,পাওয়া যাবে রুপসীকে।  মিরসরাইয়ের বুনো ঝরনা।  ছবি: বাংলানিউজখৈয়াছড়া ঝরনা: কাচের মতো স্বচ্ছ পানি পাহাড়ের শরীর বেয়ে আছড়ে পড়ছে পাথরের গায়ে, গুঁড়ি গুঁড়ি জলকণা আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশার আভা। বুনোপাহাড়ের দেড়শ’ ফুট উপর থেকে গড়িয়ে পড়া স্রোতধারা কলকল শব্দে এগিয়ে যাচ্ছে পাথরের পর পাথর কেটে সামনের দিকে তার গন্তব্যে। চারপাশের গাছ গাছালি আর নাম না জানা হাজারও প্রজাতির লতাপাতা ও গুল্মে আচ্ছাদিত হয়ে আছে পাহাড়ের শরীর। স্রোতধারা সে লতাগুল্মকে ভেদ করে গড়িয়ে পড়ছে ভূমিতে। তৈরি করছে জলধারা। সে যে কী এক বুনো পরিবেশ না দখলে বিশ্বাস করানো কঠিন।

অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটক, যারা চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন কেবল তাদের জন্যই রয়েছে এই ঝর্না দর্শনের সুযোগ। কেননা সরকারি তেমন কোনো উদ্যোগ না থাকায় এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রচার প্রচারণার অভাবে বাংলাদেশের অন্যতম এই জলপ্রপাত রয়ে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে।

নাপিত্তাছড়া ঝরনা: পাহাড়ি অরণ্যঘেরা নাপিত্তাছড়া যেন ছবির মতো সুন্দর। বিশাল বিশাল পাথরের ফাঁক দিয়ে নেমে এসেছে ছড়ার পানি। ২ পাশে উঁচু পাহাড়ের দেয়ালে চুমু দিয়ে সেটে আছে সবুজ গাছেরা। নানা রকম চেনা-অচেনা পাখির কলতান, অরণ্যের নিস্তব্ধতার মাঝে নানা শব্দ,আদিবাসিদের মাছ ধরা আরো কত কি। নাপিত্তাছড়া যেতে হলে মিরসরাই এর নদুয়ার বাজার/হাট (নদুইয়ার/নয়দুয়ারীর বাজার/হাট) যেতে হয়। এরপর পাহাড়ি অরণ্যে ঝিরিপথ। ঘণ্টা দেড়েক হাঁটলেই পেয়ে যাবেন। তবে এটার আগে আরও দু'টা ঝরনা পাবেন। প্রথমে কুপিকাটাকুম ও পড়ে মিঠাছড়ি।

বাওয়াছড়া ঝরনা: সবুজের গা বেয়ে উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের বাওয়াছড়ায় যুগ যুগ ধরে ঝরছে ঝরনা ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। ঝরনার জল পড়ার ধ্বনি, সবুজ অরণ্য পাখির কলতান মন জুড়িয়ে যাবে নিমিষেই। চট্টগ্রাম শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাইয়ে ছোট কমলদহ বাজার থেকে দেড় কিলোমিটর পূর্বে পাহাড়ের পাদদেশে এ ঝরনার অবস্থান। ঝরনার পানিতে গোসল করছের পর্যটকরা।  ছবি: বাংলানিউজহাঁটুভাঙা ও সর্পপ্রপাত ঝরনা: হরিণমারা হাঁটুভাঙা ট্রেইলে পাবেন এ দুটো ঝরনা। এই ট্রেইলটা মিরসরাই অঞ্চলের অন্যতম সুন্দর একটি ট্রেইল। এছাড়াও সর্পপপ্রাতের পাশে বাওয়াছড়ার মুখ। এই পথে ঢুকতেই পাওয়া যাবে অপূর্ব নীলাম্বও লেক। সীতাকুন্ডের আগে ছোট কমলদহ বাজার। বাজারের পরের রাস্ত আর বাইপাস যেখানে মিলেছে  সেখানে নামতে হবে। এরপর পূর্ব দিকে ঢুকে বাকিটা রাস্তা ছড়ার পথ ধরে এগিয়ে গেলেই পাবেন ঝরনা দুটো।

মহামায়া ঝরনা: মহামায়া যেন শিল্পীর ক্যানভাসে কল্পনার রঙে আঁকা ছবি। সবুজে মোড়ানো পাহাড় বেয়ে নামছে স্বচ্ছ জল, সে জলের ঝননায় মুগ্ধ হচ্ছেন পর্যটকরা। রাঙামাটির কাপ্তাই লেকের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহামায়া প্রাকৃতিক লেক ও ঝরনায় ইদানিং প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটছে। এছাড়াও মিরসরাই অংশে রয়েছে, হরিণমারা, হাঁটুভাঙা, বাঘবিয়ানী, বোয়ালিয়া, অমরমানিক্য, বাউশ্যাছড়া, নেহাতেখুম, উঠান, বান্দরখুমসহ আরও অনেক ঝরনা ও জলপ্রপাত। পাশের এলাকা শাতাকুন্ডে পাওয়া যাবে সহস্রধারা, সুপ্তধারাসহ আরো বেশ কয়েকটি ঝরনা ও ট্রেইল।

যাতাযাত: ঢাকা থেকে আসতে হলে চট্টগ্রামমুখী বাসে উঠে মিরসরাই বাসস্ট্যান্ডে নামতে হবে। এরপর সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে যাওয়া যাবে ঝরনাগুলোতে। তবে প্রায় ঝরনায় যেতে পায়ে হাঁটাতে লাগবে অনেক পথ।

সতর্কতা: বর্ষায় ঝরনা বা ট্রেইলে ভ্রমণকালীন সময়ে যেকোনো মুহূর্তেই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। অনেকেই ঝরনা বা ঝিরিতে গিয়ে অতি আনন্দে খেই হারিয়ে ফেলেন। বিপদজনকভাবে ছবি বা সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে যান। অথচ পাহাড়ের খাল, ঝরনা বা ঝিরির পাথরগুলোতে প্রচুর শ্যাওলা জমে পিছল হয়ে থাকে। মিরসরাইয়ের বুনো ঝরনা।  ছবি: বাংলানিউজএকটু খানি পা পিছলে গেলেই ঘটতে পারে বিপদ। পানির প্রচন্ড স্রোত থাকে, বিশেষ করে ভরা বর্ষায়। সেসঙ্গে পানির স্রোতের প্রচন্ড শব্দও থাকে। এরকম পরিস্থিতিতে বিপদে পড়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার করলেও অন্য কারো কাছে সে শব্দ পৌঁছায় না। বিশাল, খরস্রোতা ও ভয়ংকর ঝরনা বা জলপপ্রাতের মধ্যে বিপদগ্রস্ত কাউকে সাহায্য করাও এতো সহজ নয়। যেকোনো ঝরনা ও ঝিরিই একটুর জন্য বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে। তাই সব সময় সাবধান থাকা উচিত।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, জুলাই ০৯, ২০১৮
এসএইচডি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।