হ্যাঁ, বসন্ত এসে গেছে। স্বর্গের কানন সাজাতে পল্লব এখন মঞ্জুরিত।
বাংলাদেশের মানুষের জীবনে ঋতুরাজ বসন্ত নিয়ে আসে প্রেম ও বিদ্রোহের যুগল আবাহন। সে আবাহনে আজ খুলে গেছে দখিনা দুয়ার। তাইতো মানব-মানবীর হৃদয়ের বেদিতে আজ প্রজাপতির রঙিন পাখা, মৌমাছির গুনগুনানি, বৃক্ষ-লতা-গুল্ম, ফুলে-ফলে, পত্র-পল্লবে, শাখায় শাখায়, ঘাসে ঘাসে, নদীর কিনারে, কুঞ্জ-বীথিকা আর অরণ্য-পর্বতে নবযৌবনের বান ডেকেছে। তার অবগাহন রঙিন করবে তরুণ-তরুণীর প্রাণকেও। তাদের প্রাণেও অনুরণিত হবে বাউল করিমের ভাষা, ‘বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে’। মেয়েরা আজ সে গন্ধ মাখা খোঁপায় গাঁদা-পলাশসহ নানা রকম ফুলের মালা গুঁজে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরবে, ছেলেরা পাঞ্জাবি-পায়জামা ও ফতুয়ায় শাশ্বত বাঙালির সাজে উৎসবের হাওয়ায় ভেসে বেড়াবেন শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর, চারুকলা, টিএসসি ও অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণসহ নগরীর এখানে-ওখানে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনাপার্ক, মিন্টো রোড, জাতীয় সংসদ, চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেন, ধানমণ্ডি লেক- সর্বত্রই বইছে বাসন্তী হাওয়া। ফোনে, ফেসবুক, গুগল প্লাস ও টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমেও চলছে বসন্তের শুভেচ্ছা বিনিময়। তবে শুধু প্রাণের দুরন্ত আবেগ আর প্রেমে নয়, এ ঋতুতে বাংলার মানুষ জেগে ওঠে দ্রোহে-প্রতিবাদে। আগুনরাঙা এই ফাল্গুনে অশোক-পলাশ-শিমুলের রঙ শুধু প্রকৃতিতেই উচ্ছ্বাসের রঙ ছড়ায় না, ছড়ায় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের শহীদদের রক্ত-রঙিন স্মৃতির ওপরও। বায়ান্নর ৮ ফাল্গুন; তথা একুশের পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ার মিলেমিশে একাকার। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার চেয়ে বাংলার তরুণরা রক্ত ঝরিয়েছে এ ঋতুতে। তাই ফাগুন এলেই আগুন জ্বলে মনে, ফাগুন এলেই কোকিল ডাকে কুঞ্জে। প্রকৃতির সেই রূপতরঙ্গে দুলে উঠে কবিগুরু গেয়ে ওঠেন, ‘ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে। ’পহেলা ফাল্গুনে বসন্ত উৎসবের রঙে মেতে ওঠে তরুণ হৃদয়, নতুন করে প্রাণ পান প্রবীণেরা। বসন্তে শুধু প্রকৃতিই নয়, হৃদয়ও রাঙা হয়ে ওঠে। বসন্ত তাই অনেকের কাছে ‘প্রেমের ঋতু’। সে ঋতুতে চোখে নেশা লাগে, দিক ভুল হয়; বাসনা বিলাসে বাড়ে আশা, বৃদ্ধি পায় মনের সুপ্ত তিয়াশা। তারই রেশ ধরে শচীন কর্তার মতো তাই সকলের মনে অনুরণিত হয়, ‘শোন গো দখিনা হাওয়া/ প্রেম করেছি আমি’। প্রেম বিলিয়ে এ ঋতুতে শিমুল-পলাশের ডালে বসে তাকে কাছে টানবে কোকিল, পাপিয়া, ময়না। ফুলের মধু খেতে আসবে পাখি। এই ফুল থেকে ওই ফুলে ঘুরবে মৌমাছি। মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতাদের পাশ কাটিয়ে জাগবে নতুন প্রাণ। নিষ্প্রাণ প্রায় এই কংক্রিটের শহরে ভালোবাসার সে কুহুস্বরে মুখর পরিবেশে মন যেন কোনো উদাসলোকে হারিয়ে যেতে যায়। মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধ জানিয়ে দিয়ে যায়, সত্যি সত্যি বসন্ত ঋতুর রাজা।
মোগল সম্রাট আকবর দূর অতীতে ১৫৮৫ সালে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল ‘বসন্ত উৎসব’। এ উৎসব মহানগর ঢাকা থেকে সারাদেশে নতুন করে তরঙ্গিত হতে শুরু করেছে ১৪০১ বঙ্গাব্দ থেকে। তারই রেশ ধরে ২৫ বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও রাজধানীতে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করেছে জাতীয় বসন্ত উদযাপন পরিষদ। সকাল ৭টায় চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় যন্ত্রসঙ্গীতের সুর-মূর্ছনা দিয়ে শুরু হয়ে এ উৎসব চলবে সকাল ১০টা পর্যন্ত। বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত একযোগে অনুষ্ঠান চলবে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক, চারুকলার বকুলতলা, ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর এবং উত্তরার ৩নং সেক্টরের রবীন্দ্র স্মরণীর উন্মুক্ত মঞ্চে। শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে বিকেল সাড়ে ৪টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ‘মুক্ত মঞ্চে’ বসন্ত উৎসব আয়োজন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ৬০০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৯
এইচএমএস/এএটি