বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে প্রিয়জনকে গোলাপ দেওয়ার পাশ্চাত্য রীতি ছড়িয়েছে এই উপমহাদেশেও। তাই এই দিনটিতে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত উপহার হয়ে ওঠে একটি লাল গোলাপ।
ঢাকার অদূরে তুরাগ নদীর তীরে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাদুল্যাপুর গ্রামের সবচেয়ে ভালো বিশেষণ সেই অর্থে ‘ভালোবাসার গ্রাম’। এই গ্রামটির নাম দেশের মানুষ জানে এই গোলাপের কারণে। ঋতুরাজ বসন্তে গোলাপগ্রাম সাদুল্যাপুর যেন রানি রূপে ধরা দেয় প্রকৃতিতে। প্রতিবছর বিশ্ব ভালোবাসা দিবস কেন্দ্র করে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয় বিরুলিয়ার গোলাপগ্রামে।
সাদুল্যাপুর গোলাপ বাগানে যতদূর চোখ যাবে গোলাপে ঢাকা চারপাশের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করে রাখবে। সৌন্দর্য উপভোগ করতে ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর দোহার, সোনারগাঁও, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রিয়জনকে নিয়ে ছুটে এসেছে অনেকেই। ভালোবাসা দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে অনেক তরুণ-তরুণী এই গোলাপগ্রামে প্রিয়জনকে নিয়ে যেন ভাসিয়েছেন ভালোবাসায়। গোটা গ্রামটি যেন সেদিন তার জন্য উপহার!
কেউ দলবেঁধে, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে, কেউ আবার কেউ এসেছেন পরিবার নিয়ে। এতে গ্রামজুড়ে উৎসব উৎসব পরিবেশ সৃষ্টি হয় প্রতিবছর। সবার হাতে লাল গোলাপ, তরুণীদের মাথায় গোলাপের টায়রা। গোলাপের সৌরভের সঙ্গে ভালোবাসার এক সেতু তৈরি করেছে পুরো গ্রামজুড়ে।
শুধু ফাল্গুন কিংবা ভালোবাসা দিবস নয়, এই গোলাপগ্রাম সারা বছর থাকে সৌন্দর্যপিয়াসীদের ভিড়। তবে ভালোবাসার দিন এই গ্রামের পা রাখা প্রায় প্রত্যেকে একে অপরকে গোলাপ দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে দেখা গেছে।
বাগানগুলোতে চাষিরা কেউ গোলাপ তুলছেন, আবার কেউ গোলাপ বাঁধাই করছেন। আপনি চাইলে এখানকার যেকোনো বাগানের মালিকের সঙ্গে কথা বলে গোলাপ কিনতে পারেন। তবে ১০০-১৫০টির কম গোলাপ বিক্রি করতে চায় না কেউই।
গোলাপ বাগান দেখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া রুনা আক্তার রিমি এসেছেন বন্ধুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা কয়েক বন্ধু মিলে এখানে এসেছি। সারাদিন থেকে বিকেলে ঢাকা যাবো। সারাদিন আমরা বিভিন্ন বাগানে ঘুরবো, ছবি তুলবো, বাগান থেকে তাজা ও ফ্রেশ গোলাপের সুবাস নেবো। যাওয়ার সময় কিছু গোলাপ কিনেও নিয়ে যাবো।
তার বক্তব্য, ভালোবাসার জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিনের প্রয়োজন নেই। কারো সঙ্গে বা কাউকে একটি গোলাপ দিয়ে এক বাটি ফুচকা খাওয়ালেই ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসার জন্য একে ওপরের ওপর বিশ্বাস অর্জন করতে হয়। তবেই সত্যিকার ভালোবাসা পাওয়া যাবে।
ভালোবাসা দিবসে দোহার থেকে পরিবার নিয়ে গোলাপ গ্রাম দেখতে এসেছেন আবুসাঈদ শেখ। তিনি বলেন, সাদুল্যাপুর পুরো গ্রামটাই যেন গোলাপের বাগান। উঁচু জমিগুলো ছেয়ে আছে মিরান্ডি জাতের লাল গোলাপে। শহরের অনেক জায়গায় দোকানে অথবা রাস্তায়, অনেক গোলাপ দেখা যায়। তবে বাগানে গোলাপ দেখার অনুভূতিই আলাদা। আর যদি পুরো গ্রামটাই হয় গোলাপ গ্রাম তাহলে আনন্দ আর ভালোবাসা মিলেমিশে একাকার।
সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাদুল্যাপুর গ্রামের ১৬ বছর ধরে গোলাপ চাষ করা মহম্মদ সোলায়মান মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ভালোবাসা দিবস এলে আমাদের গ্রামে উৎসব শুরু হয়। এদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছেলে-মেয়েরা বেড়াতে আসে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে। তারা নানা রঙের পোশাক পরে গ্রাম ও বাগানে বাগানে ঘুরে বেড়ায়। হাসি-আনন্দে সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যায়। প্রথমে আমাদের কাছে খারাপ লাগলেও এখন ভালো লাগে। কারণ তারা খারাপ কিছুতো করছে না।
‘এ দিবস নিয়ে তাদের আনন্দ দেখে এখন মনে হয় বছরের প্রতিটা দিন যদি ভালোবাসা দিবস হতো তাহলে পৃথিবীতে কোনো দুঃখ থাকতো না। ’
গোলাপ ফুল চাষের সঙ্গে যুক্ত আরিফ হাসান বাংলানিউজকে বলেন, এখানকার গোলাপ পুরো ঢাকা বিভাগের চাহিদা পূরণ করে। এখানে আগে অনেকে শখের বসে ফুলের বাগান করলেও এখন বেশিরভাগই ফুল চাষকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। গোলাপের নির্দিষ্ট দাম নেই। ভালোবাসা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, পহেলা বৈশাখ, থার্টিফার্স্ট নাইটসহ বিশেষ দিনগুলোতে গোলাপের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। প্রতি একশো গোলাপ বাগান থেকে এক হাজার থেকে পনেরশ টাকা দামে বিক্রি হয়। তবে বিশেষ দিন ছাড়া বেশিরভাগ দিনই প্রতি একশো গোলাপ ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। এসব গোলাপ বাগান থেকে এ দামে বিক্রি হলেও বাইরের দোকানগুলোতে আট থেকে দশগুণ বেশি দামে বিক্রি হয়।
১৯৯০ সাল থেকে বিরুলিয়াতে গোলাপ ফুল চাষ শুরু হয়। এ ইউনিয়নের সাদুল্যাপুর, শ্যামপুর, মোস্তাপাড়া, আরও বেশ কয়েকটি গ্রামের জীবিকার প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মিরান্ডি জাতের রক্তলাল গোলাপের চাষ। বর্তমানে এই ইউনিয়নে ৮০ শতাংশ মানুষ গোলাপ চাষ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। বাণিজ্যিকভাবে এই ফুল চাষের কারণে বছরের ১২ মাস গোলাপ চাষ হয়। শীতকালে এই ফুলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুন, একুশে ফেব্রুয়ারিসহ জাতীয় দিবসগুলোতে গোলাপের চাহিদা ব্যাপক থাকে। বিরুলিয়ায় প্রায় চার হাজার চাষি গোলাপ ফুল চাষ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৯
জিসিজি/এএ