প্রতি বছরের মতো বৈসাবি উৎসব ঘিরে জেলা-উপজেলা শহরে আয়োজনের কমতি নেই। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, র্যালি, খেলাধুলা, মেলাসহ আরো কতো কি।
সারাদেশের মানুষ যখন বাংলা নববর্ষ উদযাপন করবেন, ঠিক তখনি পার্বত্যবাসী ‘বৈসাবি’ উৎসব পালন করবেন। নিজেদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য তুলে ধরবেন এই উৎসবে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষগুলো ছুটে আসেন এই উৎসবে। ভিন্নধর্মী এই উৎসব মুগ্ধ করে সবাইকে।
পাহাড়ের প্রতিটি উৎসবে সবার অংশগ্রহণ সার্বজনীনতায় রূপ নেয়। ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ আর চাকমাদের ‘বিজু’; তিন সম্প্রদায়ের তিন নামের আদ্যক্ষর দিয়েই নামকরণ হয় ‘বৈসাবি’। প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের পাশাপাশি পাহাড়ে উদযাপিত ঐতিহ্যবাহী ‘বৈসাবি উৎসব’। যদিও পাহাড়ে বসবাসরত অন্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীও ভিন্নভিন্ন নামে উৎসব পালন করে থাকেন। আগামী ১২ এপ্রিল (শুক্রবার) থেকে বৈসাবির মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। তবে এরইমধ্যে এই উৎসবকে ঘিরে পাড়া-মহল্লায় শুরু হয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা ও মেলা।
বৈসু-ত্রিপুরা সম্প্রদায় তিন দিনব্যাপী এই বৈসু উৎসব করে থাকে। প্রথমদিন হারি বৈসু, দ্বিতীয় দিন বৈসুমা এবং শেষদিন আতাদাক কিংবা বিছিকাতাল। হারি বৈসুতে ত্রিপুরা তরুণ-তরুণীরা বন জঙ্গল থেকে ফুল সংগ্রহ করেন। বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সেই ফুল শোভা পায় ঘরের দরজা-জানালায়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং সাজানো থেকে বাদ পড়ে না গৃহপালিত পশু পাখি।
দ্বিতীয়দিন বৈসুতে সকালে ছোটরা বড়দের প্রণাম করে আশীর্বাদ নেয়। তারপর চলে অতিথি আপ্যায়ন। তৃতীয় দিন অর্থ্যাৎ ১৫ এপ্রিল ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের দিনপঞ্জী অনুযায়ী নতুন বছর। ঐদিন ছোটরা বড়দের গোসল করিয়ে বস্ত্র দান করেন এবং মন্দিরে মন্দিরে পূজা দিয়ে থাকেন।
সাংগ্রাই- মারমা সম্প্রদায় এই সাংগ্রাই উৎসব চলে চারদিন ধরে। প্রথমদিন সাংগ্রাই, তারপর আক্যে, আতাদা এবং আতং। এই চারদিনই বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, অতিথি আপ্যায়ন, বিশেষ পাঁচন রান্নাসহ বিভিন্ন কিছু দিয়ে চলে উৎসব উদযাপন।
বিজু- চাকমা জাতিগোষ্ঠী তিনদিন ধরে এই বিজু উৎসব উদযাপন করে থাকে। ফুল বিজু, মূল বিজু এবং গজ্জাপজ্জা। বিজুর দিন সকালে চাকমা তরুণ-তরুণীরা বন জঙ্গল থেকে ফুল এনে সবার মঙ্গল কামনায় নদীতে ভুল ভাসিয়ে দেন, ঘরবাড়ি সাজিয়ে তোলেন। বাকি দুইদিন বিভিন্ন সামাজিক আনুষ্ঠানিকতায় উদযাপন করা হয় বিজু উৎসব।
‘বৈসাবি’র নামের কারণে অনেকে বাকি জনগোষ্ঠীর উৎসবের খবর জানেন না। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি জনগোষ্ঠী আছে যাদেরও ভিন্নভিন্ন নামের এই উৎসব। তবে পাহাড়ে এমন একটি গোষ্ঠী আছে যাদের উৎসবের দিনটিও কাটে অনেকটা নিত্যদিনের মতো। যেখানে গোটা পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ উৎসবে মেতে থাকেন সেখানে ঠিক উল্টো রথে থাকে খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার সাঁওতাল পরিবার। তাদের মধ্যে থাকে না উৎসবের কোনো ছোঁয়া। অন্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মতো তাদেরও রয়েছে বছরের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উৎসব। যার নাম পাতাবাহা।
বাংলা নববর্ষের দিন থেকে শুরু হয়ে পর্যায়ক্রমে বাহামি, পাতা ও ছাতা নামে তিনদিন ধরে এই উৎসব পালিত হয়। কিন্তু যেখানে দু’বেলা আহার যোগাড় করা দুষ্কর, সেখানে উৎসব পালন যেন আকাশ কুসুম স্বপ্ন! তারপরও মানুষের ভিড়ে কিছু মানুষ থাকে যারা বলতে পারে না মনের কথা, বোঝাতে পারে না কষ্ট, চাইতে পারে না অধিকারটুকু। কষ্ট আর অভিমানের মিশেলে এখন এই সমাজের কাছে সহজ-সরল সাঁওতাল মানুষগুলোর চাওয়া নেই। মৌলিক চাহিদাটুকুবঞ্চিত মানুষগুলোর শুধুমাত্র বেঁচে থাকা..।
বৈসাবি মানেই রঙে বর্ণে বৈচিত্র্যময় এক ঐতিহ্যবাহী উৎসব। বিজু-সাংগ্রাই-বৈসু-পাতাবাহা, যে নামেই বলা হোক না কেনো, এই উৎসব যেনো পাহাড়িদের প্রেরণা-পাহাড়ের জাগরণ। বংশ পরম্পরায় পালিত এই উৎসবের সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া আর বাংলা’র মিশেলে বৈসাবি হয়ে উঠেছে সর্বজনীন অন্য এক পাহাড়িয়া উৎসবে। পরিবেশ-পরিস্থিতি, ধনি-গরিব, নানা বাস্তবতায় আয়োজনে পার্থক্য গড়ে তুলতে পারে কিন্তু শেকড়ের খোঁজে সবার লক্ষ্য এক! এখন অপেক্ষা বৈসাবি উৎসবের...।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৯
এডি/জেডএস