আছে তৃতীয় লিঙ্গের এক সরব উপস্থিতিও। একই সঙ্গে একটি বেওয়ারিশ লাশ; যে কখনই বেওয়ারিশ নয়, তাও সমাজকে প্রত্যক্ষ করান তিনি।
চলচ্চিত্রের কাহিনীতে দেখা যায়, সমাজের এলিট শ্রেণির মানুষগুলোর ঠিক বিপরীত অবস্থানে থাকা একজন আর্টিস্ট চিত্রশিল্পের মধ্য দিয়েই নির্বাহ করেন তার জীবিকা। একাকীত্ব ভালোবাসা মানুষটি নদীর উপর ঘর বানিয়ে থাকেন একাই। তবে তাকে ভালোবাসেন সমাজের প্রায় সকলেই। পরম স্নেহ আর মমতায় তাকে সঙ্গ দেন কালী হিজড়া। এরপর সাম্প্রতিক সহিংসতায় ক্রসফায়ারের পর একটি লাশ ভেসে এসে বাঁধে তার ঘরের সাথে। সেই লাশকে ঘিরেই এগুতে থাকে কাহিনী।
সমাজ এই ভেসে আসা লাশটিকে বেওয়ারিশ বললেও আলফা জানে তা নয়। আর সেটি তিনি প্রত্যক্ষ করান সমাজকে।
শনিবার (২০ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৭টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে আয়োজন করা হয় সিনেমাটির প্রিমিয়ার শোয়ের। এতে উপস্থিত ছিলেন দেশবরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতারা, কবি-সাহিত্যিক ও সিনেমাটির শিল্পীসহ অন্যরা। দেড় ঘণ্টাব্যাপী চলচ্চিত্রটির প্রদর্শনী শেষে আড্ডা, আলোচনা, প্রশ্নে হয় পর্যালোচনা পর্ব।
এ সময় সিনেমার পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ছবিটিতে লোনলিনেসের অ্যাপ্রোচ আছে প্রচুর। তবে একটা মানুষের সমসাময়িক যে জীবনযাপন, তার মধ্যে সাংস্কৃতিক যে বাঁধা আছে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বাঁধা আছে, সেগুলোরও উপস্থিতি আছে। আমার ভালো লাগছিল অন্য জায়গায় সেটা হচ্ছে- সংস্কৃতিটা কিভাবে অপভ্রংশ হয়ে একটা অদ্ভুত আকার ধারণ করেছে। এখানে কমপ্লেক্সভাবে একটা কালচার উঠে এসেছে।
‘রাষ্ট্রের ক্ষমতা দ্বন্দ্বের জন্য যে সাংঘাতিক ধরনের হত্যাকাণ্ডলো ঘটতে থাকে, সেগুলোতে মানুষের ডিসকমফোর্টটা কতটুকু আছে, এটা জানার খুব ইচ্ছে ছিল। পরে দেখবেন যে, লাশটাকে নিয়ে ওকে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে একটি মানুষের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার, একটা জায়গা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি। এর সবই আমার ভাবনা, জানি না কতটুকু স্বার্থকতা আছে,’ যোগ করেন তিনি।
চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম বলেন, কোনো প্রথাগত গল্প বলার চেষ্টা নেই, কিন্তু সবই আছে। সময়টা আছে। প্রত্যেকটা চরিত্র মানবিক এবং খুবই মানবিক একটি ছবি। আমি বলবো বাচ্চু ভাইয়ের আগের দুইটা ছবি থেকে এটা অনেক অনেক ছাড়িয়ে গেছে। অভিনয় শৈলীর দিক থেকেও ভালো করেছেন প্রত্যেকে।
প্রখ্যাত শিল্পসমালোচক ও চলচ্চিত্রবোদ্ধা ঢাকা সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মঈনুদ্দিন খালেদ বলেন, ফিল্মের যে এরিয়া তার বাইরেও অনেক কাজ আছে এটার, পারফর্মিং আর্ট যেটা আমরা বলি। এতগুলো ভরকেন্দ্র, এতগুলো রিলিজিয়ন, এতগুলো কালচার এবং সাউন্ড মোটিফ, রক্ত—এগুলো সবকিছুই আমাকে মোহিত করেছে। পরিমিতি বোধটা আছে। বাংলাদেশে এমন একটা ছবি আমার কাছে বিস্ময়কর।
কবি ফরিদ কবির বলেন, চলচ্চিত্রও যে কবিতা হয়ে উঠতে পারে, পুরো ছবিতে সেটা আছে। ক্যামেরার কাজের মধ্যে, নদীর স্রোতের মধ্যে, রঙের মধ্যে। সবকিছু মিলিয়ে যে শিল্পের বেড়ে ওঠা, কবিতা হয়ে ওঠা সেগুলো আমরা দেখেছি।
তবে প্রশংসা করলেও একটুখানি সমালোচনাও পেয়েছে ছবিটি। এ প্রসঙ্গে ফরিদ কবির বলেন, শেষ ২০ মিনিট আমার কাছে একটু বড় লেগেছে। কোথাও কোথাও একটু প্রলম্বিত মনে হচ্ছিলো। এটা আরো সহজ করা যেতো।
তবে সমালোচনাকে ছাপিয়ে প্রশংসাই বেশি কুড়িয়েছে চলচ্চিত্রটি। এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্রকার আবু সাঈদ বলেন, এই ছবিটা দেখে মনে হয় না এটা বাচ্চু ভাই করেছেন। মনে হয় একটা তরুণ হাতের কাজ। তবে অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞা না থাকলে এমন কাজ করা সম্ভব নয়। আর সেখান থেকেই বোঝা যায় এটা বাচ্চু ভাইয়ের করা।
আয়োজনে চলচ্চিত্রটির সঙ্গে সম্পৃক্ত কলা-কুশলীরা কথা বলেন, বিভিন্ন অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি নিয়েও। এছাড়া বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর সম্পাদক জুয়েল মাজহারসহ অনুষ্ঠানে দেশবরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কবি-সাহিত্যিকরা উপস্থিত ছিলেন।
‘আলফা’ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতে যাচ্ছে ২৬ এপ্রিল। সিনেমাটির মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রবীণ অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান, নবীন অভিনয়শিল্পী আলমগীর কবির, দোয়েল ম্যাশ, হীরা চৌধুরী, ইশরাত নিশাত, মোস্তাফিজ নূর ইমরান ও ভাস্কর রাসা প্রমুখ।
ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে নির্মিত এ সিনেমার কাহিনী, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। প্রযোজনা করেছেন ফরিদুর রেজা সাগর ও পরিচালকের কন্যা এশা ইউসুফ।
ইতোপূর্বে নাসির উদ্দীন ইউসুফ নির্মাণ করেছেন ‘একাত্তরের যীশু’ ও ‘গেরিলা’। দুটি সিনেমার জন্যই তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। এ দুটি সিনেমার বিষয় ছিলো মুক্তিযুদ্ধ। তবে তৃতীয় সিনেমা ‘আলফা’র রয়েছে বিষয় ও শৈলীগত ভিন্নতা।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৪২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৯
এইচএমএস/এমজেএফ