ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

কুড়িগ্রামে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ে ৬ ডিসেম্বর

ফজলে ইলাহী স্বপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০২০
কুড়িগ্রামে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ে ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামের বিজয়স্তম্ভ ও বীর প্রতীক আব্দুল হাই সরকার। ছবি: বাংলানিউজ

কুড়িগ্রাম: একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কুড়িগ্রামকে হানাদার মুক্ত করতে বাংলার অকুতোভয় সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে পাক হানাদার বাহিনীকে। ৬ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সারাসরি আক্রমণ ও গেরিলা হামলায় টিকতে না পেরে পিছু হটে।

হানাদার  বাহিনী গুলি ছুড়তে ছুড়তে ট্রেনযোগে কুড়িগ্রাম শহর ছেড়ে রংপুরের দিকে চলে যায়।

৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম হানাদার মুক্ত দিবস। বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও এদেশের রাজাকারদের পরাজিত করে ৬ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত করে অবরুদ্ধ কুড়িগ্রামকে।

স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন:
এদিন পুরো কুড়িগ্রাম শত্রুমুক্ত হলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কুড়িগ্রাম নতুন শহরের ওভারহেট পানির ট্যাংকে প্রথম মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এদিন বিকেল সাড়ে ৩টায় ৬ নম্বর সাব সেক্টরের কোম্পানী কমান্ডার আব্দুল হাই সরকার বীর প্রতীক এর নেতৃত্বে ৩৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নতুন শহরের ওভারহেড পানির ট্যাংকের উপর স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।

খেতাবপ্রাপ্ত বীর যোদ্ধারা:
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য খেতাবপ্রাপ্তর তালিকায় রয়েছেন এই জেলার একজন বীর উত্তম, দুই জন বীরবিক্রম ও একজন নারীসহ চার জন বীরপ্রতীক। খেতাব প্রাপ্তরা হলো লে. আবু মঈন মো. আসফাকুস সামাদ বীর উত্তম (মরণোত্তর), শওকত আলী (বীর বিক্রম), সৈয়দ মনছুর আলী টুংকু (বীর বিক্রম), বদরুজ্জামান (বীর প্রতীক), আব্দুল হাই সরকার (বীর প্রতীক), আব্দুল আজিজ (বীর প্রতীক) এবং একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি (বীর প্রতীক)।

যেভাবে মুক্ত হলো কুড়িগ্রাম:
১৯৭১ সালের ৯ মার্চ কুড়িগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ কুড়িগ্রাম পুরাতন ডাকঘরের লিচুতলায় একটি জনসভায় মিলিত হয়। ১০ মার্চ জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রয়াত আহাম্মদ হোসেন সরকার ও আহাম্মদ আলী বকসীকে যুগ্ম আহবায়ক করে মহকুমা সংগ্রাম কমিটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৭ মার্চ স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতারা যৌথ উদ্যোগে কুড়িগ্রামের সবুজ পাড়ের শিশু পার্কে তৎকালীন ডিএসবি দারোগার ছেলে তুষার নামের একটি শিশুকে দিয়ে প্রথম বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয। এসময় উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, আমিনুল ইসলাম, রওশন বারী, রুকুনুদ্দৌলা মন্ডল প্রমুখ।

১৮ মার্চ তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ের উড্ডীয়মান পাকিস্তানি পতাকা পোড়াতে গিয়ে গ্রেফতার হন সৈয়দ মনসুর আলী টুংকু, জোবেদ আলী সরকার, আব্বাস আলী, সুজাম মিয়া ও খোকন ঘোষ। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সারাদেশের মতো কুড়িগ্রাম মহকুমার সব অফিস-আদালত ও বাসভবনে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেসময় কুড়িগ্রাম মহকুমা প্রশাসক মামুনুর রশীদ (সিএসপি), দ্বিতীয় কর্মকর্তা আব্দুল হালীম ও তৃতীয় কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

২৮ মার্চ কুড়িগ্রাম সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে স্থানীয় গওহর পার্ক মাঠের জনসমাবেশে আহাম্মদ আলী বকসী, অধ্যাপক হায়দার আলী, তাছাদ্দুক হোসেন, আমিনুল ইসলাম মন্ডল, আক্তারুজ্জামান মন্ডল, রওশনুল বারী, প্রফেসর হায়দার আলী, আব্দুস সামাদ, এটিএম আফজাল হোসেন দুলাল কে নিয়ে একটি বেসরকারী হাই কমান্ড গঠন করা হয়।

৩০ মার্চ রংপুরের ইপিআর উইংয়ের সহকর্মী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজেস উদ্দিন কুড়িগ্রামে আসেন। তার নির্দেশেই রংপুরের ইপিআর উইংয়ের অধিনস্থ অধিনায়ক নায়েক সুবেদার বোরহান উদ্দিন তাদের সহযোদ্ধা ইপিআরদের নিয়ে কুড়িগ্রামে আসেন এবং অবস্থান নেন।

৩১ মার্চ কুড়িগ্রামে সমবেত হয়ে এখানকার স্থানীয় পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র-জনতা এবং ইপিআরদের নিয়ে একটি সম্মিলিত বাহিনী গড়ে তোলা হয়। সেসময় আহম্মদ আলী বকসীর গোডাউনকে কন্ট্রোলরুম করে টোগরাইহাটের আওয়ামীলীগ নেতা আহম্মদ হোসেন সরকারের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হয়।

৫ এপ্রিল কুড়িগ্রাম শিশু পার্কের জনসভায় মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণ মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার আহ্বান জানালে শহর জনশুণ্য হয়ে পড়ে। এদিনই মুক্তিযোদ্ধাদের হেডকোর্য়াটার নাগেশ্বরীতে সরিয়ে নেওয়া হয়।

৭ এপ্রিল পাকবাহিনী সাঁজোয়া বহর নিয়ে লালমনিরহাট ও রংপুর থেকে একযোগে গুলিবর্ষণ করতে করতে বিকেলের দিকে কুড়িগ্রাম শহরে প্রবেশ করে গোলাবর্ষণ শুরু করে। এসময় কুড়িগ্রাম জেলখানার কর্তব্যরত ইনচার্জ ও চারজন সিপাহীকে পাকবাহিনী সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করলে সেখানেই শহীদ হন লাল মোহাম্মদ, আনসার আলী, সাজ্জাদ আলী ও জহির উদ্দিন।  

১৪ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পাক হানাদার বাহিনী কুড়িগ্রাম আক্রমণের চেষ্টা করে দখলে নিতে ব্যর্থ হয়। ১৫ এপ্রিল সকালে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে রেলপথ ধরে পাকবাহিনী তিস্তার দিকে পিছু হটে এবং রেললাইনের দু’ধারের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ২২ এপ্রিল ভোরবেলা প্রতিরক্ষার স্বার্থে মুক্তিযোদ্ধারা নাগেশ্বরীর রায়গঞ্জ ব্রিজটি ৩০০ গান কটন সেট করে উড়িয়ে দেয় এবং ধরলা নদীর পূর্বপাড়ে বিশাল এলাকা নিয়ে দৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলে। ২৭ মে একটি জীপ ও একটি ট্রাক ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ধরলা নদীর দিকে এগুলে পাকসেনাদের প্রচন্ড গোলাবর্ষণে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন ড্রইভর রব্বানীসহ ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা।

১লা আগস্ট রৌমারীর আলতাফ বাহিনী চিলমারী রেইড চালিয়ে পাকবাহিনীকে পরাজিত করে বালাবাড়ী পর্যন্ত দখলে নেয়। ৪ আগস্ট পাকবাহিনী নৌপথে তিনটি গানবোট ও দুটি লঞ্চ নিয়ে চিলমারী ঘাটে পৌঁছার পর নদীপথে রৌমারীর ছালিপাড়া ও কোদালকাটি দখল করলেও বাকি অংশ ছিল সম্পূর্ণ মুক্তাঞ্চল। ওই সেক্টরের আওতায় বীর প্রতীক তারামন বিবি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।

১লা আগস্ট সংঘটিত আন্ধারী ঝাড় অপারেশনে ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা এ্যামবুশ করে পাকবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ১১ জন সৈন্যকে হত্যা করে।  
৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বামনহাট যুব শিবির প্রধান অধ্যাপক আব্দুল ওহাব তালুকদার দুইজন সঙ্গীসহ শিংঝাড় এলাকায় পাকবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের শহীদ হন।

আগস্ট মাসব্যাপী মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনী এবং এদেশীয় দালাল দোসরদের বিরুদ্ধে গেরিলা কায়দায় সম্মুখ যুদ্ধ জোরদার করে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ১ আগস্ট চিলমারী ও আন্ধারী ঝাড় অপারেশন, ১৪ আগস্ট সোনাহাট ব্রিজে সম্মুখ যুদ্ধ, দুর্গাপুর অপারেশন, গাগলা অভিযান, পাঁচগাছিতে রাজাকার আটক অভিযান, রায়গঞ্জে অপারেশনসহ মুক্তিযোদ্ধাদের অসংখ্য আক্রমণের ঘটনা।

এসময় পাকবাহিনী কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থানে বাঙ্গালী নারীদের ধর্ষণ ও স্বাধীনতাকামী মানুষের নির্যাতন শিবির গড়ে তোলে। উলিপুরের হাতিয়া, কুড়িগ্রাম সদরের কাঁঠালবাড়ী ছিল পাকবাহিনীর নৃশংসতম গণহত্যা। ১৩ নভেম্বর উলিপুরের হাতিয়ায় নিরীহ ঘুমন্ত মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি করে, পুড়িয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে ৬৯৭ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে। ২০ নভেম্বর রাতে নাগেশ্বরীর রায়গঞ্জে সম্মুখ যুদ্ধ চলাকালীন লে. কর্ণেল আসফাকুস সামাদ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন এবং যুদ্ধ চলতে থাকে।

মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিগেডিয়ার জসির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ষষ্ঠ মাউন্টেন্ড ডিভিশনের সহযোগীতায় পাকবাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ১৪ নভেম্বর ভুরুঙ্গামারী, ২৮ নভেম্বর নাগেশ্বরী এবং ৩০ নভেম্বর গোটা উত্তর ধরলা হানাদার মুক্ত করে। ১লা ডিসেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী ধরলা নদী পাড়ি দিয়ে কুড়িগ্রাম শহরে অবস্থানরত পাকবাহিনীর উপর অব্যাহত গেরিলা হামলা চালানোর পাশাপাশি দুদিন চালানো হয় ভারতীয় বিমান হামলা।

৬ ডিসেম্বর বিকেলে ৩টার দিকে পাকবাহিনী গুলি করতে করতে ট্রেনযোগে কুড়িগ্রাম শহর ছেড়ে রংপুরের দিকে চলে গেলে শত্রুমুক্ত হয়। ওই দিনই কোম্পানী কমান্ডার আব্দুল হাই সরকারের নেতৃত্বে ৩৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল শহরে প্রবেশ করে বিকেল সাড়ে ৩টায় নতুন শহরস্থ ওভারহেড পানির ট্যাংকের উপর স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে।

যুদ্ধের সময়ে কোম্পানী কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল হাই সরকার, কেএম আকরাম হোসেন, সুবেদার মেজর আরব আলী, সুবেদার বোরহান উদ্দিন, সুবেদার মাজহারুল হক, সুবেদার আব্দুল ওয়াহাব, সুবেদার আলতাফ, বদরুজ্জামান, শওকত আলী, আব্দুল কুদ্দুস নান্নু, রওশন বারী রঞ্জু ও আবুল কাশেম চাঁদ।

কুড়িগ্রাম হানাদার মুক্ত দিবস পালন উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দলগুলো নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০২০
এফইএস/এইচএমএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।