ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

ঐতিহ্যবাহী জাহাজ ভাসানো উৎসবে সম্প্রীতির মিলনমেলা

সুনীল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২১
ঐতিহ্যবাহী জাহাজ ভাসানো উৎসবে সম্প্রীতির মিলনমেলা ছবি: বাংলানিউজ

কক্সবাজার: মহামতি বুদ্ধের জীবনের প্রতিটি  ঘটনা পূর্ণিমা কেন্দ্রিক। তার জন্ম, গৃহত্যাগ, বুদ্ধত্ব লাভ, মহাপরিনির্বাণ লাভ এবং প্রথম ধর্ম প্রচার সব ঘটনাই ঘটেছে পূর্নিমায়।

তাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান সব ধর্মীয় উৎসব হয় পূর্ণিমা কেন্দ্রিক।

সবকিছু মিলিয়ে বৌদ্ধদের কাছে পূর্ণিমার গুরুত্ব খুব বেশি। এমনই একটি পবিত্র দিন শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা। আষাঢ়ী থেকে আশ্বিনী পর্যন্ত  তিন মাস বর্ষাব্রত পালনের শেষ দিনটি হচ্ছে প্রবারণা পূর্ণিমা।

প্রবারণা মানে ভুল ত্রুটির নির্দেশ, আশার তৃপ্তি, অভিলাষ পূরণ ও ধ্যান শিক্ষা সমাপ্তি। সকল ভেদাভেদ ভুলে কলুষমুক্ত হওয়ার জন্য ভিক্ষুসংঘ পবিত্র সীমা ঘরে সম্মিলিত হয়ে একে অপরের নিকট দোষ স্বীকার করেন। নিজের দোষ স্বীকারের মধ্যে মহত্ত্বতা আছে, তা বৌদ্ধ ভিক্ষুরা দেখাতে সমর্থ হন।

মানুষ চেতন কিংবা অবচেতন মনে ভুল করতে পারে। সে ভুলকে দৃঢ়তার সঙ্গে স্বীকার করে সংশোধনের প্রচেষ্টায় সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াইতো জীবনের  স্বার্থকতা। কিন্তু ভুল স্বীকার করার মতো সৎ সাহস সবার থাকে না। আভিধানিক বিচারে প্রবারণার অর্থ হল বরণ করা আর বারণ করা। অর্থাৎ সকল প্রকার পাপকর্ম বর্জন করে পুণ্যকর্ম করার শিক্ষা প্রবারণা দিয়ে থাকে।

প্রবারণা পূর্ণিমার পরদিন থেকে শুরু হয় মাসব্যাপী কঠিন চীবর দান। এ তিন মাস বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নিরলসভাবে শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার অনুশীলন করেন। বর্ষাব্রত পালনের সময় (তিন মাস) প্রত্যেক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে এক জায়গায় বা বিহারে  অবস্থান করতে হয়। তিন মাসের মধ্যে বিশেষ কয়েকটি কারণ ছাড়া এক রাতের জন্যও নিজ নিজ বিহারের বাইরে থাকা যায়না। যদি কোন ভিক্ষু এ নিয়ম ভঙ্গ করেন তাহলে ওই ভিক্ষু কঠিন চীবর লাভ করতে পারেন না।

প্রবারণায় নদীতে ভাসানো হয় স্বর্গের জাহাজ-

তিনমাস বর্ষাবাস বা বর্ষাব্রত শেষে সারা দেশে নানা আনুষ্ঠানিকতায় প্রবারণা পূর্ণিমা পালন করা হলেও এ দিনটিকে ঘিরে কক্সবাজারের রামু উপজেলায় বাঁকখালী নদীতে আয়োজন করা হয় জাহাজ ভাসানো উৎসব।
আজ বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) রামুর বাঁকখালী নদীতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ উৎসব।  কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী, চকরিয়ার হারবাং ও খুরুশকুলের রাখাইনেরা ছোট্ট পরিসরে এ উৎসবের আয়োজন করে থাকে। তবে শত বছর ধরে একমাত্র রামুতেই বর্ণাঢ্য আয়োজনে জাহাজ ভাসানো উৎসব পালন করা হচ্ছে।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মতে, মহামতি বুদ্ধ রাজগৃহ থেকে বৈশালী যাওয়ার সময় নাগলোকের মহাঋদ্ধিমান (অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন) নাগেরা চিন্তা করলেন বুদ্ধপূজার এ দুর্লভ সুযোগ তারা হাত ছাড়া করবেন না। সঙ্গে সঙ্গে নাগলোকের পাঁচশত নাগরাজ বিমানের (জাহাজ) মত পাঁচশত ঋদ্ধিময় ফনা বুদ্ধপ্রমুখ পাঁচশত ভিক্ষুসংঘের মাথার উপর বিস্তার করল।
এভাবে নাগদের পূজা করতে দেখে দেবলোকের দেবতারা,  ব্রহ্মলোকের ব্রহ্মরা বুদ্ধকে পূজা করতে এসেছিলেন। সে দিন মানুষ, দেবতা, ব্রহ্মা, নাগ সবাই শ্বেতছত্র ধারণ করে ধর্মীয় ধবজা উড্ডয়ন করে বুদ্ধকে পূজা করেছিলেন। বুদ্ধ সে পূজা গ্রহণ করে পুনরায় রাজগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।

সে শুভ সন্ধিক্ষণ ছিল শুভ প্রবারণা দিবস। মূলত এ হৃদয়ছোঁয়া চিরভাস্বর স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য বাংলাদেশের বৌদ্ধরা বিশেষ করে রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায় প্রবারণা পূণিমায় র্বাঁকখালী নদীতে দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য খচিত স্বর্গের জাহাজ ভাসিয়ে প্রবারণা উদযাপন করেন।

বৌদ্ধপল্লীতে মাসজুড়ে আনন্দায়োজন-

জাহাজ ভাসানোর এ আয়োজনকে ঘিরে রামু উপজেলার প্রায় ত্রিশটি বৌদ্ধপল্লীতে প্রায় মাসব্যাপী চলে জাহাজ তৈরির আনন্দ যজ্ঞ। মূলত জাহাজ তৈরির টাকা সংগ্রহকে ঘিরে চলে এ আনন্দায়োজন। প্রায় একমাস প্রবারনা পূর্ণিমার দিনে এ জাহাজ বাঁকখালী নদীতে ভাসানো হয়। প্রায় শত বছর ধরে মহাসমারোহে এখানে এ উৎসব উদযাপন করা হচ্ছে।

বৌদ্ধরা জানান, এক সময় প্রতিদিন রাতের খাবার সেরে পাড়ার শিশু কিশোর ও যুবকেরা নিদিষ্ট স্থানে (যেখানে জাহাজ তৈরীর কাজ চলে) ঢোল, কাঁসর, মন্দিরা, বাঁশিসহ নানা বাদ্য বাজিয়ে চলে যেত জাহাজ তৈরীর টাকা সংগ্রহে। এ সময় নানা বাদ্যের তালে তালে সমস্বরে গাওয়া হয় বুদ্ধ-কীর্তন ‘শুকনো ডালে ফুল ফুটিল, স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এল, কে কে যাবি আয়রে, বুদ্ধের মত এমন দয়াল আর নাইরে’ অথবা অন্য কোনো গান।

কীর্তনের সঙ্গে সমান তালে চলে নাচও। এভাবে পাড়ার প্রতিটি  বাড়ি বাড়ি এবং নিজের পাড়া ছাড়িয়ে অন্য পাড়ায়ও চলে যান উৎসাহী এসব শিশু-কিশোরের দল। প্রবারণা পূর্ণিমার আগের দিন পর্যন্ত চলে টাকা সংগ্রহ ও জাহাজ তৈরির এ আনন্দ যজ্ঞ।
জাহাজ তৈরির জন্য অর্থ সংগ্রহে  গেলে পাড়া-পড়শিরা যার যার সাধ্যমত সহায়তা দেন। এ সময় কোনো বাড়িতে প্রত্যাশিত অর্থ (চাঁদা) না দিলে ওই বাড়ির ওঠানে  দীর্ঘক্ষণ নাচ, গান করে এর প্রতিবাদ জানানো হয়। দাবি পূরণ হলেই সাধু, সাধ, ধ্বনিতে নেচে গেয়ে ওই বাড়ি ত্যাগ করা হয়।

প্রতিদিন অনেক রাত পর্যন্ত চলতো এ আনন্দ আয়োজন। ঘুম দূর করতে জাহাজ তৈরির স্থানে বসানো হয় নাচ গানের আসর। থাকে চা-বিস্কিটের আয়োজন।

তবে এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় সে ঐতিহ্য অনেকটা হারাতে বসেছে বলে মন্তব্য করেন রামুর প্রবীণ ছড়াকার ও ধনীরাম বড়ুয়া। তিনি বলেন, দুই-চার বছর আগেও রাতের বেলায় কল্পজাহাজ তৈরি এবং পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে জাহাজের জন্য অর্থ সংগ্রহের আনন্দ ছিল আরেকটি উৎসবের মতো। কিন্তু দিন দিন আমরা সেই ঐতিহ্য হারাতে বসেছি। এখন শুধুমাত্র প্রবারণার এক-দুইদিন আগে ছাড়া রাতে জাহাজ বানানো বা চাঁদা তোলার সেই উৎসব মুখরতা খুব একটা দেখা যায়না।

রামুর শ্রীকুল, পূর্ব মেরংলোয়া, দ্বীপ শ্রীকুল, মেরংলোয়া, হাজারীকুলসহ বিভিন্ন বৌদ্ধ পল্লীতে এবারও তৈরি করা হয়েছে কল্প জাহাজ। বাঁশ, কাট, বেত, কাগজে রংয়ের কারুকাজ করে অভিজ্ঞ কারিগরেরা দৃষ্টিনন্দন এ কল্পজাহাজ তৈরি করেন। বার্মিজ ভাষায় কারিগরদের ‘ছেরা’ বলা হয়।

কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, রামুর বাঁকখালী নদীতে যুগ যুগ ধরে এ উৎসব হয়ে আসছে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি নদীতে চলে জাহাজ ভাসানোর আনন্দ। আর এ আনন্দে সামিল হন হাজারো বৌদ্ধ নরনারী। শুধু বৌদ্ধরা নন, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং পর্যটকদের অংশ গ্রহণে এ উৎসব এখন হয়ে ওঠে এক অসাম্প্রদায়িক মিলন মেলা।

তিনি আরও বলেন, আজ হতে প্রায় দুইশ বছর আগে মিয়ানমারের মুরহন ঘা নামক স্থানে একটি নদীতে মংরাজ ম্রাজংব্রান প্রথম জাহাজ ভাসানো উৎসবের আয়োজন করেন। সেখান থেকে বাংলাদেশের রামুতে এ উৎসবের প্রচলন হয়। সেই থেকে প্রায় শত বছর ধরে এ উৎসবকে ঘিরে রামুর বৌদ্ধ পল্লীগুলোতে এ আনন্দায়োজন চলছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২১
এসবি/জেডএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।