রাজশাহী: কয়েক শতাব্দী আগেই বিলুপ্ত হয়েছে রাজতন্ত্র। পৃথিবীর কোথাও এখন যেমন নেই রাজ্য, তেমন রাজাও নেই।
সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত গ্রামের সাধারণ মানুষের দরজায় গিয়ে শোনেন তাদের নানান সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা। কিন্তু সুখ-দুখের এই জীবন কাহিনীগুলো থেকে যায় অধরায়। সবার সমস্যা শুনে সহমর্মিতা জানানো ছাড়া যে, আর করার কিছুই নেই। কারণ তিনি সত্যিকারের সেই রাজা নন। বাস্তব জীবনে পেশায় তিনি একজন নৈশপ্রহরী। তারপরও গ্রামবাসী তাকে রাজা হিসেবে চেনেন।
আর এজন্যই হয়তো জীবনের নানান সমস্যার কথা তার সামনে তুলে ধরে নিজে হালকা হন এবং সম্ভাবনার পথ খোঁজেন। তবে সারাদিন রাজার বেশে ঘুরে বেড়ালেও দিনের আলো যখন নিভে যায় তখন তিনি আবারও ফিরে আসেন আপন বাস্তবতায়। নৈশপ্রহরীর পোশাক পরে বাঁশি বাজিয়ে ছোটেন গ্রামের পাশের বাজারে। সারারাত বাঁশি বাজিয়ে বাজার পাহারা দেন।
রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার চৌপুকুরিয়া গ্রামে বাস করেন এমনই শৌখিন এক রাজা। রাজা আব্দুল কাদের মোল্লা বয়স, এরই মধ্যে ৭০ এর কোটা পেরিয়েছে। বয়সের কারণে আগের মত আর লাফ দিয়ে ঘোড়ায় উঠতে পারেন না। তাই চেয়ার পেতে প্রতিদিন ঘোড়ায় চড়েন। ঘোড়া ছাড়া বাহিরে বের হন না। অর্ধ শতাব্দী ধরে তিনি অশ্বারোহী হয়ে ঘুরে বেড়ান। বাকি জীবনও এভাবে রাজার সাজপোশাকে ঘোড়ায় চড়েই ঘুরে বেড়াতে চান গ্রামে গ্রামে।
রাজ্য, ধন-সম্পদ কিছু না থাকলেও শখের বসে রাজার মত করে ৫০ বছর ধরে এভাবেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন আব্দুল কাদের মোল্লা। নিজে দারিদ্র্যতার কষাঘাতে জর্জরিত। এরপরও মনের মধ্যে একটা অসম্ভব সুন্দর রাজ্য বিনির্মাণ করেছেন। আর সেই রূপকথার রাজ্যে তিনিই রাজা, তিনিই অধিরা, তিনিই মহারাজ।
ছোটবেলায় এই চরম দারিদ্র্যের কারণেই লেখাপড়ার সুযোগও পাননি তিনি। ছেলে-মেয়েদেরও পড়াতে পারেন নি। বাড়ি-ঘরের অবস্থাও জরাজীর্ণ। ইটের দেয়ালের ওপরে কোনো রকমে টিনের ছাউনি দিয়ে রেখেছেন। তবে এই রাজ্যহীন মহারাজ তার জীর্ণ কুটিরটাকেই যেন একটা জাদুঘর বানিয়ে ফেলেছেন। তার ছোট্ট ঘরের বিবর্ণ দেয়ালে রয়েছে- সারি সারি পুরনো ঘোড়ার চাবুক, তলোয়ার, বেল্ট, ঘোড়ায় চড়া ছবিসহ নানা জিনিসপত্র।
তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে এই রাজার পরিবার। সবাই বাবার শখের প্রতি শতভাগ সমর্থন দেন। রাজা হিসেবে এই ৫০ বছরে ১৫টি ঘোড়া পাল্টিয়েছেন। বর্তমানে ১৬ নম্বর ঘোড়ায় চড়ে বের হন তিনি। তবে দীর্ঘদিন তলোয়ার নিয়ে ঘোরাফেরা পর এখন নতুন শখ একটি বন্দুকের। এটি তার ছেলেরা কিনে দিবেন বলেও জানিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান,গায়ে রাজার পোশাক, মাথায় বর্ণিল তাজ, তলোয়ারি হাতে, ঘোড়া নিয়ে রাজার বেশে যেভাবে ছুটে বেড়ান প্রথমে দেখে যে কারো মনে হতে পারে তিনি সত্যিকারের রাজা। গ্রামে এসে কেউ তার বাড়ির খোঁজ করলে রাজার বাড়ি হিসেবেই সবাইকে তার বাড়ি চিনিয়ে দেওয়া হয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল মজিদ বলেন, আমি দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এলাকায় মুদি দোকানের ব্যবসা করে আসছি। তখন থেকেই প্রতিদিন রাজার পোশাকে দোকানের সামনে দিয়ে যেতে দেখেছি। তিনি ধন-সম্পদের দিক থেকে না হলেও মনের দিক থেকে রাজা।
এ বিষয়ে কাদেরের ছোট ভাইয়ের বউ সুবেলা জানান, তাদের রাজা এমনিতে খুবই ভালো মনের হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। তবে রাগ একটু বেশি। রাজ্যের বিভিন্ন চিন্তা থাকায় হয়তো রাগ করেন! কারণ রাজা বলে কথা!
এমন চলাফেরা কারণ জানতে চাইলে কাদের মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, আমার কিছু না থাক তবুও রাজার মত করে চলাফেরা করতে খুব ভালো লাগে। তাই সামর্থ্য না থাকলেও নিজের শখের কোনো কমতি রাখিনি। কতদিনই আর বাঁচবো? বাকিটা জীবন এভাবেই হেসেখেলে বাঁচতে চাই।
রাজা হওয়ার অদ্ভুত শখের বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক আগে রূপবান নামের এক যাত্রাপালা দেখেছিলাম। সেখানের একটি দৃশ্যে জরির পোশাক আর তেজি ঘোড়া ছাড়া তাজেলকে স্কুলে যেতে দিচ্ছিল না। তখন বনরাজ উসমান বাদশার কাছ থেকে জরি পোশাক আর ঘোড়া এনে দিল। তখন পোশাক আর ঘোড়া আমার প্রচণ্ড ভালো লেগে যায়। সেই থেকে আমি চিন্তা করেছিলাম এভাবে আমিও ঘোরাফেরা করবো।
তারপর আর কী? যেই কথা সেই কাজ। এরপর থেকে আমি ধীরে ধীরে রাজার পোশাক ও নানান সাজ-সরঞ্জাম কিনে নেই। এরপর রাজা সেজে ঘুরতে থাকি গ্রামে গ্রামে। শুধু তাই নয় এক সময় আমার নিজস্ব একজন সেনাপতি ও উজিরও ছিলেন। তারা আমার বিভিন্ন হুকুম পালন করতেন এবং বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখাতেন। বর্তমানে তারা কেউ বেঁচে না থাকলেও ৫০ বছর থেকে এভাবেই চলাফেরা করছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২২
এসএস/কেএআর