ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

পরপুরুষ ।। আহমদ জসিম

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৪
পরপুরুষ ।। আহমদ জসিম

চৈত্রের ঝাঁঝালো রোদ, মামুনের বাপ বসে আছে এমন কাঁঠফাটা রোদেই! কিছুক্ষণ বসে থাকলেই শরীর কেমন জ্বালা করে, আবার রোদ থেকে উঠে গেলেও কেমন শীত-শীত লাগে! মাত্র ক’মাস আগেও দিব্যি কাজ-কর্ম করে বেড়িয়েছে যে মানুষটা, আজ সব ব্যাপারেই বউ-বেটির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সে মানুষ! রোদে শরীরটা জ্বলে উঠলে মামুনের বাপ ঠাঁহর করে দেখার চেষ্টা করে, সামনে কাউকে পেলে একটু ধ’রে ছায়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে। না, মামুনের বাপের চোখের সামনে সবকিছু কেমন ধোঁয়াটে কুয়াশার মতো, শুধু একটা আলোক রশ্মি চোখের সামনে নাচানাচি করে! শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ডাক দিলো, ‘কই গো মামুনের মা, আমারে কদ্দূর সরাও, রোইদে শরীর জ্বলি যাইতাছে!’ বান্ধবীদের সাথে কুতকুত খেলায় ব্যস্ত মামুনের ছোট বোন নাছিমা বিরক্ত হয়ে, ‘আবার কী হইলো, এমন চেঁচাও ক্যান; মা ঘরে নাই।

’ মামুনের বাপ শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘মাগি আবার গেল কই? বেড়া খুঁজতে নি!’ ‘মা সমিতির অফিসে গেছে কিস্তির টাকা আনতো। ’ নাছিমা এমন বললে মামুনের বাপ এবার তার কাছেই করুণ কণ্ঠে বললো, ‘মা-গো আমারে কদ্দুর ছেমাত নিয়া যা!’ নাছিমা দর্জ্জাল কণ্ঠে জানিয়ে দিলো, ‘পারুম না, খানিক পরে আবার কইবা— রোইদে নিয়া যাও, শীত করতাছে!’

মামুনের বাপ এবার একবারে কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠে, ‘মা-গো, আর কমুনা বাপরে অহন বাঁচা, রোইদতো না যেন ওয়াইল দজুকের আগুন!’ নাছিমা বিরক্ত হয়েও বাপের হাত ধরে তাকে ছায়ায় বসাতে নিয়ে আসে। কাজটা শেষ করেই নাছিমা আবারও ছুটে যায় কুতকুতের ঘরে। মামুনের বাপ দৃষ্টিহীন চোখে স্মৃতিতে বিভোর হয়ে পড়ে। সব আপন মানুষগুলোকেই কেমন যেন অনেক দূরের মনে হয় আজকাল! অথচ যখন দৃষ্টি ছিল, ছিল শরীরে শক্তি, না চাইতেই ছুটে আসতো স্ত্রী-কন্যা-পুত্র, মামুনের বাপের একেবারে ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে! দীর্ঘশ্বাস বাতাসে বিলীন হবার আগেই কানে বাজে কারো পায়ের শব্দ। মামুনের বাপ তার দুর্বল শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে, ‘কে-গো?’ কোনো উত্তর মিলে না! মামুনের বাপ আরো জোর দিয়ে একই প্রশ্ন, এবার উত্তর আসে গর্জনের মধ্যদিয়ে, ‘তুমি না বলে চোক্ষে দেহ না! কে আইলো এডা বুঝো ক্যামনে?’ মামুনের বাপ মুখে কিছু না বললেও মনে-মনে বলে, ‘বউরে তোরে কেমনে বুঝাই চোখ হারানোর পর কান অনেক বেশি সচল হইয়া গেছে, তোর ফিসফিসানি থেইকা শুরু কইরা লটর-পটর পর্যন্ত সবকিছুই চোখে না দেখলেও কানে ধরা পরে!’ মামুনের বাপ এবার আদর-মাখানো করুণ কণ্ঠে বলে, ‘টাকা পাইছো?’ মামুনের মা আগের মতই গর্জন করে, ‘হ,পাইছি’। ‘টাকাগুলান একটু সাবধানে রাইখো!’— মামুনের বাপ বলে। মামুনের মা এবার একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে, ‘ঘরে তো লোহার সিন্দুক আনছিলা, যে গুজায় রাখমু; হারাজীবন কামাইছো আর গিলছো অহন চোখ হারায় আমাগো কাঁধের উপর...! মামুনের বাপ এবার একেবারে চুপসে গেছে, তবে মনে-মনে বলছে, ‘হারাজীবন যা কামাই করছি সবেই তো তোমার হাতেই তুইল্যা দিছি, তুমি কী বাল করছো?’ মামুনের বাপ অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর আবারও স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে, ‘হ্যাঁ-গো, আমার চোখের অপারেশনের তারিখটা জানি কবে?’
‘কোরবানের পর। ’
‘কোরবানের আর কয়দিন যেন বাকি?’
‘তিন দিন। ’
মামুনের বাপ এবার ভিতরে-ভিতরে খুশিতে কেমন অস্থির হয়ে উঠলো, আবার একটু ভয়-ভয়ও লাগে! গেল বছর কোরবানের ঠিক আগে-আগেও সমিতি থেকে টাকা নেওয়া হয়েছিল তার চোখের ছানি কাটতে, কিন্তু সেই টাকা দিয়ে মামুনের মা অপারেশনের বদলে রঙ্গিন টেলিভিশন কিনে এনেছিল ঘরে, এবারও যদি...! না, আবার নিজেকে নিজে আশ্বস্ত করে মামুনের বাপ, ‘বউ আমার একটু বাংলা সিনেমা পাগল, সেবার লতিফের মা’র ঘরে টিভি দেখতে গিয়াইতো কাইজ্যাটা লাগলো! অহন তো সুযোগ পাইলেই ঘরে বইয়্যা ডিস দেহে আর ফ্যাঁত-ফ্যাঁত করি নাকের হিঙ্গিল ফেলি কাঁন্ধে!’ বউয়ের কান্নার কথা মনে হতেই রাগে মামুনের বাপের শরীরে কেমন কাঁপন ধ’রে, মনে-মনে ভৎর্সনা করে, ‘মাগি নায়কের দুঃখ দেইখ্যা চোখ লাল করছ! আমার লগে বিশ বছর সংসার করি তোর কোনো মায়া দেখলাম না, আমি আন্ধা হইছি আর তুই আলগা পিরিত করছ! আল্লার নাম নিয়া কোরবানের পরে অপারেশন করি খালি আমার চোখ ভালা হোক তোর আলগা পিরিতি আর ডিস কেমনে ছুডাই দেখবি! মামুনের বাপের এখন শুধুই সেই মহিন্দ্রক্ষণটির জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা।


মোবারক মিয়ার ফিস-ফিস কণ্ঠস্বরটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে মামুনের বাপ। তবুও মুখকে একেবারে কালিবর্ণ করে স্ত্রীকে জিজ্ঞাস করে, ‘ঘরে কে-গো আইলো কার কথা যেন হুনি?’ মামুনের মা দর্জ্জাল কণ্ঠে, ‘তুমি কানে একটু বেশিই হুনো! এত-রাইতো আবার আইবো কেডা?’ মামুনের বাপ এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘হ রে বউ আমি হগল কিছুই বুঝি আমারও চোখ গেল তোমারও ঠ্যাং চাইরটা হইলো!’ মামুনের বাপ ঘুমিয়ে গেছে ভেবেই মোবারক ঘরে ঢুকেছিল, তার কণ্ঠস্বর শুনে বিড়ালের মতো পা টিপে-টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে মোবারক মিয়া অনেক দূর চলে গেছে— কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াটা ঠিকই চলছে। আজ থেকে বছরখানেক আগে হলেও মামুনের বাপ এই আচরণের জবাব দিত তিনটা শব্দ উচ্চারণ করে— কিন্তু আজ সেই দিন নাই! তাই কণ্ঠের ক্ষীণ শক্তি দিয়ে মৌখিক প্রতিবাদ। কিন্তু মামুনের মা এসব থোড়াই খেয়ার করে! মোবারক হচ্ছে তার সেই মানুষের মতো— যাকে প্রায় প্রতিদিনেই টেলিভিশনে দেখা যায়— ভ্যান গাড়িতে করে একটা ফ্রিজ এনে বউকে বলে, ‘ও-গো বিয়ার পরে তো তোমাকে কিছুই দিতে পারিনাই তাই তোমার জন্য আনলাম...ফ্রিজ!  মামুনের বাপের এক সময় ক্ষীণ শক্তির দম ফুরিয়ে আসে, সব কিছুকেই নিয়তি মেনে ক্ষান্ত দেয়! অপেক্ষা করতে থাকে সেই দিনের জন্য— যে দিন চোখ অপারেশন করে আবারও তার আগের অবস্থা ফেরত পাবে; হাতুড়ি-কন্নি নিয়ে রাজমিস্ত্রিরির কাজে যাবে, দিন শেষে সাড়ে তিন শ টাকা মাইনে নিয়ে ঘরে আসবে, ‘সে দিন যদি আমি তোর স্যাটার বিষ না কমাইছি আমার নাম...!’ না, কথাটা মুখে আনে না, মনে-মনেই রাখে! রাত ফুরালেই কোরবান, কোরবানের দু’দিন পরেই তো...! কথাটা ভাবতেই মামুনের বাপের কেমন খুশি-খুশি লাগে।


দীর্ঘ দিন পর মামুন ঢাকা থেকে এসেছে। ঢাকার একটা গার্সেন্টসে চাকরি করে সে। ঈদের ছুটি আর বাপের অপারেশন মিলিয়ে এই যাত্রায় বেশ কিছুদিন থাকা হবে তার, মাংস কাটার কাজ নিয়েছে চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে; নাছিমাও বেরিয়ে গেছে ব্যাগ নিয়ে— তার অন্ধ বাবার সাথে মানুষের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে যা আনতে পারে! মামুনের মা গোসল করে নতুন শাড়ি পড়ে হাঁটাহাঁটি করছে— মোবারক মিয়া মাংস কাটা থেকে উঠে একবার মামুনের মা’র সাথে দেখা করে গেল। মামুনের মাকে দেখেই সে, ‘ভাবী তোমারে আইজ ফিলিম একটরের নায়িকার মতো লাগতাছে!’ মামুনের মা দ্রুত নিজের ঠোঁটের উপর আঙ্গুল বসিয়ে, ‘চুপ, মানুষ হুনবো!’ মোবারক আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত মামুনের মা’র পিছু-পিছু ঘরে ঢুকে গেল।   এই সুযোগে কিছুক্ষণ মলা-মলি, ডলা-ডলি করে নিল, একসময় সচকিত হয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়েও আসলো— কারণ মাংস কাটা ফেলে এসেছে। এ-ভাবেই ঈদের দিনটা কাটে। মানুষের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে হাড্ডি-মাংস মিলিয়ে বাপ-বেটি মিলে এনেছে প্রায় সের দশেক মাংস, অন্যের বাড়িতে মাংস কাটার কাজ করে মামুন এনেছে সের পাঁচেক। সারা দিন কাটা-কাটি আর রান্না-বান্নার কাজেই চলে গেছে। মামুনের বাপও মোটমুটি স্বস্তিতে আছে! কারণ যতদিন মামুন ঘরে থাকবে মোবারক মিয়ার ঘরের আশেপাশে ঘুর-ঘুর করা বন্ধ থাকবে।


অনেক দিন পর মামুনের বাপের কাছে আজ কেমন ঈদ-ঈদ লাগছে! ছেলেবেলায় ঠিক এভাবে ঈদের দিন সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে গোসল করে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে নামাজ পড়তে মসজিদে যেত। মসজিদ থেকে ফিরেই সেমাই খাওয়া! না, আজ ঈদ নয়। তবে ঈদের থেকেও বেশি, আজ তার চোখের ছানি কাটা হবে! সকালে শোয়া থেকে তুলে মামুন তার বাপকে গোসল করিয়ে ইস্ত্রিকরা পাঞ্জাবি-আর নতুন লুঙ্গি পরিয়ে দিয়েছে। মামুনের মা-ও নতুন কাপড়-চোপড় পরে নিয়েছে। হাসপাতালে যাবে তিনজন, ঘরে থাকবে শুধু নাছিমা। মামুনের মা মামুনকে সিএনজি’র জন্য পাঠিয়ে পানের বাটিটা খুঁজে নিল কয়েক খিলি পান বানিয়ে নিতে, হাসপাতালে পানের নেশা চাপলে আবার পাবে কোথায়? কিন্তু বাটা খুলে দেখে জর্দ্দা নাই। নাছিমাকে ডাক দিল, নাছিমা ছুটে এসে, ‘আমাররে ডাকতাছো মা?’ ‘হ-রে যা-তো, তোর সবুরের মা খালার ঘর থেইকা আমার লাইগ্যা কদ্দুর জর্দ্দা নিয়া আই তো। ’ নাছিমা সাথে-সাথে দৌড় দিলো। বেশ কিছু সময় পর নাছিমা কাগজে মোড়ানো কিছু জর্দ্দা নিয়ে হাজির হয়ে, ‘মা-খালা জানি তোমারে নিয়া কী কইতে আছিল,  আমারে দেইখ্যা কথা বন্ধ করি দিছে!’ মামুনের মা একখিলি পান মুখে দিতে গিয়েও আবার নামিয়ে এনে চোখ বড়-বড় করে, ‘কী কইলি, কী কইতে আছিল?’ নাছিমা এবার আমতা-আমতা করে, ‘তোমারে আর মোবারক কাকারে নিয়া— তুমি নাকি মোবারক কাকার লগে...!’

কথাটা মেয়ের মুখ থেকে বেরুবার সঙ্গে-সঙ্গেই মামুনের মা পানের খিলিটা মাটিতে আছাড় দিয়ে ফেলে, ‘আমার কোন মাগি, আমার কোন হোতিনের ঘরের হতিন আমারে নিয়া গিবত করে! ওগো যদি এতই বেড়া ধরনের হাওস থাকে আমারে কইলেই তো পারে আমি একটা ধরাই দিতাম। ’ মামুনের মা’র উচ্চস্বরের খিস্তি-খেউড় অনায়েসে সবুরের মা’র ঘর পর্যন্ত পৌঁছে যায়, সঙ্গে-সঙ্গেই প্রতি উত্তর আসে সবুরের মা’র ঘর থেকে, ‘নিজে মাগি অন্যেরে মাগি কছ, আন্ধা বেডা ঘরে তুইয়্যা আলগা বেডারে চোদা খাওয়াচ!’ সবুরের মা বললে। ‘তোর কা এত হিংসা লাগে মনে চাইলে তুইও আমার লগে আয়, তোরেও একটা বেডা ধরাই দিমু,’ মামুনের মা বললো। ‘মাগি কয় কী! মনে লয় আমিও হের মতো মাগি, আমার ফ্রিজে জিনিস তুইতে আর আহিস; ঝাটা দিয়া পিটায় ঘর থেইকা বাহির করুম’— সবুরের মা বললো। ‘তোর ঘরে আমার সোনাডা যাই, তোর ফ্রিজে আমি মুতি’— মামুনের মা বললো। ‘দেহা যাইবো!’ সবুরের মা বললো। এই আকস্মিক ঘটনায় মামুনের বাপ খেই হারিয়ে ফেলেছে! স্ত্রীকে কী বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। মামুন সিএনজি নিয়ে বাপকে নিতে এসে এই ঘটনার মুখোমুখি! মামুন বার কয়েক তার মাকে থামানোর চেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো তখনই গর্জন করে বললো, ‘তুমি তাইলে কাইজ্জ্যা কর আমি সিএনজি বিদায় দিতাছি!’

মামুনের মা’র এতক্ষণে যেন হুঁশ ফিরে এলো, ছেলের দিকে চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে, ‘খাড়া’ বলে দ্রুত বোরকা আর ভাঙ্গা ট্রাঙ্ক থেকে সমিতি থেকে তুলে-আনা বিশহাজার টাকা শাড়ির আঁচলে গুঁজে নিয়ে, ‘আই আমার লগে!’ মামুন তার মা’র দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে, ‘আই মানে! বাবারে নিমু না ?’ মামুনের মা আগের মতই গর্জন করে, ‘রাখ তোর বাবা! আমাগো ইজ্জত বাড়ছে না তোর বাপের অপারেশন বাড়ছে? মাগি কথায়-কথায় ফ্রিজের খোঁটা দেয়, আইজ একটা ফ্রিজ কিন্যা দেহায়া দিমু হে কত্তবড় ফ্রিজওয়ালা হয়ছে!’ কথাগুলো বলেই মামুনের মা ঘর থেকে হন-হন করে বেরিয়ে গেল। সাথে-সাথে মামুনও, প্রচণ্ড ঝড়ের পর শান্ত হয়ে আশা প্রকৃতির মতোই এই মুহূর্তের মধ্য পুরো বাড়ির অবস্থা! মামুনের বাপকে মামুন নতুন জামা-কাপড় পরিয়ে যেভাবে বসিয়ে গেছে ঠিক সেভাবেই সে বসে আছে। নাছিমা বসে আছে ঘরের সেই ভাঙ্গা চৌকির উপর। এভাবেই নীরবতার মাঝেই অতিক্রম হয়ে গেল ঘণ্টা দেড়েক সময়। এক সময় টিন-টিন ব্যাল বাজতে-বাজতে ঘরের সামনে একটা রিকশা ভ্যান থামে! রিকশা ভ্যানের সাথে-সাথেই আছে মামুনের মা আর মামুন। ভ্যানের উপর বিশাল একটা বাকশো, সেই বাকশোর ভিতরেই আছে মামুনের মা’র স্বপ্নের শীতলযন্ত্র!

‘সাবধানে নামাও নতুন ফ্রিজ আবার আঁচড় খাইবো। ’ মামুনের মা কথাগুলো বেশ উচ্চ শব্দে বললো— যেন আশপাশের লোকজন শুনতে পায়! আশপাশের লোকজন শুনেছে কি শোনে নাই, নাছিমা ঠিকই শুনেছে। মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে ঘর থেকে ছুটে এসে, ‘আঙ্গো ফ্রিজ আছে গো; আঙ্গো ফ্রিজ আছে গো’ বলে আনন্দে লাফাতে শুরু করলো! ফ্রিজটা ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে বাকশো থেকে খোলার পর মামুনের মা হাত বুলিয়ে-বুলিয়ে মন ভরে দেখছে। এভাবে বেশ কিছু সময় ধরে দেখার পর নাছিমাকে বললে, ‘যা বাড়ির হগলরে খবর দিয়া আয় আঙ্গো নতুন ফ্রিজ আছে। ’ নাছিমা ওমনি ছুটে যাচ্ছিল; মামুনের মা আবারও পিছন থেকে ডাক দিয়ে, ‘ফ্রিজের কথা কেমনে কইবি?’ নাছিমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, ‘কমু আঙ্গো ফ্রিজ আছে গো!’ মামুনের মা দ্রুত আপত্তি করে, ‘না-না, তোর বান্ধবীগোরে কবি ঠাণ্ডা পানি খাইতে মন চাইলে আঙ্গো ঘরে যেন আইয়ে। ’ নাছিমা, ‘ঠিক আছে’ বলেই দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ঘরের ডামা-ঢোল শেষ করে মামুনের মা নতুন ফ্রিজের চাবিটা শাড়ির আঁচলের সাথে বেঁধে রাস্তায় হাঁটতে বেরুলো, উদ্দেশ্য কারো সাথে দেখা হলেই ফ্রিজ কেনার গল্পটা শুনিয়ে দিবে, বারকয়েক হাঁটাহাঁটির পরও তেমন কার সাথে আলাপের সুযোগ এলো না। শুধু একবার সবুরের মা উঁকি দিয়ে দেখে আবারও দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এভাবে হাঁটতে-হাঁটতে মামুনের মা এক সময় ভাবনায় বিভোর হয়ে গেল, এই বিভোরতার মাঝেই হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ালো মোবারক— মোবারকের হঠাৎ ভাবী ডাক শুনেই চমকে উঠে দ্রুত বুকে একদলা থুথু ছিটালো! তারপর মামুনের মা কিছু বলার  আগেই মোবারক বলে উঠলো, ‘ভাবী তুমি হাঁটি-হাঁটি কী ভাবতাছো আমি কইতে পারি, ভাবতাছো নতুন ফ্রিজের লগে মামুনের বাপ একদম বেমানান; যদি ফ্রিজের মতো একটা নতুন মামুনের বাপ বাজার থেইকা আনন যায়তো...!’ লজ্জায় লাল হয়ে উঠে দ্রুত শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ঘরের দিকে দৌড় দিল মামুনের মা।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ