ঝিনুক নীরবে সহো
ব্রেনেন মারা গেছে প্রায় তিন সপ্তাহ আজ। আজকে ওর ফিউনারাল ছিল, শেষ চলে যাওয়া।
ব্রেনেন আমার কলিগ ছিল, ঘনিষ্ঠ ছিল। ও চাকরি বদল করার পর ওর সাথে শেষের দিকে যোগাযোগটা হয়ে উঠেছিল ক্যাজুয়াল। তেমন কেউ নেই ওর, তেমন আপন কেউ। এক হাফ-ব্রাদার আছে, কুইন্সল্যান্ডে থাকে, কাজের চাপে সবদিক সামলাতে পারেনি বলে আসেনি ফিউনারালে। আর থাকার মধ্যে ছিল, ওর চেয়ে বয়সে একটু বড়, ওর গার্লফ্রেন্ড ক্যাথি।
ক্যাথি আর ব্রেনেন থাকত সিডনিতে। ব্রেনেনের মৃত্যুর পর ক্যাথি ফিরে গেছে শেল্-হারবারে, ওর শৈশবের শহরে, সিডনি থেকে ১০৫ কিলোমিটার দূরে। আজ সেমেট্রিতে ক্যাথি বলছিল, আসবার সময় ও ট্রেনে এসেছে। আমি বলেছিলাম, ‘সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব শেল্-হারবার। ’
ব্রেনেনের ফিউনারালের সমস্ত ব্যবস্থা ক্যাথিই করেছে। ফিউনারালের খরচের অংশেরটুকু বাদ দিয়ে সুপারঅ্যান্যিউয়েশনের বড় অংকের টাকাটা ক্যাথিই পেয়েছে।
সচ্ছলতার কারণে বা ফিউনারালের খরচ কমানোর জন্য, এরা কখনো কখনো মৃতকে সমাধিস্থ করে না, পুড়িয়ে ফেলে। ব্রেনেনের সময়েও ক্যাথি এমনই ভেবেছে। আমার কাছে জানতেও চেয়েছে, ঠিক আছে না?... আর, শেষ চলে যাওয়ার সময় আমরা কেউই ব্রেনেনকে শেষ দেখা দেখিনি, দেখার মতো কিছু ছিল না। ওর সমস্ত অরগান, টিস্যু অন্য মানুষের জন্যে রেখে গেছে। আজকেই জানলাম, দু’বছর ধরে অপেক্ষায় থাকা কুইন্সল্যান্ডের একজনকে ওর কিডনি দেয়া হয়ে গেছে।
সবকিছু সম্পন্ন হতে হতে বিকেল গড়িয়ে গেল। শেল্-হারবার পৌঁছালাম যখন, রাতের পৌনে-এগারোটা ঘড়িতে।
ক্যাথি বলল, ‘তুমি চাইলে থেকে যেতে পারো আজকের রাতটা। ’
ক্যাথিকে বললাম, ‘না ক্যাথি, আমি যাই। রাত দেড়টা-দু’টা নাগাদ সিডনি পৌঁছে যাব। ’ মনে মনে বললাম, অনেক হয়েছে ব্রেনেন, এইবার প্রগাঢ়ভাবে ঘুমাও।
আব্দুল মতিন
ভদ্রলোকের নাম আব্বাসউদ্দিন আহমদ। এই দেশে স্ত্রীসহ বেড়াতে এসে থেকে গেছেন। এটা আশির দশকের গোড়ার কথা। একমাসের বেড়ানোর ভিসা শেষ হয়ে গেলে অনেক লুকিয়ে-পালিয়ে বেড়িয়েছেন। আব্বাসউদ্দিন সাহেবের এক বাঙালি বন্ধুর নামে বাসা ভাড়া নিয়ে, ওই বাসায় স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। দায়ের ভার ছিল, বন্ধুর কাছে ছোট হয়ে থাকতেন। এখনো থাকেন। ডিপার্টমেন্ট অব ইমিগ্রেশনকে আজরাইলের মতো ভয় পেতেন তিনি। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। এক ঝলমলে দিনে ইমিগ্রেশন পুলিশ আব্বাসউদ্দিন সাহেবকে ধরে নিয়ে গেল কাজের জায়গা থেকে। নিয়ে গেল ডিটেনশন সেন্টারে। উনার স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। পরেরদিন বাসা থেকে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের স্ত্রী, তাহমিনাকেও ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে আসা হলো। কমবেশি একমাস কারাবাসের পর বাঙালি ওই বন্ধু আর এক অবাঙালি ইমিগ্রেশন উকিলে মিলে আব্বাসউদ্দিন আহমদকে বিপদমুক্ত করেছেন। এই দেশটা এখন আব্বাসউদ্দিন সাহেবেরও।
সেই থেকে আব্বাসউদ্দিন আহমদ মনে করেন, অস্ট্রেলিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব আর একজন ইমিগ্রেশনের অফিসারের দায়িত্ব সমান। সমান ক্ষমতায়, সমান সন্মানের। তিনি অনেক লেগে থেকে, শেষে ডিপার্টমেন্ট অব ইমিগ্রেশানে জায়গা করে নিয়েছেন। দু’বছরের মাথায় সিডনি এয়ারপোর্টে বদলি হয়ে এসেছেন।
কাজের সময় যখন কাজে চাপ হালকা থাকে, তিনি বেসুরো গলায় গুনগুন করে গান ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে...’, আশেপাশে ঈদ থাকুক আর নাই থাকুক। এয়ারপোর্টে পোস্টিং এবং কাজী নজরুল ইসলাম যারপরনাই প্রিয় আব্বাসউদ্দিন সাহেবের। আর প্রিয় হলেন কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমদ। আব্বাসউদ্দিন আহমদ ছিলেন প্রথম মুসলমান গায়ক যিনি আসল নাম ব্যবহার করে এইচ.এম.ভি থেকে গানের রেকর্ড বের করতেন, এই তথ্যটি জেনেছেন ছোটবেলায়, বাবার কাছে। আদর করে বাবা ছেলের নাম রেখেছিলেন আব্বাসউদ্দিন আহমদ। অনেক তৃপ্তি বোধ করেন তিনি এই নামে।
সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের সকালের ফ্লাইটের যাত্রীরা ইমিগ্রেশন করছে। আব্বাসউদ্দিন সাহেবের মনটা আজ ফুরফুরে। আরো মন ভালো করে দিল এক ব্রিটিশ পর্যটক। সবকিছু সেরে যাবার সময় আব্বাসউদ্দিন সাহেবকে ‘থ্যাঙ্কয়্যু অফিসার’ বলে গেছে। কয়েকজন যাত্রীর পর গোবেচারা টাইপের একজন, বাংলাদেশী একটা পাসপোর্ট এগিয়ে দিলেন। ছেলেটার চোখে অপার ভয়, কান্না কান্না মুখ। আব্বাসউদ্দিন সাহেব পাসপোর্ট না খুলেই গম্ভীর হয়ে আপনি-তুমি সম্বোধন ছাড়াই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী নাম?’
সন্ত্রস্ত গলায় ছেলেটি বলল, ‘আব্দুল মতিন। ’
আব্বাসউদ্দিন সাহেব আচমকাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কোমল করে জানতে চাইলেন, ‘ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন কি আপনার কেউ হন?’
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৫ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১৬
টিকে/