এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা।
বড়ভাই একটি বেসরকারি টিভির সাংবাদিক কাম সংবাদ উপস্থাপক।
কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেই বললেন, আর বলো না। ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে বড় বিপদে আছি ভাই।
ছোট বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে একটু-আধটু সমস্যা তো হয়ই।
আরে সেই সমস্যা না। অন্য টাইপ সমস্যা।
অন্য টাইপ সমস্যা। সেটা কী রকম?
বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে মানুষজন নানা সমস্যার মধ্যে থাকে। কারও বাচ্চা দুষ্ট। কারোটা দুরন্ত। কারও কারোটাকে নিয়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাওয়া যায় না। জিনিসপত্র ভাঙে নয়তো নিয়ে আসার বায়না ধরে।
এর বাইরে বাচ্চারা আর কিইবা সমস্যা করে?
করে। আমার বাচ্চার সমস্যা হলো অদ্ভুত সমস্যা। সে ঘুমানোর আগে প্রতিদিন গল্প শুনতে চায়। গল্প না বললে তার দুই চোখের পাতা এক হয় না।
এ যুগের বাচ্চা গল্প শুনতে চায়। বলেন কী! অবাক হলাম।
পুরোটা বললে আরও অবাক হবে। আমার জন্য মায়াও হবে তখন।
আমিতো এটুকু শুনেই বেশ অবাক। খুব ভালো অভ্যাস আপনার বাচ্চার। এ যুগে এরকমটা দেখা যায় না।
হুমম। ভালোটা কিছুদিন আগ পর্যন্ত ছিলো। গল্প শোনানোর দায়িত্বটা ছিলো তোমার ভাবির কাঁধে। সে বাচ্চাকে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতো। আমার দায়িত্ব ছিলো মশারি টানানো। তারপর নাক ডেকে ঘুম।
তো এখন কি ভাবি বাচ্চাকে গল্প শোনায় না?
উল্টোটা। ইদানিং বাচ্চাই তার মায়ের গল্প আর শুনতে চায় না।
মায়ের গল্প শুনতে চায় না? কেন?
বাচ্চা তার মায়ের মুখের ওপর বলে দিয়েছে, মাম্মি পচা। মাম্মির গল্পে শুধু রিপিটেশান।
রিপিটেশান?
হুমম। অবশ্য বাচ্চাকে দোষ দিয়ে কী হবে। সে তো মিথ্যে কিছু বলেনি।
বড়ভাই লম্বা গোছের একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। সেই বাতাসে টেবিলে রাখা পেপারের পাতা ওড়ে।
আমি বড় ভাইয়ের দিকে সহানুভূতি নিয়ে ঝুঁকে পড়ি।
বলেন তো ভাই কেস কী?
আরে কথায় বলে না, মোল্লার দূর মসজিদ পর্যন্ত।
হুমম। বলে তো। আজকেও আমি একজনকে বলেছি।
তোমার ভাবির দৌড় হচ্ছে হিন্দি সিরিয়াল পর্যন্ত। হিন্দি সিরিয়ালের গল্প ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো গল্প তার জানা নেই। এতোদিন বাচ্চার মা সন্ধ্যায় যে সিরিয়াল দেখতো রাতে বাচ্চাকে সেই গল্প শোনাতো। একটু এদিক-ওদিক করে।
বাহ। বুদ্ধিতো ভাবি খারাপ বের করেনি। হিন্দি সিরিয়ালের একটা ভালো দিক অন্তত পাওয়া গেলো।
হুমম। কিছুদিন ভালোই ছিলো। কিন্তু ইদানিং বাচ্চা তার মায়ের গল্প আর শুনতেই চায় না। বলে, নাথিং নিউ। মাম্মি তুমি এক গল্প প্রতিদিন বলো কেন? হোয়াটস রং?
হা হা হা। বলেন কী! সিরিয়ালের ফাঁক বাচ্চাও ধরে ফেলেছে?
হুমম।
আমার কথায় এবার বড়ভাইও হাসেন।
বাচ্চা ধরে ফেলেছে ঠিকই। কিন্তু বাচ্চার মা এখনও ধরতে পারেনি। পাজি ছেলে কোথাকার বলে উল্টো বাচ্চাকেই আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে।
আপনার ছেলে তো দেখি অনেক বুদ্ধিমান।
এই বুদ্ধিমান পোলা নিয়েই তো পড়েছি বিপদে। এখন সে ভর করেছে আমার ওপর। প্রতিদিন তাকে নতুন নতুন গল্প শোনাতে হয়। আরে বাবা আমি তো ভাই গল্প বলা দাদু না। এতো গল্প কোথায় পাবো। গল্পের স্টক যা ছিলো সব শেষ। আর বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলবো সে উপায়ও নেই। ছেলে হাতেনাতে ধরে ফেলে।
তাহলে তো আসলেই সমস্যা।
তবে আর বলছি কী। নিউজ ফেলে অফিসে বসে প্রতিদিন ছেলের জন্য জনে জনে গল্প খুঁজে বেড়াই। আজব একটা দেশ। কারও কাছে কোনো গল্প নেই। ওদিকে আমার তো প্রতিদিন অন্তত একটা নতুন গল্প চাই।
গল্পের সঙ্কটকে জাতীয় সঙ্কটে রূপ দিয়ে বড়ভাই আবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
তার একটা কথা মাথার মধ্যে ঢুকে যায়। আমাদের কারও কাছে কোনো গল্প নেই।
ভেবে দেখলাম, ঘটনা তো সত্য। দিন দিন আমরা কেমন যেনো গল্পহীন হয়ে পড়ছি। আমাদের জীবনে ঝগড়া-মারামারি, দাঙ্গা-ফ্যাসাদ রয়েছে। স্বার্থের হানাহানি, উপরে ওঠার ইঁদুর দৌড়, সব রয়েছে। কিন্তু গল্পের বড় অভাব। নাটক-সিনেমা প্রচুর হচ্ছে। তাতেও গল্প খুব একটা থাকে না। থাকবে কী করে? গল্প তো জীবন থেকেই আসে। আমাদের শূন্যতা তো আসল জায়গায়।
এবার আমি ঝিম মারি।
বড়ভাই আমার দিকে তাকান।
তুমি ঝিম ধরলে কেন? গল্প দেওয়ার ভয়ে?
ভাই, গল্প দিতে না পারলেও একটা উপায় মাথায় আসছে। ট্রাই করে দেখতে পারেন।
কী?
টেবিল ছেড়ে বড়ভাই এবার আমার দিকে ঝুঁকে পড়েন।
আপনার বাচ্চাকে সংবাদের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন।
মানে?
গল্পের যেহেতু অভাব তাই গল্পের বদলে ছেলেকে সংবাদমুখী করেন। তাছাড়া সংবাদও তো এক ধরনের সাহিত্য। লিটারেচার ইন হারি।
তাতে কী লাভ?
লাভ দু’টো। এক, ঘুমুতে যাওয়ার আগে তখন ছেলে আপনার কাছে গল্পের বদলে সংবাদ শুনতে চাইবে। আপনি সাংবাদিক মানুষ। সব সংবাদ তো জানাই। শুনিয়ে দেবেন প্রতিদিনের সংবাদ শিরোনাম।
আর দ্বিতীয় লাভ হচ্ছে, গল্প বানানোর মতো সংবাদ বানানোর ঝামেলা নাই।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৩ ঘণ্টা, জুন ০৬, ২০১৬
এসএনএস