ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

অনুভূতি | যুথিকা বড়ূয়া (পর্ব-১)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৬
অনুভূতি | যুথিকা বড়ূয়া (পর্ব-১)

অনুভূতি
এক.
ক’দিন ধরেই সুপ্রিয়র দৃষ্টিগোচর হয়, ওদের পাশের ফ্ল্যাটে নতুন লোক এসেছে। রাত পোহালেই হৈ-হুল্লোড়, হা হা হি হি শব্দ।

সেই সঙ্গে হাই-ভলিওমে চলতে থাকে টিভি, রেডিও কিংবা রেকর্ড প্লেয়ার। শব্দ দূষণে কানে একেবারে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম। তন্মধ্যে বদ্ধ জানালার কপাট ভেদ করে ভেসে আসে কথাকলির গুঞ্জরণ। সারাদিন স্কুলের বাচ্চাদের পড়িয়ে বিকেলে বাড়িতে এসে দু’দণ্ড শান্তিতে নিরিবিলিতে বসে একটু  নিঃশ্বাস নেবে, তাও উপায় নেই। মনে হয় যেন হাট বসেছে। কেমন মানুষ এরা! রুচিবোধও কি এদের নেই!
 
সুপ্রিয় মনস্থির করে, এর একটা বিহিত করা দরকার। এটা ভদ্রলোকের পাড়া। হাই সোসাইটি। এখানকার প্রত্যেকেই সুশিক্ষিত, রুচিশীল, হায়ার এডুকেটেড। ওদের অবগত হওয়া উচিৎ, এখানে কিছু রুলস আছে। এ ধরনের বেলেল্লাপনা এ পাড়ায় নিষিদ্ধ। খুবই শ্রুতিকটূ, গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ ঐ একই ফ্ল্যাটে সান্ধ্যকালীন পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক অভাবনীয় বৈপরীত্য। আনথিঙ্কেবল! ভাবাই যায় না। একাগ্রে শুদ্ধচিত্তে মত্ত হয়ে ওঠে আধ্যাত্মিক সাধনায়। বেজে ওঠে শঙ্খ-কাঁসার ধ্বনি। চলে একটানা পুঁথি পাঠ, রামায়ণ পাঠ। নিজের কান দু’টোকে কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। সুরভিত ধূপধুনোর গন্ধে ছেয়ে যায় ফ্ল্যাটের চারদিক। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে দেহ-মন, সারাশরীর। ভুলিয়ে দেয় অন্তর্কলহ। অপসারিত হয়, বিক্ষিপ্ত মন-মানসিকতা। আরো কত কি!
 
সাময়িক আনন্দ-কোলাহলের সংমিশ্রণে এক অন্যতম আকর্ষণে একরকম অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল সুপ্রিয়। আজও পড়ন্ত বিকেলে ক্লান্ত সূর্য অস্তাচলে ঢলে পড়তেই অপেক্ষা করেছিল, কখন সন্ধ্যে নামবে, দেবদেবীর আরাধনায় বেজে উঠবে শঙ্খ-কাঁসার ধ্বনি। তন্মধ্যে লোডশেডিং। ঘর্মসিক্ত শরীর নিয়ে বড্ড অস্বস্তিবোধ করছিল। কিন্তু কি আশ্চর্য, আজ পাশের ফ্ল্যাটে কোনো সাড়া শব্দই নেই! লোকজন সব গেল কোথায়!

মনে মনে বিড় বিড় করতে করতে সুপ্রিয় ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। পরিষ্কার নীল আকাশ। ঝুরুঝুরু মৃদু শীতল বাতাসে বইছে বসন্তের ছোঁয়া। সুপবনও আমোদিত হয়ে আছে বাগিচার রংবেরঙের ফুলের মধুর সৌরভে। ক্রমশ শীতল হয়ে আসে শরীর আর মন। ততক্ষণে দিগন্তের প্রান্তরে সন্ধ্যে ঢলে পড়েছে। চারদিক ক্ষীণ আবছা অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছে। পশ্চিমাকাশের কোণে বিস্তৃত চন্দ্রকিরণে সমগ্র পুষ্পবাগিচা অপরূপভাবে আলোকিত হয়ে আছে। দারুণ লাগছিল সুপ্রিয়র। সতেজ সজীবতায় মন-প্রাণ ওর চাঙ্গা হয়ে ওঠে। হঠাৎ বিজলিবাতি জ্বলে উঠতেই নজরে পড়ে, পাশের ফ্ল্যাটে খানিকটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। গ্লাসের জানালা। সাদা নেটের পর্দায় ঢাকা। ভিতরে লোকজন ভর্তি। ঘরের মধ্যেখানে সুদর্শন ঝাড়বাতির চমকিত আলোর রিফ্লেকশনে প্রত্যেকের মুভমেন্ট সুস্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বাইরে ব্যালকনিতেও কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। তার অঙ্গ-ভঙ্গিমায় অনুমেয় হয়, কোনো মহিলাই হবে। যাদের প্রতি সুপ্রিয়র কোনো আগ্রহ নেই, উৎসাহ নেই। অথচ অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওর অবাধ্য চোখের দৃষ্টিটা বার বার সেদিকেই নিক্ষেপ করছে। তার পরক্ষণেই দ্যাখে, মাথায় টুপি পড়া পাতলা লম্বা পুরুষালি চেহারার একজন এসে উক্তপ্ত মেজাজে কী কী সব বলছে। মাঝেমধ্যে ওদের কনভারসেশন বাতাসে ভেসে আসছে। ইন্টারেস্টি!
 
হঠাৎ কৌতূহল জেগে ওঠে সুপ্রিয়র। আড়ি পেতে শোনবার চেষ্টা করে। ভেসে আসে পুরুষ কণ্ঠস্বর। - আমায় অ্যাভয়েড করে চলে এলে কেন অলকা?
 গম্ভীর হয়ে মহিলাটি বলল, অ্যাভয়েড নয়, একটা কথা ছিল, সবার সম্মুখে বলতে পারিনি, তাই বাইরে চলে এলাম!

লোকটি বলল, তা ভয়ে না লজ্জায়!
বড় বড় বিষণ্ণ চোখ মেলে মহিলাটি বলল, তোমার এখানে আসা ঠিক হয়নি প্রশান্ত!

- কেন? আমাদের সম্পর্কের কথা কারো তো অজানা নয়! সবাই জানে!
- হ্যাঁ, তা জানে বৈকি! কিন্তু একটু সংযত হয়ে চলা উচিৎ ছিল তোমার!
- মানে! আমি কী এমন অপরাধ করলাম!
- কী অপরাধ করেছ ? মিলিকে নিয়ে তোমার এতো কিসের বাড়াবাড়ি? আদিখ্যেতার মতো সারাক্ষণ ওর গায়ের উপর ঢলে পড়া, হা হা হি হি করা, এগুলি একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না? মুখে কিছু না বললেও মামু কিন্তু সব নোটিশ করছেন। আমি চাই না তুমি এ বাড়িতে আসো!
- কিন্তু কেন অলকা?  

প্রতিবাদের সুরে মহিলাটি বলল, লজ্জা করে না তোমার! ভদ্রতার মুখোশ পড়ে আর কতদিন চোখে ধ‍ুলো দেবে তুমি?

- হোয়াট ডু ইউ মিন? আর ইউ সিরিয়াস? তুমি কি বলছো তা জানো?
- জানি বলেই তো! তোমার সব ভণ্ডামি প্রশান্ত। তোমার অনেক রূপ। ভালো তুমি কখনোই বাসতে পারো না।

খানিকটা বিব্রত হয়ে লোকটি বলল, এসব তুমি কী বলছো অলকা? মুডটাই অফ করে দিলে! পরে ঠান্ডা মাথায় ডিসকাস করা যেতো না?

- না যেতো না! আমি আজই এর একটা বিহিত করতে চাই।
- দ্যাখো, যা বলবে ক্লিয়ার করে বলো! তোমার ঐ প্যাঁচানো কথা আমি বুঝি না।

- তুমি এ বাড়িতে কেন এসেছো? কোন সূত্রে এসেছো? কেউ ডেকেছিল তোমায়?
- তুমি আননেসেসারি সিন ক্রিয়েট করছো কিন্তু অলকা!
- ও তাই নাকি! আর তুমি যেগুলি করছো, সেগুলি কিছুই নয়? স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি, তুমি আমার সাথে ছলনা করবে, প্রতারিত করবে!
- তুমি বিশ্বাস করো অলকা, জীবনে শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি!
- বিশ্বাস করি না! সব মিথ্যে, অভিনয়। মেয়েদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলাই তোমার পেশা। শুরু থেকেই ওয়াচ্ করছি, মেয়েদের ব্যাপ‍ারে তুমি বরাবারই দুর্বল। বিশেষ করে কচি মেয়েদের প্রতিই তোমার ইন্টারেস্ট বেশি। ছিঃ প্রশান্ত ছিঃ আমার ভাবতেই ঘেন্না হচ্ছে। আই হেট ইউ প্রশান্ত, আই হেট ইউ!

লোকটি তীব্র কণ্ঠে গর্জে ওঠে, - দ্যাখো, এভাবে আমায় ইনসাল্ট করার তোমার কোনো রাইট নেই! পারবে প্রমাণ দিতে?
- প্রমাণ চাও? তাহলে শর্মিষ্ঠার সঙ্গে তোমার কীসের এতো মেলামেশা? কী সম্পর্ক তোমার ওর সাথে?
- কে, শর্মিষ্ঠা? আঙুল তুলে লোকটি বলে, - তোমরা মেয়েরা বড় বিচিত্র। তোমাদের চিন্তাধারাও অত্যন্ত জটিল। কেন সহজভাবে গ্রহণ করতে পারো না?
- আচ্ছ! চোরের আবার বড় গলা!
- আমায় অপমান করছো?
- তাহলে স্বীকার করো!
- না, কিছুতেই না! এ আমি কখনো মানতে রাজি নই। আমি কখন কোথায় কী করেছি, সেটা তোমায় কৈফিয়ৎ দিতে হবে? তোমার খাই না পড়ি!
- স্পর্ধা তো তোমার কম নয়। কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলছো তা খেয়াল আছে!
- আলবত আছে। আমায় ভয় দেখাচ্ছো? তোমার পুলিশ মামাকে মোটেই ভয় পাই না। আমি মানুষ খুন করিনি।
- বেরিয়ে যাও এখান থেকে। আর কোনদিন যেন এ বাড়িতে না দেখি!

কথায় কথা বাড়ে। বাড়ে ক্রোধ, তিক্ততা। শুরু হয় তর্ক-বির্তক, বাকযুদ্ধ। পৌঁছে যায় চরম পর্যায়ে। ইতিমধ্যে ব্যালকনির লাইটটা ধপ করে জ্বলে ওঠে। ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসে এক প্রৌঢ়া মহিলা। তার কণ্ঠে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা।
- কী হয়েছে অলকা? তোরা এতো জোরে জোরে কথা বলছিস কেন?

নিজেকে সামলে নিয়ে মহিলাটি বলল, কিছু নয় মামি, একটা জরুরি বিষয়ে আলোচনা করছি।
- তা বাইরে কেন! আশেপাশের লোকজন সব শুনছে না! কী যে হয় তোদের বুঝি না। এখনো পাহাড়ের মতো গোটা জীবন পড়ে আছে। সংসার করবি কীভাবে? ভিতরে এসে কথা বল!
বলে পর্দাটা সরিয়ে প্রৌঢ়া মহিলাটি আবার ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল।

এতক্ষণে ওদের দুজনকে পরিষ্কার দেখতে পায় সুপ্রিয়। কিন্তু মাথায় টুপি পড়াতে লোকটির মুখ দেখা গেল না। মহিলাটির চোখ মুখ লাল। ভ্রু-যুগল কুঁচকে কটাক্ষ দৃষ্টিতে লোকটির মুখপানে একপলক চেয়ে দ্রুত ঢুকে পড়ল ঘরে। পিছন পিছন লোকটিও ঘরের ভিতর ঢুকে তক্ষুণি নিচে নেমে বেরিয়ে আসে রাস্তায়। খট্ খট্ শব্দে বুটের আওয়াজ করে উগ্র মেজাজে মোটর বাইকে চেপে চোখের নিমিষে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সুপ্রিয় হাঁ করে থাকে। মোটরবাইকটা যতক্ষণ দেখা গেল সেদিকেই চেয়ে থাকে। মনে মনে বলে, আশ্চর্য। স্বচোক্ষে না দেখলে কখনো বিশ্বাসই হতো না। পৃথিবীতে ভালোবাসা ব্যতীত আর কিছুই কী নেই? ভালোবাসা বাসি না থাকলে কী বেঁচে থাকা যায় না? কিন্তু সুপ্রিয় কেমন করে জানবে! জীবন যার কাছে দূরপাল্লার দৌড়। যার মাথার উপর তিন ভাই-বোনের গুরুদায়িত্বের বোঝা, যার নিরবসর, নির্বান্ধব, নিঃপ্রেম, নিরানন্দের জীবন। আঠাশ বছর বয়সেও কোনো মহিলার সংস্পর্শে যাবার সময় সুযোগই যার হয়নি, সে মানুষ কেমন করে বুঝবে, ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর কোমল চঞ্চল একটা নিদারুণ মানবিক অনুভূতি। যার ডেফিনেশন ভাষায় বয়ান করা যায় না।

ছোটবেলায় মাতা-পিতাকে হারিয়ে তিন ভাইবোনকে নিয়ে সুপ্রিয় অনাথ। সম্বল ছিল শুধুমাত্র পিতার পেনশনের টাকা। থাকতো ভাড়া বাড়িতে। আচমকা বিপন্ন সময়ের শিকার হয়ে মাত্র আঠারো বছর বয়সে উত্তারাধিকার সূত্রে পিতার রিপ্লেসে শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হয়ে সংসারের হাল ধরে। পাশাপাশি কয়েকটি প্রাইভেট টিউশনি নিলে অচিরেই পরিবারে স্বচ্ছল অবস্থা ফিরে আসে। পরবর্তীতে গভর্নমেন্ট কোয়াটারে বদলি হয়ে চলে আসে শহরে। বর্তমানে শুধু একটাই চিন্তা, ন্যূনতম বেঁচে থেকে ভাই-বোনদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা। উচ্চপদ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। স্বাবলম্বী করে তোলা। বোনদের সুপাত্রস্থ করা। কিন্তু বড্ড সেন্টিমেন্টাল। একরোখা মানুষ। অনমনীয় জেদ। বিয়ে সে কখনোই করবে না। সম্ভবত সে কারণেই কোনো মহিলার সান্নিধ্যে যাওয়া তো দূর, চোখ তুলে কোনদিন চেয়েও দ্যাখেনি। মহিলাদের প্রতি কখনোই ওর আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে জীবনে প্রথম সুপ্রিয়র হৃদয়পটভূমিতে জাগ্রত হয় স্ত্রীলোকের প্রতি একটা আকর্ষণ। এক অভিনব কোমল অনুভূতি। যা ওর হৃদয়কে করে বিকশিত, প্রভাবিত। আবিষ্কার করে অলকা নামে এক অচেনা অপরিচিত যুবতী মহিলাকে। যার মুখচ্ছবি পূর্ণিমার চাঁদের মতো বার বার ওর হৃদয় আকাশে উদ্ভাসিত হতে থাকে। কানে বাজে ওর কণ্ঠস্বর। প্রচণ্ড ভাবিয়ে তোলে সুপ্রিয়কে, কে এই মহিলা? কেনইবা অদৃশ্য একটা আকর্ষণে মনকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

দুই.
প্রতিদিন রুটিনমাফিক স্কুলের কাজকর্ম সেড়ে বাড়ি এসে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নেয় সুপ্রিয়। তারপর চা-জলখাবার খেয়ে ফ্রেস হয়ে সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়ে টিউশনিতে। কিন্তু অভাবনীয়ভাবে আজই ঘটে গেল ব্যতিক্রম। শরীরের ক্লান্তিতে কখন যে তন্দ্রা লেগে গিয়েছিল চোখে, টের পায়নি। হঠাৎ টেলিফোনের ঝনঝন শব্দে চমকে ওঠে। একপলক ঘড়ির দিকে তাকিয়েই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। অবিলম্বে রিসিভারটা তুলে বলল, হ্যালো!

হঠাৎ থতমত খেয়ে গেল সুপ্রিয়। অপ্রত্যাশিত মহিলা কণ্ঠস্বর শুনে নার্ভাস হয়ে যায়। কিছুক্ষণ থেমে স্বাভাবিক হয়ে বলল, কে বলছেন?

ইতিপূর্বে উচ্ছাসিত স্বরে ভেসে আসে, কেমন আছো মামু?

একবার ভাবল, রং নম্বর বলে লাইনটা কেটে দেবে। কিন্তু দিলো না। হঠাৎ রসিকতা করার ভূত মাথায় চেপে বসে। একটা ঢোক গিলে বলল, আপনি নাম বলছেন না, কিকরে বুঝবো বলুন তো!

কিছুক্ষণ থেমে মহিলাটি বলল, আমি নৈহাটি থেকে অলকা বলছি মামু।
 
অপ্রত্যাশিত নামটা শোনামাত্র চমকে ওঠে সুপ্রিয়। হৃদয়স্পন্দনটাও আরো দ্রুত গতিতে চলতে থাকে। নামটা তো খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে! মুহূর্তের জন্য বিস্ময়ের ঘোরে পড়ে গেলেও অচমকা হৃদয়গহ্বরে জমে থাকা স্ত্রীলোকের প্রতি যে আকর্ষণ, ইচ্ছা-আবেগ-অনুভূতি তার তীব্র জাগরণে মন-প্রাণ উতল হয়ে ওঠে। রিসিভারটা হাতে নিয়েই শুয়ে পড়ে বিছানায়। রিল্যাক্স হয়ে বলে, হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই নামটা শুনেছিলাম!

- অ্যা, কী বলছো? একটু জোরে বলো, শুনতে পাচ্ছি না!
- বাব্বা, লোকটি কি ব্যবহারটাই না করলো!

- আ! মামু, কী আবোল তাবোল বকছো! মিলিকে ডেকে দাও।
- অ্যা মিলি! মিলি আবার কে!

এবার ভেসে আসে মহিলার তীব্র কণ্ঠস্বর। ওফ হো মামু, কী শুরু করেছ তুমি? বলছি না মিলিকে ডেকে দিতে, নয়তো এক্ষুণিই হ্যাঙআপ করে দেবো বলে দিলাম!

ইতস্তত হয়ে সুপ্রিয় বলল, ম্যাডাম, ইট ইজ রং নম্বর!

চটে গিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে মহিলাটি বলল, তা এতক্ষণ আপনি বলেননি কেন? স্টুপিড!
- এই যে ম্যাডাম, স্টুপিড আমি নই, আপনি।
- কী! কী বললেন? এতো বড় সাহস আপনার!
- ইয়েস ম্যাডাম! আপনি অচেনা অজানা ভদ্রলোকের ঘরে ফোন করে ডিস্টার্ভ করলেন, আর আমাকেই স্টুপিড বলছেন?

নরম হয়ে মহিলাটি বলল, সরি, আই অ্যাম সো সরি! ওকে! বাই!
- ওয়েট এ মিনিট ম্যাডাম, শুধু সরি বললে হবে না। আপনার ফুল ইনফরমেশন চাই।
- মানে! হোয়াটস রং উইথ ইউ?
- বাহ, আপনি যে আমার টাইম ওয়েস্ট করলেন!
- আমি তো ইচ্ছে করে করিনি। বাই মিস্টেক হয়ে গিয়েছে।
- বেশ, আপনার ফোন নম্বরটা দিন।
- আপনি কেমন ভদ্রলোক মশাই। একজন অজ্ঞাত অপরিচিতা মহিলার ফোন নম্বর নিয়ে আপনি কী করবেন?
- অজ্ঞাত কোথায়? আপনার সঙ্গে এইমাত্র যে আমার আলাপ হলো!
- তাতে কি! আপনাকে তো আমি চিনি না!
- কিন্তু আমি যে আপনাকে চিনি!
- হোয়াট? চেনেন মানে! হাউ ডু ইউ নো?
- কেন, কিছুদিন আগে আমাদের পাশের ব্যালকনিতে আপনাকেই তো দেখেছিলাম ফাইট করতে, অ্যাম আই রাইট?
- ও আই সি! আমাদের কনভারসেশন আড়ি পেতে শোনা হয়েছিল! মশাই আপনি একজন পুরুষ মানুষ হয়ে এতো ইন্টারেস্ট কেন আপনার?
- কেন হবে না ম্যাডাম। দেখাচ্ছেন আপনারা, লোকে কি চোখ বুজে থাকবে? না কানে তুলো দিয়ে রাখবে!
- তাতে আপনার কী?
- কিছুই না। হবে আপনার।
- মানে! হোয়াট ডু ইউ মিন?
-ম্যাডাম, এ দুনিয়ায় এত সহজে কিছু পাওয়া না বুঝলেন। সব ধাপ্পাবাজি।
- দেখুন মশাই, মাইন্ড ইওর ওউন বিজনেস। দিস ইজ মাই পার্সোনাল ম্যাটার। আপনাকে জ্ঞান দিতে হবে না। আপনি নিজের চড়কায় তেল দিন যান!
- কি মুশকিল। তেল আমাকে দিতে হবে কেন! আমি তো ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেই।
- এ্যাঁ, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেই মানে!
- মানে ভেরী সিম্পল। আমি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করি।
- ও রিয়েলি? তাহলে আপনার কথাবার্তার...!
- থামলেন কেন, বলুন।

স্বাভাবিক হয়ে মহিলাটি বলল, তাহলে তো আপনার বেরসিক হওয়ার কথা স্যার।
- যাব্বাবা, এর মধ্যে রসের কী পেলেন! আমি চোখে যা দেখেছি, তা-ই বলেছি। ঠিক কি না বলুন।

ক্ষীণ স্বরে হাসির শব্দ শুনতে পায় সুপ্রিয়। গম্ভীর হয়ে বলল, আপনি হাসছেন কেন?
- তাহলে আপনিও নিশ্চয়ই প্রেম ট্রেম করেন?

অসন্তোষ গলায় সুপ্রিয় বলল, আজ্ঞে নো ম্যাডাম। আপনি যা ভাবছেন, তা আমি নই।
- তাহলে অবসর সময়ে..! আই মিন, আপনার কোনো গার্লফেন্ড নেই?
- ওটাই তো আমার ধাতে সয় না ম্যাডাম। বিশেষত মহিলাদের সান্নিধ্যে থাকা মানে একটা বিরাট সমস্যা। বলতে পারেন একটা উটকো ঝামেলা। আমার অভিজ্ঞতা আছে। চারদিকে দেখছি তো!
- এ্যাঁ, বলেন ক? মহিলাদের প্রতি আপনার এ ধরনের মেন্টালিটি? তাহলে জীবনের বাকি দিনগুলি আপনি কাটাবেন কী করে?
- কেন, আমার ভাই-বোনরা আছে। ওদের নিয়েই তো আমার দিন কেটে যাচ্ছে। আর তাছাড়া, ঐ যে বললাম, সব ধাপ্পাবাজি। আপনি কাকে বিশ্বাস করবেন।
 - কেন, আপনার মতো যারা আছেন।

ফিক করে হেসে ফেলল সুপ্রিয়। বলল, সে কি, চোখে না দেখেই এতো কনফিডেন্স! ম্যাডাম, আপনারা তো এখানেই বড় মিসটেক করেন।
- কথাটা ঠিক বুঝলাম না।
- দেখা নেই, শোনা নেই, শুধুমাত্র কথাবার্তায় একজন অচেনা মানুষকে কখনো চেনা যায় না ম্যাডাম।
- না গেলেই বা! আপনার সরলতা ও নৈতিকতার বাহ্যিক প্রকাশ্যে কিছুটা তো অনুমান করা যায়! তবে হ্যাঁ, মানুষ পরিবর্তনশীল, এটা সত্যি কথা।
-দ্যাটস রাইট! স্বীকার করছেন তাহলে!

ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মহিলাটি বলল, তা আর অস্বীকার করি কী করে! ঠিকই বলেছেন। ইউ আর রাইট!
- আসুন না একদিন আমাদের বাড়িতে। বোনদের সাথে আলাপ করবেন। ভালো লাগবে।
- হ্যাঁ, এবার মামার বাড়িতে গেলে অবশ্যই দেখা করে আসবো।
- কথা দিলেন কিন্তু! এই যা, ভুলে গেলাম। কী যেন বললেন আপনার নামটা।
- অলকা, অলকা গাঙ্গুলী।
- আপনার নাম।
- সুপ্রিয় ব্যানার্জী। আচ্ছা তাহলে আজ রাখি। ও কে বাই!

রিসিভারটা রেখে হাত-পা ছড়িয়ে টান টান করে বিছনায় শুয়ে পড়ে সুপ্রিয়। আড়মোড়া ভাঙে। টিউশনি গেল চুলোয়। অনাকাঙ্ক্ষিত জীবনে আজ প্রথম মহিলার সাথে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় গোধূলির প্রারম্ভই ছন্দময় হয়ে ওঠে। জেগে ওঠে পুলক। অনুভব করে ওর কাল্পনিক চেতনা আর ভালোলাগার অদৃশ্য একটা আকষর্ণের মায়ায় ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছে। আকাশকুসুম ভাবতে শুরু করে। হারিয়ে যায় এক নতুন পৃথিবীতে। এক স্বপ্নপুরীতে। যেখানে চিন্তা নেই, ভাবনা নেই। নেই কোনো পিছু টান।

হঠাৎ ওর পিঠে একটা টোকা দিয়ে ছোটবোন সুলেখা বলল, কি রে দাদা, আজ টিউশনিতে যাবি না?
বলতে বলতে সুপ্রিয়র মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। লক্ষ্য করে সুপ্রিয়র আমূল পরিবর্তন। আশ্চর্য, যার মুখে কখনো হাসি ছিল না, উৎসাহ ছিল না, সদা ধীরস্থির গম্ভীর ব্যক্তিত্বময় চেহারায় হঠাৎ এমন প্রসন্নতায় ভরে গেল কেমন করে! নিশ্চয়ই কারো প্রেমে পড়ে গিয়েছে। ভাবতেই মুখ টিপে ফিক করে হেসে ফেলল সুলেখা। রসিকতা করে বলল, কি হলো দাদা, জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছিস বুঝি।

বুঝতে দেয় না সুপ্রিয়। পিছন থেকে হাতের মুঠোয় সুলেখার চুল টেনে ধরে বলে, হাসছিস কেন রে! পাকামি হচ্ছে না! জামাটা ইস্ত্রি করতে বলেছিলাম, করেছিস? শীগগির নিয়ে আয় গে যা, যা বলছি!

(চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২৯১৬
এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ