তিন.
সন্ধ্যে প্রায় সাতটার মতো হবে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ফটাফট তৈরি হয়ে টিউশনিতে বেরিয়ে পড়ে সুপ্রিয়।
গ্রাহ্য করলো না সুপ্রিয়। ওকে পাস করে যেতেই কানে ভেসে আসে, এই যে দাদা, শুনছেন!
থমকে দাঁড়ায় সুপ্রিয়। পিছন ফিরে বলল, আমায় বলছেন?
- তবে নয়তো কি! আশপাশে আর কাউকে দেখছেন! একটা মাচিশ থাকলে দিন তো।
যুবকটির কথা শুনে বিস্ময়ের ঘোরে পড়ে যায় সুপ্রিয়। যুবটির আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে বলে, বেটা বাইরের আমদানি। বেশভূষায় তো ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিলং করে মনে হচ্ছে। কিন্তু তার এ ধরনের বিহেইভ? একজন পথচারীকে পিছন থেকে ডেকে মাচিশ খুঁজছে। বেটা নিশ্চয়ই কোনো কুমতলবে আছে।
কৌতূহল জেগে ওঠে সুপ্রিয়র। যুবকটিকে যাচাই করতে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে, মাচিশ দিয়ে কী করবেন?
- মাচিশ দিয়ে কী করে আপনি জানেন না?
সুপ্রিয়ও কম যায় না। ঠোঁটের কোণে একটা চাপা হাসির রেখা ফুটিয়ে বলে, মাচিশ তো অনেক কাজেই লাগে ভাই!
স্বাভাবিক হয়ে যুবকটি বলল, সিগারেটটা ধরাবো। অনেকক্ষণ স্মোক করিনি!
- কিন্তু স্মোক তো আমি করি না ভাই।
- সেকি! আপনি কেমন পুরুষ মানুষ মশাই! স্মোক করেন না।
- কেন, স্মোক না করলে কি পুরুষ মানুষ হওয়া যায় না?
রূঢ় গলায় যুবকটি বলল, মশাই থাকলে দিন, নয়তো যেখানে যাচ্ছিলেন চলে যান। আপনার লেকচার শুনতে চাই না।
চটে গিয়ে সুপ্রিয় বলল, আপনি বেপাড়ায় এসে মস্তানি দেখাচ্ছেন? আপনার উদ্দেশ্যটা কী বলুন তো?
- কেন, কী করতে পারবেন আপনি? কাউকে ভয় পাই না আমি। পি কে চ্যাটার্জির নাম শুনেছেন? থানার ওসি। মাই ড্যাড।
- ও তাই এতো মস্তানি দেখাচ্ছেন! লোকজন ডাকবো না কি?
সুপ্রিয়র কথা শেষ না হতেই হিংস্র জানোয়ারের মতো চোখমুখ লাল করে যুবকটি তেড়ে আসে। আর একটা কথা বলবি তোর টুটি ছিঁড়ে দেবো।
সুপ্রিয়ও একজন পুরুষমানুষ। সুঠাম সুদর্শন তরুণ যুবক। নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখতে সর্বদাই সচেতন। বিশেষত পথেঘাটে কখনো বিরূপ পরিস্থিতির সম্ভাবনা দেখলেই উপেক্ষা করে সরে আসে। কখনো ইনভল্ব হয় না। কিন্তু আজ জনৈক যুবকের অমার্জিত রূঢ় ব্যবহারে ক্রোধ সম্বরণ করতে পারেনি। পাল্টা জবাবে কিছু বলার আগেই ওর পিঠের উপর দমাদম পরে গেল দু-চারটে কিল আর ঘুষি। সুপ্রিয়ও আচমকা পরিস্থিতির বেগতিক লক্ষ্য করে রুখে দাঁড়ায়। হাতাহাতি শুরু করে দেয়। ইতিমধ্যে দেখতে পেয়ে বাড়ির ভিতর থেকে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসে। সে আর অন্য কেউ নয়, শৈলেন চক্রবর্তী। অলকার মামা। বললেন, এ কি, তোমরা মারামারি করার আর জায়গা পেলে না। একেবারে আমার দুয়ারের সামনে। ফ্যামিলি নিয়ে বাস করি। থাকো কোথায় তোমরা?
পরক্ষণেই প্রশান্তকে দেখতে পেয়ে সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, এ কি প্রশান্ত তুমি? এখানে কী করছো? অলকা কোথায়?
ভদ্রলোকের গলা শুনে দুজনেই থমকে দাঁড়ায়। বন্ধ হয়ে গেল লড়াই, মারপিট। বিবর্ণ হয়ে গেল প্রশান্তর মুখ। শুকনো একটা হাসি দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কেমন আছেন মামু? আমি অলকার খোঁজেই এখানে এসেছি!
- এ্যাঁ, বলো কি! ওতো এখানে আসেনি। কিন্তু তোমরা মারামারি করছিলে কেন? কী হয়েছে? এসো, ভিতরে এসো!
সুপ্রিয়র দিকে চেয়ে বললেন, তোমাকে তো বাবা ঠিক চিনলাম না। অবশ্য না চেনারই কথা। এ পাড়ায় আমরা নতুন এসেছি।
ইত্যবসরে একগাল হেসে বুকের ছাতি ফুলিয়ে প্রসন্ন মেজাজে শৈলেন চক্রবর্তীর বাড়িতে ঢুকে পড়েছে প্রশান্ত। সুপ্রিয় তৎক্ষণাৎ দুহাত জরো করে বলল, নমস্কার মেশো মশাই, আমি সুপ্রিয়, আপনার প্রতিবেশী।
আঙুল তুলে পয়েন্ট করে বলল, ওই যে বাঁ-দিকের ফ্ল্যাটটা দেখছেন, ওটাই আমাদের!
- হ্যাঁ, তা তো বুঝলাম, কিন্তু প্রশান্তর সঙ্গে তোমার কী হয়েছিল? তুমি ওকে চেনো না কি?
কথা না বাড়িয়ে সুপ্রিয় বলল, চলি স্যার! লেট হয়ে যাচ্ছে! পরে কথা হবে। বলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। দ্রুত অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
ততক্ষণে ভিতরে ঢুকে সোফায় বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফ্যালে প্রশান্ত। মনে মনে বলে, ভালোই হলো। থ্যাঙ্কস গড! কেলেঙ্কারিটা না বাঁধলে এত শীঘ্র এ বাড়িতে ঢোকা যেতো না। এবার চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। কিন্তু বাড়ির কাউকে ওর নজরে পড়ছে না। ইতিমধ্যে কর্ডলেস ফোনটা হাতে নিয়ে শৈলেন চক্রবর্তী এসে বললেন, আশ্চর্য! তুমি অলকার খোঁজে নৈহাটি থেকে কলকাতায় চলে এসেছ, কিন্তু অলকা তো বাড়িতেই আছে!
কথাটা শোনামাত্রই মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেল প্রশান্তর। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। শুকনো একটা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল, বাড়িতে আছে! আসলে এর মধ্যে আর কন্টাক্ট হয়নি তো, তাই ভাবলাম....!
- আমি তো শুনেই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। আজকাল চারদিকে যা ঘটছে। কোথাও সিওরিটি নেই। নাও ধরো অলকার সাথে কথা বলো।
বলে প্রশান্তর হাতে ফোনটা তুলে দিলেন। প্রশান্ত তক্ষুণি অনীহা প্রকাশ করে বললো, এখন থাক মামু। আর্জেন্ট কিছু নেই। আই উইল কল হার লেটার।
শৈলেন চক্রবর্তী লক্ষ্য করলেন, প্রশান্তর স্বতঃস্ফূর্ত চেহারাটা হঠাৎ মিলিয়ে গেল। খুব বিচলিত মনে হচ্ছে। সন্ধানী চোখ দু’টো ওর চড়কির মতো চারদিকে ঘুরছে। কিছু বলতে চাইছে অথচ বলতে পারছে না। হতাশার চোখে বার বার পিছন ফিরে কী যেন দেখছে। হঠাৎ শৈলেন চক্রবতীর কণ্ঠস্বরে চমকে ওঠে।
- কাকে খুঁজছো প্রশান্ত?
বোকার মতো ফিক করে হেসে ফেলল প্রশান্ত। দাঁতকপাটি বার করে বলল, কাউকে দেখছি না, সব গেল কোথায়! বেড়াতে বেরিয়েছে বুঝি!
দুহাত বোগলে রেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন শৈলেন চক্রবর্তী। ওয়াচ করছিলেন প্রশান্তকে। ওর কথাবার্তা, চোখমুখের ভাবভঙ্গি, আচার আচরণ অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। সামথিং ইস রং। মনের সন্দেহ ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকে। প্রশান্তকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ওরা শ্যামবাজারে থিয়েটার দেখতে গেছে।
- মিলিও গিয়েছে? বলে উত্তরের অপেক্ষায় উৎসুক হয়ে চেয়ে থাকে।
কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন শৈলেন চক্রবর্তী। বললেন, এ্যাঁ, হ্যাঁ মিলিও গিয়েছে। কিন্তু মিলির সাথে তোমার কী দরকার?
হঠাৎ হকচকিয়ে গেল প্রশান্ত। তবু বুঝতে দিলো না। শুনেও না শোনার ভান করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে দেওয়ালে ঝুলে থাকা দামী ফ্রেমে বাঁধানো ঐতিহাসিক চিত্রাঙ্কন কিংবদন্তী সম্রাট শাহজাহানের হৃদয়নিংড়ানো অটুট ভালোবাসার স্মৃতির-সৌধ তাজমহলের দিকে। কথা বলছে ঠিকই কিন্তু ওর মাইন্ড অন্য জায়গায়। শৈলেন চক্রবর্তীকে উপেক্ষা করে বলল, বা!, দারুণ কালেকশন আপনার, অপূর্ব! রিয়েলটা দেখেছেন কখনো?
বলতে বলতে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায়। দরজার সন্নিকটে এসে বলে, আজ চলি মামু! আরেক দিন আসবো! বলে এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। হাওয়ার গতিতে শৈলেন চক্রবর্তীর বাড়ি থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
শৈলেন চক্রবর্তী একজন অভিজ্ঞ মানুষ। নিজের ফ্যামিলি নিয়ে কলকাতার ভবানীপুরের জগদীশ চন্দ্র রোডে বহু বছর যাবৎ বাস করছেন। তিনি পেশায় পুলিশ অফিসার। একসময় ডিটেক্টিভ ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন। মানুষের মুখদর্শনেই আঁচ করে নিতে পারেন। কখনো ভুল হয় না। আজ প্রথম দর্শনেই প্রশান্তর বিহেইভ ওয়াচ করেছিলেন এবং শতভা শিওর ছিলেন, অলকাকে খোঁজার বাহানায় ও’ মিলির সাথেই দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু কেন? কিসের জন্য? পোশাকআশাকে ভদ্রলোকের মতো লাগলেও ওর আচার আচরণে ভদ্রতার ছিঁটে ফোটা কোথাও নেই। আমার বাড়িতে এসে আমার মেয়ের বিষয়ে জানতে চায়, ওর এতবড় দুঃসাহস। কিন্তু বিনা নোটিশে প্রশান্তর আগমনে তিনি অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। প্রচণ্ড রাগ হয় অলকার ওপর। ওকেই দোষারোপ করেন। একজন রুচিশীল, সৃজনশীল এবং বুদ্ধিদ্বীপ্ত মহিলা হায়ার এডুকেটেড হয়ে প্রশান্তর মতো একটা গোঁয়াড়, বদমেজাজি, স্বার্থাণ্বেষী এবং আত্মকেন্দ্রিক ছেলের প্রতি আকৃষ্ট হয় কীভাবে? ওর কিসে ইম্প্রেস হয়েছিল? বাপের পয়সায় রাজত্ব করছে, ফূর্তি করছে। শৌখিন বিলাসিতায় মানি ওয়েস্ট করছে। না জানি আরো কত কী করছে। অলকা কিছুই নোটিশ করে না! হোপ্লেস! এ ধরনের ছেলেদের উপর কখনো ডিপেন্ড করা যায় না। মানুষের চেহারাই কি সব! সাধারণ ভদ্রতাটুকুও জানে না। দুদিনের আলাপচারিতায় ওকে এতখানি আস্কারা দেওয়া মোটেই ঠিক হয়নি। সময় থাকতেই ওলিকে এলার্ট করে দেওয়া উচিৎ। নয়তো ভবিষ্যতে ওকেই ভুক্তে হবে। এ কারণেই ফ্যামেলি ব্যাকগ্রাউন্ড কিম্বা বংশ পরিচয় জেনে রাখা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু শৈলেন চক্রবতী কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছেন না। তাকে প্রচণ্ড ভাবিয়ে তোলে। তার একটি মাত্র কন্যাসন্তান। কত আদরের। চোখের মণি। ছোটবেলা থেকেই ওকে সুশিক্ষায়-দীক্ষায় নিজের মনের মতো করে গড়ে তুলেছেন। জীবনে তার কত স্বপ্ন, কত আশা-আকাঙ্ক্ষা। আভিজাত্য এবং সম্ভান্ত পরিবারের বিদ্যান বুদ্ধিমান এবং সমাঝদার পাত্রের সাথে কন্যার বিবাহ দেবেন। কন্যার ঘর সংসার বেঁধে দেবেন। আরো কত কি! প্রশান্তর মতো একটা স্কাউন্ড্রেলের সাথে কোনভাবে মিলিকে মেলামেশা করতে দেবেন না। ওর সান্নিধ্যে যেতে দেবেন না। মিলির গায়ে কখনো আঁচ লাগতে দেবেন না।
ভাবতে ভাবতে তৎক্ষণাৎই রিসিভারটা তুলে নম্বর ডায়াল করে বললেন, হ্যালো ওলি, মামু বলছি!
- হ্যাঁ মামু বলো, লাইনটা তখন কেটে গেল কেন?
পাল্টা প্রশ্ন শৈলেন চক্রবর্তীর, আচ্ছা, ব্যাপার কি বল তো! আজ প্রশান্ত এসেছিল, তুই কিছু জানিস?
প্রশান্তর নাম শুনেই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বরে ভাটা পড়ে গেল অলকার। কিছুক্ষণ থেমে বিষণ্ণ গলায় বলল, জানি না। কখন এসেছিল?
- এই তো এক্ষুণিই গেল। কিন্তু কি জানিস, ছেলেটিকে আমার মোটেই সুবিধের মনে হলো না। লিসেন টু মি, বি কেয়ারফুল। বেশি মেলামেশা করিস নে। কি রে, শুনছিস তুই?
মুখ দিয়ে একটা শব্দও আর উচ্চারিত হয় না অলকার। শুধু বলল, হুঁম!
- বুঝতে পারছি, মামুর কথা শুনতে কটু লাগছে। কিন্তু মামা হয়ে এসব সহ্য করি কী করে বল! আফটার অল আমি একজন পুলিশ ডিপার্টমেন্টের চিপ। তাই এলার্ট করে দিলাম। আর কী বলবো। ভালো থাকিস। বাই!
একেই অনুতাপের আগুনে জ্বলছিল অলকা। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল নিজের ওপর। তন্মধ্যে মামুর সতর্কবাণী শ্রবণ করে পড়লো কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে। ক্ষোভে-দুঃখে অপমানে ধপাস করে বসে পড়ে সোফায়। মনে পড়ে, প্রথম পরিচয়েই প্রশান্তকে ভালোবেসে ফেলেছিল। কলেজ পালিয়ে কতদিন একলা নির্জনে ঘু-ঘু ডাকা পড়ন্ত দুপুরে কৃষ্ণচূড়াগাছের ছায়ায় অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে থাকতো প্রশান্তর অপেক্ষায়। পেরিয়ে যেতো কত অগণিত প্রহর। তবু কখনো অভিযোগ করেনি, কৈফিয়ৎ চায়নি। প্রায়ই বান্ধবীদের মুখরোচক সমালোচনা কর্ণগোচর হত, ওদের কলেজে নবাগতা সুচন্দ্রার সাথে প্রশান্তর মন বিনিময়, ঘনিষ্ঠতা, হৃদ্যতা, ওদের অবৈধ সম্পর্কের কথা। তবু সন্দেহের বীজ হৃদয়ের গভীরে কখনো রোপণ করেনি। কোনো রেখাপাত করেনি। চেয়েছিল প্রশান্তকে ওর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দিয়ে প্রাণের ডোরে বেঁধে রাখতে। ওর অনাগত ভবিষ্যতের দিনগুলিকে সার্থক করে তুলতে। কত না রঙিন স্বপ্ন চোখের পাতায় এঁকে রেখেছিল। সাজিয়ে রেখেছিল ভালোবাসার রাজপ্রসাদ। অথচ একবারও ভেবে দ্যাখেনি, আবেগের বশীভূত হয়ে তৃষ্ণার্ত নয়নে যার প্রতীক্ষায় প্রহর গোণা, পথ চেয়ে থাকা, সে কি কখনো হৃদয় দিয়ে, একান্ত আপন করে ওকে ভালোবেসেছিল কি না, ওর চাওয়া পাওয়ার ইচ্ছানুভূতিগুলি কখনো মূল্যায়ন করেছিল কিনা, গুরুত্ব দিয়েছিল কিনা। অথচ ভালোবাসার মোহে অন্ধের মতো নিজেকে নিঃস্ব করে সঁপে দিয়ে একটু একটু করে প্রশান্তর হেয়ালি মন থেকে ওযে ক্রমশ দূরে সড়ে যাচ্ছিল, তা কখনো টের পায়নি। কখনো কল্পনাও করেনি, ওর ঐ চাওয়া-পাওয়ার ইচ্ছা, আবেগ-অনুভূতি কত অর্থহীন, ওর অবাঞ্ছনীয়। একদিন যা আচমকা সব নিঃশেষ হয়ে ঝরে যাবে। যখন প্রশান্তই ছিল ওর জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সব। অথচ ভাগ্যের কি নিমর্ম পরিহাস, যেদিন দৃঢ়তার সাথে নিশ্চিত হয়ে জীবনের চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, সেদিনই ওর হৃদয়পটভূমির তুমুল কম্পনে তোলপাড় করে দিলো ফুলের মতো ওর মাসুম জীবনটাকে। ভেঙে চুরমার হয়ে গেল তিল তিল করে গড়ে ওঠা ওর স্বপ্নের সৌধ। ঝরে গেল ভালোবাসার ফুল। নিভে গেল আশার প্রদীপ। যেদিন কৃষ্ণপক্ষের ঘোর অন্ধকার রাতে পাড়ার ক্লাবঘরে ভোগ-বিলাসী প্রশান্তর কামনা বাসনার অবগাহনে অসংযত আচরণে লিপ্ত অষ্টাদশী লাবণ্যময়ী শর্মিষ্ঠার সাথে হাতে নাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল। যেদিন আবিষ্কার করলো, প্রশান্ত একজন ধূর্ত, প্রতারক, লম্পট ব্যাভিচারী চরিত্রহীন। যার সততা নেই, নৈতিকতা নেই, রুচিবোধ নেই, সৎ চিন্তা নেই, সৎ বাক্য নেই, নেই মানবিক চেতনা এবং জীবনের মূল্যবোধ। যা স্বপ্নেও কোনদিন কল্পনা করতে পারেনি।
কথায় বলে, ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ’ অলকাদের বাড়িতে একটা ছোট্ট বিদেশি কুকুর ছিল। অবলা হলেও মনুষ্য প্রাণীর মতো ওকে ভীষণ ভালোবাসতো। আদর করতো। জেডি বলে ডাকতো। একদিন জেডি হঠাৎ বাড়ি থেকে কোথায় যে উধাও হয়ে গেল কেউ জানে না। ওকে হাঁকডাক দিয়ে তন্ন তন্ন করে ঘরে বাইরে সব জায়গায় খুঁজতে থাকে। জেডিকে খুঁজতে এসেই খসখস শব্দ শুনে পাড়ার ক্লাবঘরের বদ্ধ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়েছিল অলকা। অন্ধকার হলেও রাস্তার বিজলিবাতির ক্ষীণ আলো-ছায়ায় অস্পষ্ট দেখা গেছে অবৈধ আচরণে গভীরভাবে লিপ্ত। দুজনেরই অর্ধবস্ত্র শরীর। গায়ের কাপড় এলোমেলো। আচমকা অলকার আগমনে দুজনেই থতমত খেয়ে যায়। বেসামাল হয়ে পড়ে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে হাঁপাচ্ছে। অপ্রস্তুত শর্মিষ্ঠার তখন শোচনীয় অবস্থা। নিজেকে আড়াল করার চেষ্টায় দিশেহারা হয়ে পড়ে। পালাবার চেষ্টা করে। শরীরের ঊর্ধ্বাংশ দু’হাতে ঢেকে থরথর করে কাঁপছিল। অগত্যা, ক্ষমা প্রার্থীর মতো দৃষ্টি মেলে একপলক চেয়ে কোনরকমে গায়ে কাপড়টা জড়িয়েই ক্লাবঘর থেকে দ্রুত ছুটে বেরিয়ে যায়। শর্মিষ্ঠা বেরিয়ে যেতেই বুকের ছাতি যেন আরো দশ ইঞ্চি বেড়ে যায় প্রশান্তর। কোনো বিকার নেই, প্রতিক্রিয়া নেই। শিস দিতে দিতে প্যান্টের বেল্ট লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যেন কত বাহাদুরির কাজ করেছে। সমাজের কল্যাণ করেছে।
তরুণ যুবক। বড়লোক অবস্থাপন্ন বাপের একমাত্র গুণধর পুত্র, উত্তরাধিকারী। মেয়ে মানুষ নিয়ে ফূর্তি করতেই পারে। একটা কেন হাজারটা করবে। তাতে কার কী এসে যায়! সেদিন এমনই মনোভাব ছিল প্রশান্তর। গায়ের জামাটা কাঁধে চেপে অলকার নাকের ডগা দিয়ে নির্বিকারে শরীর দুলাতে দুলাতে বেরিয়ে গেল। অলকা লজ্জায় ঘৃণায় অপমানে পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মুহূর্তের জন্য ওর বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিছু বলার সুযোগই পায়নি। যেদিন কঠোর আঘাতে ওর কোমল হৃদয়কে ভেঙে চৌচির করে দিয়েছিল। বিনষ্ট করে দিয়েছিল জীবনে চাওয়া পাওয়ার সমস্ত ইচ্ছা-আবেগ-অনুভূতি সব। যেদিন প্রশান্তকে চিরদিনের মতো হৃদয় থেকে অপসারিত করে ওকে ভুলে থাকার প্রতীজ্ঞায় মনকে শক্ত করে নিয়েছিল। ভালোবাসার গলা টিপে একাকী জীবনকে বেছে নিয়ে নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে রাখে। যা আজও ওকে নিরন্তর কষ্ট দেয়। কিন্তু এসব কথা ও’ বলবে কাকে!
আজ অনুতাপ অনুশোচনার কারাগারে বন্দি অলকা। কেঁদে মরে মুক্তির সন্ধানে। কী দুর্বিসহ ওর ওই পরাজয়ের গ্লানি। যা কখনোও ভোলা যাবে না। রয়ে যাবে চিরন্তন বেদনার গহীন অনুভূতির দংশন হয়ে ওর অবাঞ্ছনীয় স্মৃতির গ্রন্থিতে।
চার.
দেখতে দেখতে কেটে গেল একটা বছর। এলো শ্রাবণ মাস। প্রবল বর্ষণেও প্রচণ্ড উত্তাপ। সুপ্রিয়র ছোটবোন সুলেখার বায়না, এবার সামারে দীঘার সমুদ্রসৈকতে যাবে। ঘুরবে, বেড়াবে, এনজয় করবে। অমত করে না সুপ্রিয়। ভাইবোনদের প্রতি কর্তব্য পালনে কোনো ক্রুটিও রাখে না। কখনো কার্পন্য করে না। পিছুপা হয় না। মাতা-পিতার শূন্যতা বা অভাববোধ কখনোই অনুভব করতে দেয় না। ভাইবোনদের খুশিতেই ওর তৃপ্তি, আনন্দ, মনের সুখ, শান্তি সব।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত দিনে ভাইবোনদের নিয়ে বাসে চেপে দীঘার সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশে রওনা হয়ে যায় সুপ্রিয়। প্রায় চল্লিশজন যাত্রী নিয়ে কত নদ-নদী, খাল-বিল পেরিয়ে বিশাল লাক্সারি বাসটা ছুটে চলে হাওয়ার গতিতে। বেশ মনোরম আবহাওয়া। রৌদ্রখরদ্বীপ্ত উজ্জ্বল আকাশ। স্নিগ্ধ বাতাস। রূপালী সূর্যকিরণে চারদিক ঝলমল করছে। উঁচুনিচু রাস্তা। রাস্তার দু’ধারে বাতাসে দোলায়িত দণ্ডায়মান কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল-নীল -হলুদ ফুলগুলি যেন সামিয়ানার মতো রঙিন আবরণে ঢেকে আছে। যতদূর চোখ যায় দিগন্তের প্রান্তর জুড়ে সবুজ শ্যামল গ্রাম্য পরিবেশ। যেন কাগজে আঁকা ছবি। প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের উন্মাদনায় ও প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাসের টানে মন-প্রাণ স্বতঃস্ফূততায় ভরে ওঠে সুপ্রিয়র। দীর্ঘকাল পর রুটিনমাফিক একঘেঁয়ে কর্মজীবন থেকে সাময়িক অবকাশ যাপনের অবসরে নিজস্ব গণ্ডি ছেড়ে বাইরের পৃথিবীতে এসে অনুভব করে এক অভিনব আনন্দানুভূতির তীব্র জাগরণ। স্পর্শ করে ওর হৃদয়কে। অপার বিস্ময়ে চলন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে প্রকৃতির রূপ, রং এবং তার মনমুগ্ধকর সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেই যাত্রীবাহী বাসটা যথাসময়ে এসে পৌঁছায় দীঘার পটভূমিতে। প্রায় ন’ঘণ্টা জার্নি করে সুপ্রিয়র ভাইবোন সবাই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। দেহের অবসন্নতায় ওরা রেস্ট নিতে চলে যায় হোটেল স্নোফক্স-এ। কিন্তু সবুর সয়না সুপ্রিয়র। সমুদ্রের গুঞ্জন ভরা বাতাসে এক অদৃশ্য আকর্ষণে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে একাই ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। ততক্ষণে ক্লান্ত সূর্যও অস্তাচলে ঢলে পড়েছে। পূর্ব আকাশের গায়ে আবিরের মতো লাল হয়ে উঠেছে। সমুদ্রের প্রতিটি ঢেউয়ে জলছবির মতো ভেসে ওঠে তার মনোহারি প্রতিবিম্ব। কখনো অনন্ত জলরাশির প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাসে প্রবল হাওয়ায় মুক্তোর মতো ঢেউয়ের সাদা সাদা ফেনা উপচে এসে পড়ছে সমুদ্রের কিনারায়। এক অপরূপ সৌন্দর্য। তারই প্রত্যক্ষ দর্শণে বিস্ময়ে হতবাক, আবেগে অভিভূত সুপ্রিয় পড়ন্ত বিকেলের নির্জনতার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ঝাউবনের দিকে চলে এসেছিল, খেয়ালই করেনি। হঠাৎ ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সুমদ্রের গা-ঘেঁষে নির্জন নিস্তব্ধ বালুচড়ে একাকী এক ভদ্রমহিলা গাঢ় পেঁয়াজি রঙের শাড়ির আঁচলে গা-ঢেকে বসে আছে। আশেপাশে কেউ নেই। কিন্তু দূর থেকে ভদ্রমহিলার চেহারাটা ঠিক বোঝা গেল না। থমকে দাঁড়ায় সুপ্রিয়। ভাবল, কোনো মহিলা একেলা সমুদ্র সৈকতে আসবে না। অন্তত বন্ধু-বান্ধব, বয়ফ্রেন্ড কিংবা পতিদেব কেউ তো থাকবেই। কিন্তু এমন ধূ ধূ মরুভূমির নির্জন এলাকায় বসে ভদ্রমহিলা করছেন কি! আবার পরক্ষণেই ভাবলো, হয়তো সূর্যাস্ত দেখবে বলে অপক্ষো করে আছে। ভাবতে ভাবতে গুটিগুটি পা ফেলে খানিকটা এগিয়ে যায় সুপ্রিয়। ইতিপূর্বে ওকে দেখতে পেয়ে মহিলাটি উঠে দাঁড়ায়। আশঙ্কায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। সুপ্রিয়ও মহিলাটিকে অনুসরণ করে ওর পিছে পিছে এগিয়ে যায়। পাশেই রাস্তা। রাস্তাটা ক্রস করে মহিলাটি দ্রুত হেঁটে হোটেল স্নোফক্সে ঢুকে পড়ে। তার কিছুক্ষণ পর সুপ্রিয়ও গিয়ে ঢুকে পড়ে। কিন্তু দেখা গেল মহিলাটি খুবই বুদ্ধিমতি। হোটেলের ভিতরে ঢুকে সুপ্রিয়কে যে ওয়াচ করছিল ভাবতে পারেনি। মহিলাটি হঠাৎ চাপা আর্তকণ্ঠে বলে ওঠে,
- আপনার স্পর্ধা তো কম নয়! আমায় ফলো করতে করতে আপনি এখানে চলে এসেছেন! সিকিউরিটিকে ডাকবো? বলে ভয়ার্ত চোখে চেয়ে থাকে।
আচমকা অভাবনীয়ভাবে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির কবলে পড়ে মুহূর্তের জন্য হতবাক হয়ে গিয়েছিল সুপ্রিয়। হাঁ করে থাকে। বড্ড এমবেরেসিং ফিল করছিল মনে মনে। তার পরক্ষণে ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকাতেই হঠাৎ মনে হয় কোথায় যেন দেখেছে। খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না। ওর দৃষ্টিশূন্য। ওদিকে ভদ্রমহিলাও মুভ করে না। সুপ্রিয়র আপাদমস্তক লক্ষ্য করে অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। ভাবল, সুঠাম সুদর্শন উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের তরুণ যুবক। পরনে দামী খাদির পাঞ্জাবী। ভদ্রলোকের মতোই চেহারা। ওর পোশাক আর চলার মধ্যেও রয়েছে আভিজাত্যের ছাপ। এর উদ্দেশ্যটা কী? লোকটার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ, আর নয়তো নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টায় অভিনয় করছে। ততক্ষণে সুপ্রিয়র হুঁশ হয় পরিস্থিতি বেগতিক। বিপদ অবশ্যম্ভাবী। ভদ্রমহিলা নাছোড়বান্দা। এক্ষুণিই অশোভন কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। সেটা কিছুতেই সহ্য হবে না সুপ্রিয়র। এইভেবে ঠোঁটের কোণে অস্ফূট একটা হাসি ফুটিয়ে বলল,
- ম্যাডাম, আপনি অযথা উত্তেজিত হচ্ছেন। আনসিকিউর ফিল করছেন। আমিও একজন টুরিষ্ট। এই স্নোফক্সেই উঠেছি। ব্যক্তিগত কারণে চলে এলাম।
ঈষৎ লজ্জা পেয়ে ভদ্রমহিলা বলল,
-সরি! আই অ্যাম সো সরি। ফরগেট ইট। ভুল হয়ে গিয়েছে।
- নো নো, ইউ আর রাইট। চারদিকে যা ঘটছে! বি কেয়ারফুল। আচ্ছা চলি। নমস্কার।
সুপ্রিয় চলে যেতেই ভদ্রমহিলা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এতক্ষণ পর্যন্ত লজ্জায় ওর মাথা কাটা যাচ্ছিল। নিজেই গিল্টি ফিল করে। কিছুতেই স্বস্তি পায় না। সারাক্ষণ শুধু ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিচ্ছবি ওর মস্তিস্কের স্নায়ুকোষে নদীর ঢেউয়ের মতো বারবার ফিরে এসে দেখা দিচ্ছে। রাতেও ঘুমোতে পারেনি। কত আকাশকুসুম ভাবনার জাল বুনতে বুনতে ভোর রাত্রেই চোখটা লেগে আসে। কিন্তু কতক্ষণ! ডবল বেডের একটা রুম। মেম্বার পাঁচজন। ঠেসাঠেসি করে শুলে সেখানে কি আর ঘুম হয়! মাথা ধরে আছে। বিছানা ছেড়ে ওর উঠতেই ইচ্ছে করছে না। বেলা দশটা বাজে। কিন্তু ভদ্রমহিলার বান্ধবীরা ততক্ষণে ব্রেকফাস্ট সেরি তৈরি হয়ে নিয়েছে। ঘুরতে বের হবে। ভদ্রমহিলা আপত্তি করলো না। ওরা বেরিয়ে যেতেই ভদ্রমহিলা বিছনায় শুয়ে শুয়েই রুমের জানালা দিয়ে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস দেখছিল। হঠাৎ শুনতে পায় কে যেন দরজায় নক করছে। ভাবলো রুম সার্ভার এসেছে হয়তো। এই ভেবে শিথিল ভঙিতে বিছানা ছেড়ে নেমে এসে দরজাটা খুলতেই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে।
- স্যার আপনি?
একটা ওয়ালেট হাতে নিয়ে সুপ্রিয় বলল,
- ম্যাডাম, দেখুন তো এটা আপনার কি না!
দেখার আর অপেক্ষা রাখে না। ওয়ালেটটা ঝট করে সুপ্রিয়র হাত থেকে নিয়ে ভদ্রমহিলা বলল,
- এটা কোথায় পেলেন? কাল থেকে তন্ন তন্ন করে খুঁজজি। ভাগ্যিস, আপনার হাতেই পড়েছিল!
কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি হেনে বলে,
- আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে কেন, ভিতরে আসুন না!
- না না, আজ নয়। অন্য আরেকদিন। স্নোফক্সেই তো আছি। পরে কথা হবে।
ভদ্রমহিলা নাছোরবান্দা। - আমরা স্নোফক্সে বাসা বেঁধেছি না কি? দু-চারদিন পর তো সবাই চলেই যাবো। আর দেখা হবে কোথাও? কিছুক্ষণ থেমে বলল, -আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি নীচে গিয়ে বসুন। আমি এক্ষুণি চেঞ্জ করে আসছি। বলে ভদ্রমহিলা দ্রুত রুমে ঢুকে পড়ে। আবেগের বশীভূত হয়ে কেন যে কথাটা বলে ফেলল, সুপ্রিয় নিচে নেমে যেতেই দ্বিধাদ্বন্দ্বের টানাপোড়নে নিজেই ফেঁসে যায়। নিজেকে বড্ড হেয় মনে হয়। চেনা নেই শোনা নেই একজন অচেনা মানুষের সাথে যেচে আলাপ করা ওর রুচিতে বড্ড লাগছে। অগত্যা, করণীয় কিছু নেই। এক মুখের বুলি আর বন্দুকের গুলি একবার ছুটে গেলে তাকে আর কখনো ফেরানো যায় না। বাধ্যতামূলক শারীরিক অবসাদ ঝেড়ে ফেলে চটপট ফ্রেস হয়ে মেরুন রঙের একটা শাড়ি পড়ে নিচে নেমে আসে। অস্ফূট একটা হাসির রেখা ফুটিয়ে সুপ্রিয়কে বলল, - চলুন, গেস্টরুমে গিয়ে বসি।
সদ্য পরিচয় প্রসঙ্গে একজন মহিলার সাদর আহ্বানে যেটুকু জড়তা ছিল সম্পূর্ণ কেটে গেল সুপ্রিয়র। মনে মনে সংকোচবোধ করলেও রিফিউজ করলো না। সৌজন্যমূলক কুশল বিনিময় করতে করতে হাঁটতে থাকে দুজনে। কিন্তু ভদ্রমহিলার অলক্ষ্যে হঠাৎ পলকমাত্র দৃষ্টিতে সুপ্রিয়র নজরে পড়ে, ভদ্রমহিলার আকর্ষণীয় রূপরাশি, পূর্ণতা ও উষার প্রথম সূর্যের মতো টকটকে লাল চেহারার সৌন্দর্য ও বুদ্ধিদীপ্ত চোখের চাহনি ওর মনোহরণ করলো। ওকে বিস্মিত করলো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ভদ্রমহিলার রাঙ্গা মুখমণ্ডলের দিকে পলকহীন নেত্রে চেয়ে থাকে। ওকে ক্রমশ উৎসুক করে তোলে এক অভিনব ইচ্ছা, আবেগ-অনুভূতি। জাগিয়ে তোলে নতুন করে বেঁচে থাকার সাধ। ভিতরে ভিতরে টের পায় মনের মধ্যে রসসঞ্চার হবার একটা তীব্র অনুভূতি। এক অব্যক্ত ভালোলাগার তীব্র জাগরণ। সে এক সম্পূর্ণ নতুন বিস্ময়। নতুন চেতনা। নড়ে ওঠে ওর প্রাণস্পন্দন। তৎক্ষণাৎ রোমহর্ষক একটি কোমল শিহরণের ধাক্কা এসে লাগলো ওর হৃদয় পটভূমিতে। চমকে ওঠে সুপ্রিয়। যখন গহীন অনুভূতি দিয়ে জীবনে প্রথম অনুভব করে, এর নামই কি প্রেম, ভালোবাসা! ভালোবাসায় এতো সুখ! এতো আনন্দ! অথচ ধূসর মরুভূমির মতো আবেগ-অনুভূতিহীন এবং নিরুচ্ছ্বাস, নিঃপ্রেম সুপ্রিয়র হৃদয় আকাশেও যে একদিন ভালোবাসার গ্রহণ লাগবে, প্রেমের পত্তন ঘটবে তা ও কখনো কল্পনাই করেনি। নিজেই নিজের মনকে প্রশ্ন করে, ওর মনের এই আকুলতাকে উপেক্ষা করে আচমকা ভালোলাগা আর ভালোবাসার ইচ্ছা-আবেগের এমন গহীন অনুভূতিগুলি এতকাল কোথায় লুকিয়ে ছিল!
তবু রুপিগত সৌজন্যে ক্ষণিকের সঞ্চিত ভালোলাগার আবেশটুকু এক অদৃশ্য অনুভূতিতে গেঁথে রাখে। ভিতরে ভিতরে অস্ফূট একটা খুশির আমেজে মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। ওকে কাঁপিয়ে দিয়ে ভদ্রমহিলা বলল, - কলকাতা থেকে এসেছেন বুঝি!
- এ্যাঁ, হ্যাঁ কলকাতা থেকে এসেছি। আর আপনি?
- আমিও কলকাতা থেকে এসেছি। তা কলকাতায় কোন জায়গায়?
- নিউ ব্যারাকপুরে। এই তো বছর দুয়েক হয়েছে আমরা এসেছি।
- ওমা তাই নাকি! নিউ ব্যারাকপুরে তো আমার মামার বাড়ি!
শুনে চমকে ওঠে সুপ্রিয়। বলে, - এ্যাঁ, নিউ ব্যারাকপুরে! নিউ ব্যারাকপুরে কোথায়?
- ওই যে, গভর্নমেন্ট কলোনিতে!
- সে কি! আমরাও তো গভর্নমেন্ট কলোনিতে থাকি! কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, -কত নম্বর ব্লকে থাকে বলুন তো!
- বি/৬ এর...! কথা শেষ না হতেই সুপ্রিয় বলল, -বি /৬-এর ৫৬৫ নম্বর ফ্ল্যাট বাড়িটা?
- হ্যাঁ, ওটাই তো! কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?
দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত হয়ে সুপ্রিয় বললো, - এতক্ষণে ক্লিয়ার হওয়া গেল! আপনিই মিস অলকা, তাই না?
- হ্যাঁ, আমিই অলকা! কিন্তু আপনি জানলেন কি করে? আশ্চর্য!
কিছুক্ষণ থেমে মুখ টিপে হেসে ফেলল অলকা। মাথাটা নেড়ে বলে, - হুঁম, এইবার বুঝেছি, আপনিই বোধহয় সেই সুপ্রিয় বাবু, মনে পড়ে? অ্যাম আই রাইট?
অস্ফূট হেসে ফেলল সুপ্রিয়। হাসিটা বজায় রেখে বলল, - ইয়েস ম্যাডাম, আমিই সুপ্রিয়। কেমন আছেন?
ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি ফুটিয়ে অলকা বলল, - দেখলেন, কেমন চিনে ফেললাম বলুন তো!
- কিন্তু এভাবে আমাদের দেখা হবে, কখনো ভাবতে পারিনি! কিন্তু ম্যাডাম আপনি একা কেন? সঙ্গে আর কেউ আসেনি?
- না না, পাগল নাকি। আমরা বান্ধবীরা সবাই মিলে একসাথে এসেছি। আপনি আসবার আগেই তো ওরা বেরিয়ে গেল। একেবারে সূর্যাস্ত দেখেই তবে ফিরবে।
- আপনি গেলেন না কেন?
- আসলে সকাল থেকে মাথাটা বড্ড ধরেছিল। বিছানা থেকে তুলতেই পাচ্ছিলাম না। একটা অ্যাস্প্রিন খেয়ে অনেক বেলা পর্যন্ত শুয়েছিলাম। এখন একটু বেটার ফিল করছি। ভালোই হলো আপনি এসেছেন, গল্প করা যাবে।
- কেন, সূর্যাস্ত দেখতে যাবেন না? মানুষ সূর্যাস্ত-সূর্যোদয় দেখতেই তো এখানে আসে।
মনে মনে অবাক হয় অলকা। দুদিনের আলাপনে এতখানি আন্তরিকতা? এতখানি ঘনিষ্ঠতা? যেন কতদিনের চেনা জানা, পরিচিত। অথচ আড়ষ্টতার ভাব এখনও যায়নি। সেটা ওর চোখমুখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু ওযে একজন স্কুল টিচার, এডুকেটেড সেটা একেবারে নিঃসন্দেহ। ওর কথাবার্তা, আচার আচরণে স্পষ্ট ধরা পড়ে। ওর চেহারায় আভিজাত্যের ছাপটাও নজরে এড়ায় না অলকার। মনমানসিকতাও স্বচ্ছ এবং কোমল। অথচ মাত্র আঠারো ঘণ্টা আগে মনের সংশয় সংকটে কি ভয়াবহ ভাবনায় তলিয়ে গিয়েছিল অলকা। যে মানুষটা ছিল ওর সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। যার প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না, উৎসাহ ছিল না। মুখের দিকে ভালো করে চেয়েও দেখেনি। আর এ মুহূর্তে একটু নৈকট্য লাভের আশায় ওর ইচ্ছে হচ্ছে সারাক্ষণ সুপ্রিয়র সাথে বসে বসে গল্প করতে। ঘুরে বেড়াতে। ওর সান্নিধ্যে থেকে মনকে বিকশিত করতে। কিন্তু নির্লজ্জ বেহায়ার মতো এসব কথা কখনো কি বলা যায়! চকিতে নীরবতা ভঙ্গ করে বিষণ্ণ গলায় বলল, - দূর, ইচ্ছে করছে না! অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হবে। একা একা ভালো লাগে!
- কেন? একা যাবেন কেন? আপত্তি না থাকলে আমিই সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি।
- আপনাকে সঙ্গে দেখলে আমার বান্ধবীরা কী ভাববে জানেন?
অসন্তোষ গলায় সুপ্রিয় বলল, - ও আই সি! এতক্ষণ বুঝি এসব কথাই ভাবছিলেন।
ফিক্ করে হেসে ফেলল অলকা। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, - আপনি কিন্তু আপনার সম্বন্ধে কিছুই বললেন না। সঙ্গে কে এসেছে! কার সাথে এসেছেন। কাউকেই তো দেখছি না!
- না না এসেছে! ওই তো আমার ভাইবোন দুজনেই সমুদ্রের ধারে ঘুরছে। ছোটবোন ঝিনুক কুড়োবে বলল, তাই হাঁটতে হাঁটতে ওইদিকটায় চলে গিয়েছিলাম। তারপরই তো দেখলাম, সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় চিক্ চিক্ করে উঠেছে আপনার ওই ওয়ালেটটা!
গেস্টরুমের কাছে গিয়ে সুপ্রিয় বলে, - দেখছেন, গেস্টরুম ফুল হয়ে গেছে। বসবার জায়গা নেই কোথাও। চলুন আমরা গার্ডেনে গিয়ে বসি। বেশ মনোরম হাওয়া বইছে বাইরে। টাইম হলে সানসেট দেখতে যাবো।
মুখে কিছু বলল না অলকা। চোখদুটো ওর উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে ওঠে। সুপ্রিয় বাবু কি অন্তর্যামী? ওতো এমনটাই চাইছিল মনে মনে। অব্যক্ত ভাষায় সুপ্রিয়র মুখের দিকে একপলক চেয়ে শাড়ির আঁচলটা টেনে গা-টা ঢেকে নিয়ে বলে, - বেশ, কিন্তু আমার একটা অবজেকশন আছে। সারাক্ষণ ওই ম্যাডাম বলে সম্বোধন করা চলবে না।
- ওমা তাতে কি হয়েছে!
- ওসব জানি না। আমার নাম আছে, নাম ধরে ডাকবেন ব্যাস। বলতে বলতে সুপ্রিয়র পিছে পিছে গার্ডেনের দিকে এগিয়ে গেল।
(চলবে)
বাংলাদেশ সময়: ১০০৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১৬
এমজেএফ/
** অনুভূতি | যুথিকা বড়ূয়া (পর্ব-১)