ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

অনুভূতি | যুথিকা বড়ূয়া (পর্ব-৪)

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৬
অনুভূতি | যুথিকা বড়ূয়া (পর্ব-৪)

ছয়.
সারারাত একটুও ঘুম হয়নি অলকার। অপরিসীম উৎকণ্ঠায় রাত কাটিয়েছে।

চোখের পাতা দু’টিকে কিছুতেই এক করতে পারেনি। সারাক্ষণ মনের আয়নায় শুধু সুপ্রিয়কেই দেখেছে। অপ্রত্যাশিত ওর আগমন, উপস্থিতি এবং ওর অমায়িক আন্তরিকতার অভিব্যক্তিটুকু ওকে বুঁদ করে রেখেছিল। কানে বাজছিল ওর কথোপকথনের গুঞ্জরণ, পদাচরণ। বিগত দু’দিনে প্রায় বারো/তেরো ঘণ্টা সুপ্রিয়র সান্নিধ্যে কাটিয়েছে। মনের অজান্তে কখন যে দুজনে পাশাপাশি বসে অন্তরঙ্গ আলাপনে মেতে উঠেছিল খেয়ালই ছিল না। কত গল্প, কত হাসি-কলতান। কখনো মুহূর্তের জন্যেও মনকে দুর্বল করে দেয়নি। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের বিদ্যান, বুদ্ধিমান, রুচিসম্মত সুদর্শন যুবক সুপ্রিয়র মুখের দিকে চোখ তুলে কখনো চেয়ে দেখেনি। কোনো ভাবান্তর হয়নি মনের মধ্যে। যখন হীনমন্যতায় স্বার্থপর, ঈর্ষাণ্বিত প্রশান্ত হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় ওকে আক্রমন করতে এসেছিল, তখন মেঘের আড়ালে উদ্ভাসিত সূর্যের একফালি রশ্মির মতো সুপ্রিয়ই ওর পাশে এসে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ওকে  অনিবার্য বিপদ থেকে রক্ষা করেছিল। তখনও মনকে বিগলিত করেনি। কোনো রেখাপাত করেনি। আজ হঠাৎ মানসিক বিবর্তনে নিমেষে দূরীভূত হয়ে যায় হৃদয়ে জমে থাকা পরাজয়ের আত্মগ্লানি। নতুন করে দেখতে পায় আশার কিরণ। রাতভোর শুধু সুপ্রিয়কে ভুল বোঝার অনুতাপ অনুশোচনার দগ্ধে বারবার ওর মনের গভীরতায় হারিয়ে গিয়েছিল। তলিয়ে গিয়েছিল আকাশকুসুম ভাবনার অতল তলে। সে এক নতুন ভুবনে। যেখানে ওরা দুজনই ছিল একমাত্র বাসিন্দা। মধুময় চন্দ্রালোকে বিনিদ্র মধ্যরাত্রির গাঢ় নিস্তদ্ধতায় জানালার ধারে দাঁড়িয়ে শুধু অনুভব করে, সুপ্রিয়র প্রতি এক অদৃশ্য আকর্ষণের মায়াজালে ওর আত্মার সাথে অক্টোপাসের মতো ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছে। ওকে দুর্বল করে দিচ্ছে। যেখানে জড়িয়ে থাকে আন্তরাত্মা, হৃদ্যতা। এক অটুট বন্ধন। যার ভিত্তিতে জন্ম নেয় বিশ্বাস আর ভালোবাসা। যা বহুদিন আগেই ওর হৃদয় থেকে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। আজ যেন নতুন করে প্রেম-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ওঠে অলকা। যে ভালোবাসায় খুঁজে পায় ওর অস্তিত্ব, জীবনে বেঁচে থাকার সাধ। আবিষ্কার করে সুপ্রিয়কে সে ভালোবাসতে শুরু করেছে। সুপ্রিয়ই একমাত্র হতে পারে ওর জীবনসাথী। ওর হৃদয়নামক বিশাল সাম্রাজ্যের একমাত্র সম্রাট। যাকে ওর হৃদয়ের রাজ সিংহাসনে দেবতার আসনে বসিয়ে অকুণ্ঠিত হৃদয়ে উজার করে ঢেলে দেবে ওর নিঃসৃত ভালোবাসা। সঁপে দেবে নিজেকে। যা ক্ষণপূর্বেও কল্পনা করতে পারেনি। কিন্তু তা আর সম্ভব হবে কী করে? সে সুযোগ তো নিজেই অবহেলায় হারিয়ে এসেছে। বিচলিত হয়ে ওঠে অলকা। আজ কেমন করে সুপ্রিয়র সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াবে। মাথা কূটে মরে গেলেও কিছুতেই তা আর ফেরানো যাবে না। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় সারারাত অস্বস্তির সাগরে ভেসে বেড়ায়।

পরদিন ঊষার প্রথম প্রহরে ভারাক্রান্ত মনে বিছানা ছেড়ে নৈঃশব্দে নেমে আসে অলকা। ওর বান্ধবীরা কেউ টের পেলো না। ক্লান্ত দেহের অবসন্নতায় নিদ্রাদেবীর বাহুমণ্ডলে সবাই অচৈতন্যে বিভোর। নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। কাউকে ডাকলোও না। বিরক্তও করলো না। মুখ হাত পা ধুয়ে ফ্রেস হয়ে তৈরি হয়ে অতি সন্তর্পণে লাগেজটা নিয়ে হোটেল স্নোফক্স থেকে বেরিয়ে আসে রাস্তায়। তখন পৌনে পাঁচটার মতো হবে। রাস্তা জনশূন্য। ঠান্ডা আবহাওয়া। এদিক ওদিক তাকিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে লক্ষ্য করে দ্রুত হাঁটতে থাকে। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে দু-একজন মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছে। ততক্ষণে সদ্য উদিত সূর্যের কোমল স্নিগ্ধ আলোর আভায় দিগন্তের প্রান্তর জুড়ে লাল হয়ে উঠেছে। তারই একফালি আলোর রশ্মিতে অলকার সুবর্ণ শাড়ির আঁচল চিকচিক করছে। ওর চেহারার লাবণ্য আরো গাঢ় হয়ে ফুটে উঠেছে।
 
একসময় বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যায় অলকা। চেয়ে থাকে শূন্য দৃষ্টিতে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে বাস এসে পড়বে। চলে যেতে হবে অনেক দূরে। সুপ্রিয়র জীবন থেকে অনেক দূরে। চিরদিনের মতো ওর জীবন থেকে হারিয়ে যাবে সুপ্রিয়। হয়তো কোনোদিনও আর দেখা হবে না।

ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। অজান্তে কখন যে সুপ্রিয় ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, টেরই পায়নি। অপ্রত্যাশিত ওকে দেখে একেবারে থতমত খেয়ে যায়। বুক ধুক ধুক করে ওঠে। কী বলবে ভাষাই খুঁজে পায় না। ইতস্ততবোধ করে। একরাশ বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকে সুপ্রিয়র মুখের দিকে। যেন চোর ধরা পড়ে গিয়েছে। শুকনো একটা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে, একি সুপ্রিয় বাবু, আপনি এখানে! এই অসময়ে?

অভাবনীয়ভাবে আচমকা অলকার দর্শনে মনে মনে বিস্ময়ের ঘোরে পড়ে গেলেও খানিকটা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় সুপ্রিয়র পাল্টা জবাব। ‘এ প্রশ্ন তো আমিই করার কথা! আপনি এখানে কেন? লাগেজ নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? আপনার বান্ধবীরা সব কোথায়?’

চমকে ওঠে অলকা। যেন কত আপনজন ওর। পড়ে যায় বিপাকে। উপস্থিত কোনো উত্তর এ মুহূর্তে ওর কাছে নেই। কিছুক্ষণ থেমে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, এত আর্লি মনিং ঘুম থেকে উঠে এলেন! প্রাতঃভ্রমণের অভ্যাস আছে বুঝি! আরেকটু আগে এলে সানরাইজ দেখতে পেতেন।

মুখে না বললেও বুঝতে বাকি থাকে না সুপ্রিয়র। ওর ডাউট হয়, নিশ্চয়ই গতকালের ঘটনায় নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চাইছে। ওর চোখের আড়াল থেকে, ওর সান্নিধ্য থেকে একেবারে দূরে চলে যেতে চাইছে। ভাবতেই মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেল। অস্ফূট হেসে বলল, মিস গাঙ্গুলি, আগামীকাল ভোরেও সানরাইজ দেখা যাবে। কিন্তু আপনাকে আর দেখব বলে মনে হচ্ছে না। দেখা না করেই চলে যাচ্ছিলেন! একটু বললেন না! আমি তো জানতামই না আপনি আজই চলে যাবেন। এত কঠোর আপনার হৃদয়? একবার মনে পড়লো না! অন্তরে আবেগ অনুভূতি কিছুই কি নেই আপনার? বাট হোয়াটস রং উইথ ইউ মিস গাঙ্গুলি? শুধু আপনিই কেন? আপনার বান্ধবীরা কোথায় গেল?
গম্ভীর হয়ে অলকা বলল, সব কথার উত্তর হয় না সুপ্রিয় বাবু! আপনি বলুন, এতো আর্লি মনিং আপনি এখানে কী করছেন?

- বাব্বা, এখনো চটে আছেন মনে হচ্ছে! অ্যাকচুয়েলি আমাদের রুমের এসিটা এত হাই পাওয়ারে চলছিল, সারাঘর একেবারে হিম হয়ে আছে। ঠান্ডায় শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠতেই ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম ভোর হয়ে গিয়েছে। তাই ভাবলাম বাইরে থেকে ঘুরে আসি। তা কেমন সংযোগ দেখুন, আমি তো এস্পেক্টই করিনি। দূর থেকে দেখলাম একা একজন মহিলা বাসস্টপেজের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ কী মনে হলো, এদিকটায় কখন চলে এসেছিলাম খেয়ালই করিনি। দেখা হয়ে গেল আপনার সাথে। এটা কি কোয়েন্সিডেন্স নয়? কিন্তু ব্যাপার কি বলুন তো! আপনাকে এত ক্লান্ত লাগছে কেন? রাতে ঘুমোননি মনে হচ্ছে! এমন কী ঘটল আবার! তা সেরকম কোনো প্রবলেম হলে আপনি একবার আমায় জানাতে পারতেন! বিগত দিনে আমাদের মেলামেশায় কোনো সম্পর্কই কি গড়ে ওঠেনি? অন্য কিছু না হোক, বিশ্বাস আর ভরসার একটা বন্ধন, যার নাম বন্ধ‍ুত্ব। আপনি পারবেন তা অস্বীকার করতে? এটা একবিংশ শতাব্দি। যুগের সাথে সাথে মানুষের রুচি, ধ্যান-ধারণা অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে। পৃথিবীতে যদি নারী-পুরুষের মেলামেশার অর্থ একটাই হতো তাহলে বর্তমান যুগের মহিলারা পুরুষ মানুষের সাথে ইকুয়েল হয়ে কখনোই চলতে পারতো না। কত গল্প গুজব করলাম। আনন্দ-বেদনার কত ঘটনা শেয়ার করলাম। অনুভব করলাম, উপলব্ধি করলাম, উভয় উভয়কে চিনলাম, জানলাম কোম্পানি দিলাম। এতো শিগগিরই আমায় পর করে দিলেন? আমি কি আপনাকে ধরে রেখে দিতাম? কি মুশকিল, আপনি কিছু বলুন! অ্যাটলিস্ট বিদায় বেলায় একটু হাসি মুখে দর্শন দিন!

কিন্তু কী বলবে অলকা। অপ্রত্যাশিত সুপ্রিয়র দর্শন ও প্রেমিকসুলভ আচরণে সব কেমন ওর এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নতুন করে ভালোলাগা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ওঠে ওর মন-প্রাণ সারাশরীর। রুদ্ধ হয়ে আসে ওর কণ্ঠস্বর। হঠাৎ সুপ্রিয়কে একান্ত আপন করে কাছে পাবার এক অভিনব ইচ্ছা ওকে ক্রমশ উৎসুক করে তুলছে। বুকের ভিতরে অদ্ভুদ এক অনুভূতি স্পর্শ করে ওর মনকে। ভিজিয়ে দেয় ওর কোমল হৃদয়কে। রোমহর্ষক একটি কোমল শিহরণে শিহরিত হয় সারাশরীর। যা রক্তের স্রোতের মতো প্রতিটি শিরা-উপশিরায় ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। কেঁপে ওঠে হৃদয়স্পন্দন। যা কল্পনা শক্তিকে উদ্দীপ্ত করে, বিকশিত করে। আর সেটা গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে গিয়ে বেমালুম হারিয়ে যায় এক অভাবনীয় কল্পনার সাগরে। যেখানে ছলনা নেই, স্বার্থ নেই, চাহিদা নেই, ঈর্ষা নেই, ক্রোধ নেই, নেই অসামঞ্জস্যতা, অনৈতিকতা, মান-অভিমান, অভিযোগ, অনুযোগ কিছুই নেই। আজ সমুদ্রসৈকতে এসে জীবনে প্রথমবার অনুভব করে, পৃথিবীর সব পুরুষ মানুষ সমান নয়। সবার বিবেক-বিবেচনা, মানবিক মূল্যবোধ, রুচিবোধ সমান নয়। আজ যেন নতুন করে বেঁচে থাকার একটা আশার কিরণ দেখতে পায় অলকা। মনে সাধ জাগে, ভরসা জাগে। ইচ্ছে হচ্ছে সুপ্রিয়র উষ্ণ সান্নিধ্যে থেকে জীবনকে নতুন রঙে সাজিয়ে তুলতে। কিন্তু আজ তা কোনো মতেই আর সম্ভব নয়। ভালোবাসা বেচা কেনার দ্রব্যসামগ্রী নয় যে চাইলেই যখন তখন পাওয়া যাবে। কিন্তু মানুষ যা চায় তা কোনদিনও পায় না। মনের সাধ আহ্লাদ কখনো পূরণ হয় না। জীবনে অনেক চাওয়া পাওয়া, মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণই থেকে যায়। যা সুপ্রিয়র মতো একজন সহজ সরল নির্ভেজাল মানুষ কোনোদিনও বুঝতে পারবে না। বোঝার চেষ্টাও করবে না। কিন্তু মানুষ পরিবর্তনশীল। সুপ্রিয়র মনের ঠিকানা ওইবা জানবে কী করে? আজ ওরা দুজন দুইপ্রান্তের পথিক। অথচ দুজনারই গন্তব্যস্থল একই মোহনায়। যা দুজনার কেউই জানে না।

হঠাৎ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বাতাসে দোলায়িত বিশাল কদমগাছের ডালে বসে থাকা একটি ছোট্ট পাখির মিষ্টি সুরের মূর্ছনায় চমকে ওঠে অলকা। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই কোলকাতা যাবার বাস এসে পড়বে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে চিরদিনের মতো। মুহূর্তের জন্য ইচ্ছে হচ্ছিল সুপ্রিয়র বুকের উপর আছড়ে পড়তে। স্বেচ্ছায় নিজেকে ধরা দিতে। সুপ্রিয়র প্রেম আহ্বানে সাড়া দিতে। ওর জীবনের সাথে সম্পৃক্ত রাখতে। কিন্তু অবলীলায় কিছুই করতে পারলো না অলকা। সুপ্রিয়র এত সন্নিকটে থেকেও পারলো না নিজেকে ধরা দিতে। হারিয়ে যায় ওর মুখের ভাষা। মনের শক্তি। গতকাল সারারাত মনের সাথে যুদ্ধ করে, কত জল্পনা কল্পনা করে বিগলিত মনকে পোষ মানিয়ে কলকাতায় একাই ফিরে যাবার সংকল্প করেছিল। বিগত দিনে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনাগুলিকে একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে সুপ্রিয়কে ভুলে গিয়ে নিজেকে মানব কল্যাণে উৎসর্গ করে দেবার চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

হঠাৎ দৃষ্টি বিনিময় হতেই চকিতে চোখের পাতাদুটি ন‍ুয়ে পড়ে অলকার। চোখ তুলে তাকাতেই পারে না। ঝটকা লেগে গেল সুপ্রিয়র। নিজের চোখ দুটোকে ওর বিশ্বাস হয় না। সবিস্ময়ে বিড়বিড় করে ওঠে মনে মনে। আশ্চর্য, ক্ষণপূর্বেও অলকার কণ্ঠস্বরে ছিল তীব্রতা, বিষন্নতা। অথচ তুলনামূলকভাবে আজকের অলকা জমিন আসমান ফারাক। খোলা কিতাবের মতো না বলা কথাগুলি ওর চোখের পাতায় সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। কী অসহায় চোখের চাহনি। কিছু বলার ব্যাকুলতায় ঠোঁটদুটো ওর কেঁপে উঠছিল। কিন্তু সুপ্রিয় তখন ইমোশনালি দুর্বল হয়ে পড়লেও ভিতরে ভিতরে অস্বস্তিবোধ করছিল। যার জন্য ক্ষণপূর্বেও প্রস্তুত ছিল না। ওইবা কম কিসে! আফটার অল ও’ একজন পুরুষ মানুষ। কেন মাথা নত করতে যাবে! এ কেমন বিধাতার দুটি কোমল হৃদয়ের মিলন ঘটবার অন্তিম প্রয়াস!

ইতিমধ্যে কলকাতার এক্সপ্রেস বাস এসে দাঁড়াতেই সুপ্রিয় অবিলম্বে নমস্কার জানিয়ে বলল, আচ্ছা চলি। হ্যাভ এ সেভ জার্নি। টেক কেয়ার অফ ইওর সেলফ। গুড বাই।
 
একটা শব্দও আর উচ্চারিত হয় না অলকার। পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ ও নিজেই নিজের কাছে হেরে গেল। জীবনের পরম আশা আকাঙ্ক্ষাগুলি শুকনো ফুলের মতো ওর হৃদয় থেকে নিরবে ঝরে গেল। মিটালো না মনের সাধ। হৃদয়দ্বারে এসেও লজ্জা ও সাহসের অভাবে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল সুপ্রিয়। ইচ্ছে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে ওর পুরুষালি দেহের উষ্ণ আলিঙ্গনে বুঁদ হয়ে থাকতে। ওর নীরব ভালোলাগার আবেশ ও ভালোবাসার অবগাহনে নিমজ্জিত হয়ে থাকতে। কিন্তু কোনো ইচ্ছাই পূরণ হলো না অলকার। ওর সম্মুখেই চলে গেল সুপ্রিয়। চোখদুটো ওর অশ্রুকণায় সিক্ত হয়ে উঠল। ওকে যতদূর দেখা গেল সাশ্রুনয়নে সেদিকেই চেয়ে থাকে। সুপ্রিয় অদৃশ্য হয়ে যেতেই শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে ওঠে। ওর হৃদয়ের কষ্ট বেদনাগুলি সব তরল হয়ে দু’চোখ বেয়ে অঝরে ঝড়তে লাগল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শরীরের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে শুধু একটাই অনুভব করে, সুপ্রিয়কে সত্যিই সে ভালোবেসে ফেলেছে। চেয়েছিল সুপ্রিয়কেই ওর জীবন সঙ্গী করতে। ওর হৃদয় নিংড়ানো অকৃত্রিম ভালোবাসা উজার করে ঢেলে দিতে। ওতো স্বয়ং নিজেই দিতে এসেছিল জীবনের চাওয়া পাওয়ার সব অধিকার, ভালোবাসার অধিকার। যা পাওয়ার আগেই হারিয়ে গেল।
ক্রমশ গলা ভারী হয়ে আসে অলকার। কম্পিত স্বরে স্বগতোক্তি করে ওঠে, ‘কেন আমায় বাঁধা দিলে না সুপ্রিয়! কেন একবার বললে না, তুমি যেও না অলকা! অনেক আশা করেছিলাম, প্রেম-আহ্বানে দু‘হাত প্রসারিত করে তুমি আমার সম্মুখে এসে দাঁড়াবে। আমায় বাধা দেবে। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে উপেক্ষা করে তোমার উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে আমায় প্রেমের ডোরে বেঁধে নেবে। ভালোবাসা নামে পবিত্র শব্দটি কেন একবার মুখ ফুটে উচ্চারণ করতে পারলে না সুপ্রিয়! আমি যে তোমার প্রিয়তমা হতে চেয়েছিলাম। তোমায় পেয়ে ধন্য হতে চেয়েছিলাম। তুমি জানতেও চাইলে না সুপ্রিয়! জীবনে একটা মানুষ চেয়েছিলাম ঠিক তোমারই মতো একজন সৎ, মহৎ, আত্মসংযমী ও আবেগপ্রবণ একটা মানুষ। তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো। তোমায় কোনদিনও ভুলবো না। অনুভব করবো দূরে নয়, তুমি আমার কাছেই আছো। আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে। আমার স্মৃতির গ্রন্থিতে। এ অদৃশ্য অনুভূতিতে।

একসময় বাস চলতে শুরু করে। ভারাক্রান্ত মনে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকে অলকা। যতক্ষণ বাস চলেছে সারাক্ষণ মনমরা হয়েই ছিল। মনে আনন্দ ছিল না। উৎসাহ ছিল না। মুখে রুচি ছিল না। ইচ্ছা অনুভূতি কিছুই ছিল না। সারাদিন চলতে চলতে ঠিক রাত আটটা নাগাদ এক্সপ্রেস বাসটি মহানগরী কলকাতা শহরে এসে পৌঁছায়। পৌঁছাতেই অলকার চিন্তা হয়, এখনো আরো দু-তিন ঘণ্টার রাস্তা। যেতে হবে। রাত যত বাড়বে, রাস্তাঘাটও তত জনশূন্য হয়ে যাবে। ক্ষীণ আলো অন্ধকারে একলা মহিলা, সাথে কেউ নেই। মনে মনে বড্ড ভয় হচ্ছিল অলকার।
ইতিমধ্যে বাসটি এক্সপ্লানেডে ঢুকতেই চমকে ওঠে। তবু রাত্রির অন্ধকারে ক্ষীণ আলোয় সঠিক বোঝা গেল না। ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব চারিদিকে। তন্মধ্যে এই সময়টাতে স্ট্রিটের আলোর তীব্রতাও খুব কমই থাকে। ভাবল, ওর চোখের ভুল! কিন্তু না, বাস থেকে নেমেই দেখে, সহাস্যে শৈলেন মামু দাঁড়িয়ে আছেন। অন ডিউটিতেই গাড়ি নিয়ে চলে এসেছেন। আশ্চর্য, এ সম্ভব হয় কী করে! মুহূর্তের জন্য স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে অলকা। স্তম্ভিত হয়ে যায় বিস্ময়ে। শূন্যদৃষ্টিতে হাঁ করে চেয়ে থাকে। ওর ফিরে আসার সংবাদ ওতো কেউকেই জানায়নি। ফোনেও কারো সাথে কথা বলেনি। তাহলে? আবার পরক্ষণেই ভাবলো, মিলি এসে কিছু বলেনি তো! কিন্তু ওইবা বলবে কোন সাহসে! বললেই তো ধরা পড়ে যাবে। ও’ নিশ্চয়ই মামার বাড়ির নাম করে ওই শয়তানটার সাথে পিরীত করতে গিয়েছিল।
হঠাৎ শৈলেন চক্রর্তীর গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরে ওর চমক ভাঙে। কি ব্যাপার ওলি? একলা কেন? বাকি সব ওরা কোথায়?

বিস্ময়ের ঘোরে পড়ে গেলেও এক নিমেষেই শারীরিক ও মানসিক অবসাদ ঝরে গেল অলকার। একগাল হেসে সজোরে একটা হাগ দিয়ে বলল, হোয়াট এ সারপ্রাইজ মামু! তুমি কার থেকে খবর পেলে? তুমি জানো!

অলকার কথা শেষ না হতেই শৈলেন চক্রবর্তী পাল্টা প্রশ্ন করলেন, কী হয়েছিল? তুই কার সাথে ঝগড়া করে এসেছিস? আমি সব খবর পেয়েছি।
- কারো সাথেই না। কিন্তু তোমায় খবর কে দিলো? কে বলেছে তোমায় এসব কথা?
- সুপ্রিয়কে তুই কবে থেকে চিনিস?

সুপ্রিয়র শুনতেই বুকটা ধড়াস করে ওঠে অলকার। নিজের মামা হলেও শৈলেন চক্রবর্তী পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। তাঁর কণ্ঠস্বরে সাধারণ মানুষই কেঁপে ওঠে। তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে মিথ্যে বলার স্পর্ধা এখনো ওর হয়নি। কিন্তু মুখ খুললেই দীঘার সমুদ্রসৈকতের সব কেচ্ছা-কাহিনী ওর জবানবন্দিতে ধরা পড়ে যাবে। তার চেয়ে অ্যাভয়েড করা ছাড়া আর কোনো গতি নেই। অগত্যা, না চেনার ভান করে ডাহা মিথ্যা কথাই বলে দিলো। কে সুপ্রিয়? আমি কোনো সুপ্রিয়কে টুপ্রিয়কে চিনি না।

গম্ভীর হয়ে শৈলেন চক্রবর্তী বললেন, আমাদের কলোনির ডি/৬-এর ৫৬৭ নম্বর ফ্ল্যাটের সুপ্রিয় ব্যানার্জিকে তুই চিনিস না? না হলে ম্যাসেজটা আমায় ও’ দিলো কী করে?

অলকা নিরুত্তর। কোনো কথাই আর মুখ দিয়ে বের হয় না। সমানে বুক ধুক ধুক করে। কোণা চোখে তাকিয়ে মামুর মুডটা বোঝার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে শৈলেন চক্রবর্তী বললেন, আচ্ছা গাড়িতে গিয়ে বোস এখন, অনেক কথা আছে।

অলকা হনহন করে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে পড়ে। গাড়ি স্টার্ট করেই শৈলেন চক্রবর্তী বললেন, সুপ্রিয় নিজে টেলিফোন করে আমায় জানিয়েছে। সেই সৌজন্যে আরো অনেক কথা হলো। ওর প্রতিটি কথায় আমি একটাই নোটিশ করলাম, তোর প্রতি ও’ খুব আগ্রহী, ইন্টারেস্টেড। কত রেসপন্সিবল ছেলেটি। মার্জিত কথাবার্তা। ওর প্রতিটি সেন্টেন্সের একটা মিনিংস আছে, যুক্তি আছে। মানুষ চিনতে আমার কখনো ভুল হয় না। খুব কম সময় হলেও ওকে আমি প্রথম দিনই অবজার্ভ করেছি। বড় ভালো ছেলে। খুব ধৈর্যশীল, চিন্তাশীল। ওর স্বর্গীয় পিতা যোগেশ্বর ব্যানার্জি ছিলেন আমাদের ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের একজন সদস্য এবং নিজেও শিক্ষকতা করতেন। পরিবারে সবাই এডুকেটেড। এমন বিদ্যান, বুদ্ধিমান সুযোগ্য পাত্র এ যুগে খুঁজে পাওয়াও কঠিন। জানিস ওকে আমার খুব পছন্দ। ও’ আগামীকালই কলকাতায় ফিরছে। এখন তুই মত দিলেই আমরা এগোবো। বিয়ে তো একদিন দিতেই হবে!

জেগে জেগে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখলো না কি! বড় বড় চোখ মেলে অপার বিস্ময়ে মামুর দিকে চেয়ে থাকে অলকা। ও মাই গড! এ তো আনবিলিভেবল, আনথিঙ্কেবল, আনএক্সেপেক্টেড! কল্পনাই করা যায় না।

এতক্ষণে যেন প্রাণ ফিরে পায় অলকা। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। যেন শুকনো মরুভূমির বুকে হঠাৎ একপশলা বৃষ্টিতে সিক্ত হয়ে ওঠার মতোই সতেজ সজীবতায় মন-প্রাণ ওর চাঙা হয়ে ওঠে। হৃদয়ের পূঞ্জীভূত সমস্ত গ্লানি ঝেড়ে ফেলে অব্যক্ত আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। একগাল হেসে বলে, রিয়েলি? আর ইউ সিরিয়াস?
- হোয়াট ডু ইউ থিঙ্ক ওলি? অ্যাম আই জোকিং? দেন লিসেন, সুপ্রিয় ডাইরেক্ট টেলিফোনে প্রোপোজ করেছে।
নাউ ইট ডিপেন্ডস অন ইউ। কী বলিস!

অপ্রত্যাশিত খুশি আর লজ্জার সংমিশ্রণে চোখদু’টো জ্বলজ্বল করে ওঠে অলকার। শৈলেন চক্রবর্তীকে একটা হাগ দিয়ে বলল, ও মামু, হাউ নাইস! আই কান্ট বিলিভ ইট! আই কান্ট বিলিভ।

সহাস্যে শৈলেন চক্রবর্তী বললেন, সো দেন, শুভষ্য শীঘ্রম! (সমাপ্ত)

যুথিকা বড়ুয়া: টরোন্ট প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী।



বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৬
এমজেএফ/

** অনুভূতি | যুথিকা বড়ূয়া (পর্ব-১)
** অনুভূতি | যুথিকা বড়ূয়া (পর্ব-২)
** অনুভূতি | যুথিকা বড়ূয়া (পর্ব-৩)

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ