ঢাকা, বুধবার, ১৪ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

গল্প

বড়গল্প/পর্ব-৩

কুঁড়ি থেকে ফুল | যুথিকা বড়ুয়া (পর্ব-৩)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০১৬
কুঁড়ি থেকে ফুল | যুথিকা বড়ুয়া (পর্ব-৩)

বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। আকাশে একটুও মেঘ নেই। ঝড়ের গতিবেগ স্থিতিশীল প্রায়। ঝিরি ঝিরি শীতল বাতাস বইছে। গর্তের ব্যাঙগুলো গ্যাঙর গ্যাঙর করে ডাকছে। কতোগুলো বাইরে বেরিয়ে থপ্ থপ্ করে লাফাচ্ছে।

দুই.       
বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। আকাশে একটুও মেঘ নেই।

ঝড়ের গতিবেগ স্থিতিশীল প্রায়। ঝিরি ঝিরি শীতল বাতাস বইছে। গর্তের ব্যাঙগুলো গ্যাঙর গ্যাঙর করে ডাকছে। কতোগুলো বাইরে বেরিয়ে থপ্ থপ্ করে লাফাচ্ছে।  ঝাড়-জঙ্গলে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। নিকটস্থ কোনো প্রতিবেশীর পালিত কুকুর অনবরত ঘেউ ঘেউ করছে। মনে হচ্ছে যেনো পাড়ায় ডাকাত পড়েছে। তাড়া করছে কাউকে। ততোক্ষণে ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল মহুয়ার। ঠাণ্ডায় হাত-পা কুঁকড়ে শুয়েছিল। হঠাৎ দেয়ালের বিশাল ঘড়িটার ঢং ঢং শব্দে চোখ মেলে মাথা তুলে দ্যাখে, ন’টা বাজে। নেশাখোরের মতো টলতে টলতে শিথিল ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে কম্বলটা কোনোরকমে টেনে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে পা-দু’টো টান টান করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু কখন যে চোখে তন্দ্রা লেগে গিয়েছিল খেয়ালই করেনি। হঠাৎ নড়ে ওঠে সদর দরজার কড়া। সে একেবারে কানে তালা লেগে যাবার উপক্রম। তবু কর্ণগোচর হয় না মহুয়ার। অঘোরে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু অনবরত দরজার কড়া নড়তে থাকায় হঠাৎ স্বপ্ন দেখার মতো লাফ দিয়ে ওঠে। বুক ধড়ফড় করে ওঠে। মুহূর্তের জন্য স্বপ্ন না বাস্তব, ঠাহর করতে পারছিল না। কিছুক্ষণ শুনলো কান পেতে। নাহ, এ তো স্বপ্ন নয়। সত্যিই দরজার কড়া নড়ছে।
ভাবলো, মালতি এসেছে। কাজের মেয়ে। ওঠার প্রয়োজন নেই। সঙ্গে চাবি আছে, পিছনের দরজা খুলে নিজেই  ঢুকে পড়বে। এই ভেবে বিছানা ছেড়ে উঠে আসার কোনো তাগিদ বোধই করলো না। লম্বা একটা হাই তুলে বললো, ‘এই দুর্যোগের মধ্যে আজই তোর আসার সময় হলো মালতি! একেবারে ঝড়-তুফান মাথায় নিয়ে। কাল সকালে এলেই তো পারতি’।

মনে মনে অনুমান করছিল, হাজারটা কৈফিয়ত দিতে দিতে এক্ষুণি ঘরে ঢুকবে মালতি। কিন্তু কোথায় মালতি, কোনো সাড়া শব্দ নেই ওর। ওদিকে দরজার কড়া নড়া বন্ধ হয়ে শুরু হয় খস্ খস্ শব্দ। একেই বিরাট দালানবাড়ি। চারদিক অন্ধকার। গাছ-গাছালিতে ভর্তি। কেউ এসে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকলে বোঝার সাধ্য নেই। মহুয়া দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত হয়, নাহ, মালতি নয়! এলে এতোক্ষণ চুপ করে থাকতো না। কিন্তু খস্ খস শব্দটা কীসের? কোনো চোর-গুন্ডা নয় তো! ভাবতেই ভয়-ভীতিতে আড়ষ্ঠ হয়ে যায় মহুয়া। থর থর করে গা কেঁপে ওঠে। সর্বনাশ! একে লোডশেডিং, চারিদিকে অন্ধকার। জানালা খুলে দেখবে, সেই সাহসও হচ্ছে না। কিন্তু কেউ যে বাড়ির সীমানায় ঢুকে পড়েছে, সেটা দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত হয়।  আবার পরক্ষণেই ভাবে, না, পাড়ার কুকুর, বিড়াল হবে হয়তো! তবু মনের সন্দেহ যায় না মহুয়ার। শুকনো একটা ঢোক গিলে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো, ‘কে, কে ওখানে?’
বলতে বলতে পরনের কাপড়টা কোনোরকমে গায়ে জড়িয়ে দ্রুত জানালার দিকে এগিয়ে যায়। জানালার কপাট খুলে উঁকি দিয়ে দেখবার চেষ্টা করে। কিন্তু অন্ধকারে কাউকে দেখতে পেলো না। ইতোমধ্যে খস্ খস শব্দটা বন্ধ হয়ে গেলো। ভাবলো, জয়ন্ত এসেছে। এসব ওরই কাণ্ড। মহুয়াকে একলা পেয়ে ভয় দেখাচ্ছে। কখন কী মতিগতি ওর, বোঝা ভার। যতোসব দুষ্টু বুদ্ধি সবসময় ওর মাথায় খেলে। দাঁড়াও, তোমায় দেখাচ্ছি মজা। এইভেবে একটা শক্ত কাঠের ডান্ডা নেয় হাতে। জয়ন্তকে আজ কষে লাগাবে এক ঘা। অনেকক্ষণ ধরে জ্বালাতন করছে। কিন্তু দরজার ও-প্রান্তে কার যে আবির্ভাব, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি মহুয়া। ছিটকিনি টেনে দরজাটা খোলা মাত্রই হাতের ডান্ডাটা ছিটকে পড়ে মাটিতে। আর তক্ষুণিই ধপ্ করে জ্বলে ওঠে বিজলীবাতি।  

বিস্ময়ে একেবারে থ্ হয়ে যায় মহুয়া। অভিভূতের মতো পলকহীন নেত্রে হাঁ করে চেয়ে থাকে। বিশ্বাসই হয় না নিজের চোখদু’টোকে। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে না তো! না কী মনের ভ্রম! অবিশ্বাস্য হলেও এ যে নিতান্তই বাস্তব। মাত্র একহাত দূরত্বের ব্যবধানে অ্যাটাচি হাতে নিয়ে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে সশরীরে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে নিখিলেশ চ্যাটার্জী, ওরফে নিলু। মাসতুতো দিদি শুভ্রার দেবর। শুভ্রাদির বিয়েতেই প্রথম দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে।  

প্রায় বছর ছয়েক আগের কথা। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দলবেঁধে শুভ্রাদির বাসররাতে কি কাণ্ডটাই না করেছিল নিখিলেশ। সুরভিত রজনীগন্ধায় সুসজ্জিত চন্দন পালঙ্কে শায়িত নব বিবাহিত দম্পতির মধুর প্রেমালাপ আড়ি পেতে শুনতে শুনতে হঠাৎ বন্ধ দরজাটা বেকায়দায় খুলে গিয়ে একঝাঁক যুবক-যুবতী হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে গিয়ে সে কী কাণ্ড। মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল যেনো, বড় একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেলো। ওদিকে নব দম্পতির তখন বেহাল অবস্থা। যা ক্ষণপূর্বেও কেউ কল্পনা করতে পারেনি। ভাগ্যিস মশারিটা টাঙানো ছিলো। সুস্পষ্টভাবে কিছুই দেখা যায়নি। কিন্তু আচমকা অনাকাঙ্ক্ষি পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বর-কনে দু’জনেই ব্রিবত হয়। দিশাহীন হয়ে পড়ে। চোখেমুখে সর্ষে ফুল দেখছিল তখন। তন্মধ্যে হঠাৎ হাস্যোধ্বনিতে লজ্জায় মুখ লুকোবার জায়গা পায় না। এসব শুনে ওর জ্যাঠতুতো বৌদিরা সবাই হাসতে হাসতে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছিল। লজ্জা আর অপরাধবোধে শুভ্রাদিকে ক’দিন মুখই দেখাতে পারেনি নিখিলেশ। সেই তখন কয়েক পলকের দেখা। তার কিছুদিন পর উচ্চশিক্ষার্থে নিখিলেশ পাড়ি জমায় ইংল্যান্ডে। আর দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। যোগাযোগও হয়নি। আভিজাত্যে ভরা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হ্যান্ডসাম্ মার্জিত চেহারা নিখিলেশের। লম্বা সুঠামদেহী। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ ও প্রসন্ন মেজাজের একজন সুপুরুষ। যার প্রথম দর্শনে যেকোনো মেয়েই চুম্বকের মতো আকর্ষিত হবে। প্রেমে পড়ে যাবে। মহুয়াও যে পড়েনি তা নয়, অবশ্যই পড়েছিল। তখন ওর যৌবনের প্রথম প্রহর। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পর্দাপণ করেছে মাত্র। উপচে পড়া যৌবনের ঢেউয়ে প্লাবিত হচ্ছিল ওর সারাশরীর। বাবা-মায়ের একমাত্র তনয়া। কতো আদরের, তাদের চোখের মণি। যার অন্ত ছিলো না স্বাধীনতার। ছিলো না কোনো দায়বদ্ধতা। চিন্তাহীন, বন্ধনহীন মুক্ত জীবন। উড়ু উড়ু মন। ঠেকায় সাধ্য কার! ভিতরে ভিতরে সবার অলক্ষ্যে নিখিলেশের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। অথচ ভালোবাসা নামে চির সত্য ও পবিত্র শব্দটা মুখ ফুটে উচ্চারণ করতে লজ্জা না হলেও অভাব ছিলো সাহসের। পারেনি ওর মনের একান্ত ইচ্ছাটা ব্যক্ত করতে, নিখিলেশকে জানাতে। আর পারেনি বলেই মহুয়ার একান্ত ভালোবাসার ফুলটি নিঃশব্দে ঝরে গিয়েছিল ওর হৃদয় থেকে। অপসারিত করে ফেলেছিল মন থেকে। ভুলে গিয়েছিল সেদিন, যেদিন স্কলারশিপ্ নিয়ে নিখিলেশ ডাক্তারি পড়তে পাড়ি দিয়েছিল ওর স্বপ্নের দেশ, ইংল্যান্ড। বুঝেছিল, নিখিলেশ ওর নাগালের বাইরে। ওকে কোনদিনও ধরা-ছোঁয়া যাবে না। বিদেশি মেয়েদের সঙ্গে পড়াশোনা করবে, মেলামেশা করবে, সেখান থেকেই বেছে নেবে ওর জীবন সঙ্গিনী।  

আজ এতোকাল পর অপ্রত্যাশিত হঠাৎ নিখিলেশের আগমনে অপ্রস্তুত মহুয়া স্তম্ভিত হয়ে যায় বিস্ময়ে। রুব্ধ হয়ে যায় ওর কণ্ঠস্বর। লজ্জায় দিশা হারিয়ে ফ্যালে। কী বলবে, ভাষা খুঁজে পায় না। কী করবে, দিশা খুঁজে পায় না। অথচ কি আশ্চর্য্য, দীর্ঘদিনের ব্যবধানে নিখিলেশ এতোটুকু বদলায়নি, পরিবর্তনও হয়নি। সেই অকৃত্রিম হাসি, সেই মাসুম চোখের চাউনি। এতোক্ষণ সহাস্যে উৎসুক্য হয়ে অপেক্ষা করেছিল মহুয়ার সাদর অভ্যর্থনার জন্যে। কিন্তু মহুয়ার আপাদমস্তক লক্ষ্য করে অস্বস্তিবোধ করে মনে মনে। ক্ষণপূর্বে যে অকপট সারল্য দেখা গিয়েছিল, সদ্য তরতাজা হাসির সঙ্গে সঙ্গে সেটাও মিলিয়ে গেলো। মনে মনে বলে, সামথিং ইজ রং। চেহারা, বেশভূষার এ অবস্থা কেন মহুয়ার? এ কি হাল করে রেখেছে? হয়েছে কী ওর? ঘরের ভিতর থেকে হু হু করে বের হচ্ছে ঠাণ্ডা হাওয়া। সারাঘরে উড়ছে পারফিউমের গন্ধ। সাজ-সজ্জার বালাই নেই। কেশ-বিন্যাস এলোমেলো। পড়নের কাপড়টাও শরীরে একরকম জড়ানো। চোখদু’টোও  অস্বাভাবিক  লাগছে।  
চলবে...

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৬
এসএনএস

** কুঁড়ি থেকে ফুল | যুথিকা বড়ুয়া (পর্ব-১)
** কুঁড়ি থেকে ফুল | যুথিকা বড়ুয়া (পর্ব-২)

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ