ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

গল্প

এই যে তুমি | সাজেদা হক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৬
এই যে তুমি | সাজেদা হক

গল্পটা তখনকার, যখন গ্রামীণ জনপদে নারীর ক্ষমতায়ন বাস্তবায়নে উঠে পড়ে লেগেছে বেসরকারি সংগঠনগুলো। যতোটা না বাস্তবায়ন তার চেয়েও বেশি সিডোও সনদের এজেন্ডা পুরণের প্রতিযোগিতা।

ল্পটা তখনকার, যখন গ্রামীণ জনপদে নারীর ক্ষমতায়ন বাস্তবায়নে উঠে পড়ে লেগেছে বেসরকারি সংগঠনগুলো। যতোটা না বাস্তবায়ন তার চেয়েও বেশি সিডোও সনদের এজেন্ডা পুরণের প্রতিযোগিতা।

একই সময়ে সমান গুরুত্ব দিয়ে চলছে স্থানীয় সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের ডামাডোল। সরকার থেকে শুরু করে বেসরকারি সংগঠনগুলোও একই কাজে মশগুল। এমন সময়ে একটি বেসরকারি সংগঠনে কাজ করছিল ইলা।  

এই দু’টো কাজই এক সঙ্গে করতে হয় ইলাকে। কারণ সে আন্তর্জাতিক একটি বেসরকারি সংগঠনের আঞ্চলিক প্রধান। তার উপর গণমাধ্যমে এসব খবরের ঢোল পেটানোটাও অতিরিক্ত কাজ। যদিও কেন্দ্র থেকে সহযোগিতা পায়, তবুও এই কাজটাকে একদমই পছন্দ করে না ইলা। দায়িত্ব বলেই বাধ্য হয় করতে। সাংবাদিকদের সঙ্গে হেসে কথা বলা, তারা যেনো কোনোভাবেই বিরাগভাজন না হন, সংগঠন সম্পর্কে যেনো কোনো ভুল ধারণা তৈরি না হয়- এটার খেয়াল রাখতে অলিখিত নির্দেশ আছে বিগ বসের।  

এমনি একটি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক অনুষ্ঠানে টাঙ্গাইল এসেছেন ঢাকার দু’জন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং একদল সাংবাদিক। আর অনুষ্ঠান আয়োজন এবং এসব বিশিষ্টজনদের সামলানোর দায়িত্ব পড়েছে ইলার কাঁধে।  

ইলার বয়স আর কত হবে ২২ কিংবা ২৩। ফর্সা গোল মুখ, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। ঠোঁটের উপরে একটি কালো তিল আছে। তিল ঠিক নয়, বিউটি স্পট। আর ঘন কালো দীঘল চুলে দারুণ অপরূপা ইলা। আজ আরও বেশি সুন্দর লাগছে। কারণ, আজ সে কালো একটা জর্জেট শাড়ি পরেছে। এই শাড়িটা তার ভীষণ প্রিয়। শাড়িটার আলাদা একটি গল্প আছে, সে কারণে শাড়িটা তার বেশি প্রিয়। যখন তার মন সবচেয়ে বেশি খারাপ থাকে, তখন ইলা চেষ্টা করে এই শাড়িটা পরার। আজও তাই করেছে সে।  

ইলার যে মন খারাপ, তা কেবল ইলাই জানে। সে সবাইকে সামলাচ্ছে দুই হাতে। মন খারাপ থাকলেই বেশি কাজ করে সে। আজও তাই করছে। কিন্ত কাজের ফাঁকেও মন খারাপ উঁকি দিচ্ছে কখনও কখনও। কান্না চেপে রাখতে পারছে না আবার কাঁদতেও পারছে না। হাসি হাসি মুখ করে থাকতে হচ্ছে সবার সামনে। আয়োজন বেশ বড়। টাঙ্গাইলের নাগরপুরের গয়াহাটা ইউনিয়নের একটি স্কুলে চলছে উন্মুক্ত বাজেট অধিবেশন। প্রথমবারের মতো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান জনগণের সামনে বাৎসরিক বাজেটের আদ্যোপান্ত তুলে ধরবেন। সেই অনুষ্ঠানের অতিথি এই আগতরা।  

সবকিছুই ঠিকমতো চলছে। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। কাণায় কাণায় পূর্ণ মাঠ। সেই মাঠের এক কোণায় গিয়ে দাঁড়াতেই হঠাৎ করেই সামনে চলে এলো এক সাংবাদিক। নাম জানে না ইলা। সামনে এসেই জানতে চাইলো:-
- আপনার কী হয়েছে ইলা।
- সকালে ডিভোর্স দিয়ে এসেছি। কী ভেবে যেনো বলে বসলো ইলা। সঙ্গে সঙ্গে বললো, সরি সত্যিটা বললাম। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।
- না না, আমি কিছু মনে করিনি। বলেই একটা সিগারেট ধরিয়ে মাঠের অন্য এক পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সেই সাংবাদিক।

চোখের কোণে জমা পানিটা এবার ইলার গাল বেয়ে নেমেই পড়লো। শাড়ির আঁচলে মুখটা মুছে নিলো। কেউ দেখলো কিনা, তা খেয়াল করলো আড়চোখে। না, কেউ দেখেনি। এবার মনকে বোঝালো, এখন কাজের সময়, শোক করার সময় আরও পাওয়া যাবে। ঘুরে দাঁড়ালো ইলা।  

দুই কদম এগোতেই সামনে আবার সেই সাংবাদিক। হাতের সিগারেটটাও শেষ হয়নি। অর্ধেকটা ইলার সামনেই ফেলে দিলো। ইলার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
-    আমি আবির, ঢাকায় একটা দৈনিকে কাজ করি। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। চট্টগ্রাম ইউনিভাসির্টি থেকে এমএ পাশ করেছি। আমি তমা নামের একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম, কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসে না। সে অর্থে আমিও নিজেকে ডিভোর্সি মনে করি। আপনার যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
-    হাতটা এমনিতেই বাড়িয়েছিল ইলা। কিন্তু আবিরের এক নিঃশ্বাসে বলে যাওয়া কথাগুলো শুনতে শুনতে হাতটা থেমেই গেলো।
-    আবিরই এগিয়ে বাড়ানো হাতটা ধরলো। বললো, এখনই জবাব দিতে হবে না। সময় নেন। আর টাঙ্গাইলে থাকার দরকার নেই ঢাকা চলে আসেন। আমি বসের সঙ্গে কথা বলে নেবো।  

কোনো উত্তর না দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নেয় ইলা। সামনের দিকে এগোয়। একটু দূরে গিয়ে সোজা তাকায় আবিরের দিকে।  

আবিরের বয়স অনুমান করে ইলা। ৩৫-৩৮ এর মধ্যেই হবে। গায়ের রঙ শ্যামলা, লম্বাটে ধরনের, গড়নে পাতলা। নাকটা ছিপছিপে। সিগারেট খাওয়ার কারণে কিনা জানে না ইলা, ঠোঁট একেবারে কালো। না, কোনো গোঁফ বা দাঁড়ি নেই। কিন্তু তাকে তো পাগল মনে হচ্ছে না ইলার। তাহলে সে এমন করে কেন বললো?


ঠিক এই মুহূর্তে ইলার ভেতরটাও যেনো পড়তে পারছে আবির। সামনে এসে বললো,
-ভয় নেই, আমি খারাপ ছেলে নই। আমার সম্পর্কে জানতে পারেন যে কারও কাছে। আমি মিথ্যা বলি না। আর আপনাকে দয়া বা করুণা করার কোনো ইচ্ছেও আমার নেই। আমি বলেছি আপনাকে, আমিও নিজেকে তালাকপ্রাপ্তই ভাবি, সো দয়া বা করুণার কোনো বিষয় এখানে নেই। একটু সময় নেন, আমাকেও একটু সময় দেন, জানেন-দেখবেন আপনার ঘোর কেটে যাবে। আর হ্যাঁ, আপনার সহকর্মী মাহবুব, আমার সম্পর্কে ভালো জানেন, তার কাছেও জানতে পারেন। একসময় আমরা সহকর্মী ছিলাম। বলেই অন্যপথে হাঁটা ধরলো আবির।

ইলা অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে। বাকি সময়টা কেবল অবশভাবে কেটেছে ইলার। ভালোলাগা-মন্দলাগা মিশিয়ে একটা অনুভূতি। মুখে কোনো কথাই বের হয়নি ওইদিন। অনুষ্ঠান শেষ করে টাঙ্গাইল অব্দি ফেরার জন্য সাংবাদিকদের গাড়িতেই ঠাঁই হয়েছিল ইলার। যাত্রাপথে কোনো কথা বলেনি ইলা। কিন্তু আবির বার বার খুঁচিয়েছে। বলা ভালো, খুশি রাখার চেষ্টা করেছে।  

গন্তব্যে আসতেই নেমে পড়ে ইলা। নামে আবিরও। ইলার হাতে গুজে দেয় একটি ছোট কাগজের নোট, তাতে আবিরের ফোন নম্বর লেখা। মুখে বললো, একটা ফোন কিনে নিও। ফোন কোরো। বাকিটা পরে ঠিক করে নেবো। তোমার জবাবের অপেক্ষায় থাকবো। আর হ্যাঁ, আমি দুইদিন পর আবার আসবো টাঙ্গাইল, তোমার কাছে। ফেরাবে না তো?

হঠাৎ করেই আপনি থেকে তুমিতে নেমেছে আবির। এবার ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে, অবশ্যই আসবেন। এবার যাই বলে রওনা দিলো ইলা।  

আবির আবারও গাড়িতে উঠে গেলো। গাড়িও টাঙ্গাইল ছেড়ে ঢাকার পথে। ইলা, ঘরে ফিরলো। সারাদিনের সব ঘটনা মনে পড়ছে। আবির যাই বলুক না কেন, এটা যে দয়া তা ভালো করেই জানে ইলা। কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। সে এতো করুণার পাত্র কেন হলো। কেনই বা ইলার ভালোবাসাকে এভাবে ভুলে গেলো অরুণ। মাত্র তো ২০ দিন আগে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলো তারা। তাহলে কেন তাকে এভাবে ছেড়ে গেলো– এর কোনো সঠিক উত্তরও জানা নেই। কেবল মনে আছে, নাটকের মতো ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। অরুণ আর ইলার দেখা হওয়া, বিয়ে এবং ছাড়াছাড়ি সবই আকস্মিক। তার চেয়েও বড় বিস্ময় আবির। এ কেমন ছেলে কোনো কুল-কিনারা করতে পারছে না। দয়াই হবে, এর আর কোনো অর্থ ভাবতেই পারছে না ইলা।

শোক কাটিয়ে ওঠার সময়ও পায়নি সে। এর মধ্যেও কাজ করেছে। ঠিক ঠিক দুইদিন পর আবারও টাঙ্গাইল এসে হাজির আবির। খুঁজে বের করেছে ইলাকে। জোর করে নিয়ে বের হয়েছে। আবির বলছে আর ইলা শুনছে।  

আমি তমা নামে একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম। ভালোবাসতাম বলা ভুল হবে, ভালোবাসি। কিন্তু ও আমাকে এখন আর চাইছে না। তাই আমিও আর তমার কাছে যেতে চাই না। তুমি যদি হ্যাঁ বলো, তাহলে আমি খুশি হবো। আর যদি না বলো, তাহলে জোর করবো না। সময় নাও তুমি।  
-তমা কোথায় থাকে? এই প্রথম আবিরকে প্রশ্ন করলো ইলা।
-ঢাকাতেই।
-আমার সঙ্গে দেখা করাবেন?
-হ্যাঁ, কিন্তু তমা মনে হয় দেখা করতে চাইবে না।
-ও আমি দেখে নেবো।
-তোমাকে ঢাকা চলে আসতে বল্লাম, কী হলো তার। আমি কি অফিসে কথা বলবো?
-না, এমনিতেই আমার ঢাকা যাওয়ার কথা আছে। পরশু যাবো। তখন আলাপ করবো।
ওইদিন কথা শেষ হলে টাঙ্গাইল ছেড়েছে আবির।  
ইলাও ফিরে গেছে নিজ বাসগৃহে। আজ আবিরের সঙ্গে কথা বলে উল্টো আবিরের জন্যই মায়া কাজ করেছে ইলার। ইলার চেয়েও দুঃখী মনে হয়েছে আবিরকে। তমাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে ছেলেটা অথচ মেয়েটা ওকে চায় না। তাই ইলাকে বিয়ে করতে চাইছে। আসলে তমা যাতে অন্য কোনো ছেলেকে বিয়ে করে সুখী হতে পারে- সেজন্য নিজেকে তমার কাছে খারাপ একটা ছেলে প্রমাণ করতে চায় আবির। এজন্য ইলার সহযোগিতা চায়– আজ আবিরের চোখের আকুতিতে তাই ছিলো।  

আবিরের প্রত্যেকটা কথা শুরু হয়, তমাকে দিয়ে, শেষও হয় তমাতেই- এটা আবির জানে না। কিন্তু কিছু সময় কথা বলেই এটা টের পেয়েছে ইলা। তাইতো মনে মনে, তমা আর আবিরকে এক করার পণ করলো ইলা। বর না হোক আবিরকে বন্ধু হিসেবে মেনে নিয়েছে সে। সেই ভাবনা থেকেই সম্পর্কটা ধরে রাখতে চাইলো ইলা। হলোও তাই।  

কয়েকদিন পর ঢাকায় কেন্দ্রীয় অফিসে ঢুকেই মুখোমুখি সিনিয়র সহকর্মী কমলের। মাথার অর্ধেক চুল নেই। চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা সরিয়ে ইলাকে দেখেই ডাক দিলো, আরে ইলা যে, আপনার সঙ্গে আমার জরুরি আলাপ আছে। খুব সিরিয়াস।
-কী কমলদা। এমনিতেই  ইলার এই সহকর্মী একটু চাপা স্বভাবের, কাজের বাইরে খুব একটা কথা বলেন না। বছরখানেক হয়েই গেছে এখানে কিন্তু কমলের সঙ্গে কেমন আছেন আপনি, সব ভালো তো, এর বাইরে আর কোনো কথাই হয়নি। সেই কমলই কিনা আজ আগ্রহ ভরে ডাকছে ইলাকে। অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিছু হবে।  
-আসছি কমলদা। হাতের কাজটা শেষ করেই আসছি আপনার কাছে।  
-আসবেন কিন্তু, খুব জরুরি।
-ওক্কে। আসছি।

হাতের কাজটা তখনও শেষ হয়নি। কমল নিজেই চলে এলো ইলার কাছে। আশে-পাশে কেউ নেই দেখেই কমল বলতে শুরু করলো-
-আবিরদা কিছু বলেছে আপনাকে?
-কোন বিষয়ে?
-আমি সরাসরি বলি, প্যাচ ভালো লাগে না আমার। আবির আপনাকে বিয়ে করতে চায়। বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবছেন?
-আমি এখনও কিছু ভাবছি না কমলদা।
-ইলা, আবির খুব ভালো ছেলে। শিক্ষা-দীক্ষায়, কালচারে-কৃষ্টিতে অনেক ভালো। আপনি চোখ বন্ধ করে রাজী হয়ে যেতে পারেন। মানুষ হিসেবে অসাধারণ সে গ্যারান্টি আমার। আপনার চেয়ে বয়সে বড় হিসেবে আমার পরামর্শ হবে, রাজী হয়ে যান। তারপরও বিষয়টা যেহেতু আপনার একান্তই ব্যক্তিগত, তাই সিদ্ধান্তটা আপনারই। তবে, কী সিদ্ধান্ত নেন জানাবেন।
-আচ্ছা।
-ইলা, আপনি কি জানেন আবির বিষয়টা কান্ট্রি ডিরেক্টর স্যারকেও বলেছে- বললো কমল।
-তাই নাকি? ইলার চোখে বিস্ময়।
-হুমম এবং শুনে অবাক হবেন এই প্রস্তাবে স্যারও খুশি। আর আপনি কিনা ভাবছেন? অ্যাজ ইউর উইশ। বাই। পরে কথা হবে। মোটামুটি অফিসের সবাই জেনে গেলো আবিরের বিষয়টা। ইলাও কিছু বলে না।  

আবিরকে বলে দেখা করেছে তমার সঙ্গে। তমা তখন নীলক্ষেতের কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে থাকে। একদিন দেখা করতে নিয়ে গেলো আবির। আবির ইলাকে পরিচয় করিয়ে দিলো এভাবে-
-তমা, এ হচ্ছে ইলা। আমরা বিয়ে করছি। আর ইলা, এ হচ্ছে তমা। তোমাকে বলেছি। ঠিক আছে তুমি কথা বলো, শেষ হলে আমাকে একটা কল কোরো, আমি আশে-পাশেই আছি।
-হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ে ইলা।
 

এবার ইলার হাত ধরে হোস্টেলের ভেতরে নিয়ে যায় তমা। বিছানায় বসিয়ে ইলাম মাথার চুল খুলে দেখে, মাথায় হাত বুলায়-খুব আদর করে। যেমন করে খুব প্রিয় কারও জন্য কোনোকিছু কেনার সময় পরখ করে মানুষ তেমন। আর মুখে বলে-
-আবির খুবই অসাধারণ একটা মানুষ। তুমি ওকে সুখী রেখো ইলা। ওর মতো মানুষ হয় না।
-তাহলে আপনি বিয়ে করছেন না কেন? সাহস করে তমাকে প্রশ্নটা করেই বসে ইলা।
-আমি করছি না, তারও তো একটা কারণ আছে। তোমাকে শুধু এটা বলি, আবির আমাকে যতোটা ভালোবাসে, আমি ওকে ততোটা ভালোবাসতে পারলাম না। শুরুতে আমাকে ভুলতে ওর কষ্ট হবে। কিন্তু তুমি পারবে। আমার বিশ্বাস তুমি ওকে আমার চাইতেও বেশি ভালোবাসতে পারবে।
-আপু, আপনি জানেন আবিরের দম আপনি?
-জানি তো, কিন্তু সত্যিই আমি দুঃখিত। পারছি না কোনোভাবেই।  

এবার তমার চোখের কোণে পানি দেখলো ইলা। ওঠে দাঁড়ালো, জড়িয়ে ধরলো। তমার বয়সও ৩২-৩৫ হবে। ফর্সা, মুখটা একদম প্রতিমার মতো সুন্দর। বেশ লম্বা। চোখ টানা টানা, খাড়া নাক। তমাকে জড়িয়ে ধরে ইলা বললো-
-এটা অন্যায় করছেন আপনি। আপনিও আবিরকে ভালোবাসেন কিন্তু বিয়ে করবেন না-এটা কেমন জেদ?
-এটা জেদ না ইলা। আমি ওকে ঠকাতে চাই না। আবির আমাকে যতোটা ভালোবাসে, ঠিক অতোটা ভালোবাসা আমি ওকে দিতে পারবো না। ওকে ঠকাতে চাই না আমি। তাই আমি ওকে বিয়েও করবো না। আর একটা কথা আজকের পর আমরা আর দেখা করবো না। এটা মনে রাখবে।

হোস্টেল থেকে বের হয়ে আসার সময়, ইলাকে নিজ হাতে রান্না করে খাইয়েছে তমা। লাল রঙের রেশমী চুড়ি হাতে পরিয়ে দিয়েছে। বলেছে, এই রঙটা আবিরের খুব প্রিয়। সেই শেষ। এরপর আর দেখা হয়নি ইলা আর তমার। কিন্তু তমার আনন্দাশ্রু ভোলে না ইলা। সেই চোখে আবিরের জন্য আকুলতাটাও ব্যাকুল করে।  

এরপর আবির আর ইলার দারুণ বন্ধুত্ব হয়। ইলাকে লেখালেখিতে আগ্রহী করতে চায় আবির। একটা ম্যাগাজিনে ভালোবাসা দিবসের একটা গল্প লিখিয়ে নেয়। সপ্তাহে সপ্তাহে চলা আবিরের বাসার সাহিত্য আড্ডায় নিয়মিত অতিথি থাকে ইলা। গানেও উৎসাহ দেয় আবির। এভাবেই কেটে যায় কয়েকটা মাস, কিংবা বছরও। এর মধ্যেই হঠাৎ করেই আবির একদিন ইলাকে আবারও বিয়ের কথা বলে। বলে, চলো বিয়ে করি। ইলা বলে এখন না, পরে।  

এর কিছুদিন পর এবার ইলা এসে আবিরকে বিয়ের কথা বলে। বলে, চলো বিয়ে করি, তখন না জবাব দেয় আবির। কারণ বলে না, কিন্তু জানিয়ে দেয়, সে ইলাকে বিয়ে করবে না।  

তারপর যে যার পথে। কেউ কারও কোনো খোঁজ নেয় না। দেখাও হয় না, ইলা আর সাহিত্য আড্ডার অতিথি নয়। কিন্তু ইট-কাঠ পাথরের শহুরে বাসিন্দা। অথচ এই ঢাকা তার ঠিকানা হওয়ার কথা ছিলো না। শস্য-শ্যামলা গ্রামই তার ভীষণ প্রিয় যে। সে গ্রামের মেঠো পথেই বছরের পর বছর হাঁটতে চেয়েছিল। আবির সেই চলাটার বাঁক দিয়েছিলো মহানগরের দিকে। পাশে থাকার আশ্বাসও দিয়েছিল, ছিলো কাছে পাবার আকুলতাও। কিন্তু এখন আর এসবের কিছুই অবশিষ্ট নেই। মহানগরের লাখো মানুষের ভিড়েও একা ইলা। একাই চলছে পথচলাও। সম্বল সেই চাকরিটাই।  

একদিন হঠাৎ ইলা শুনতে পায়, আবিরের বিয়ে হচ্ছে। ফোন করে আবিরকে। আবির নয়, ধরে অন্যজন। বলে, আবির ভাইকে দেওয়া যাবে না, তার বিয়ে হচ্ছে। ইলা কেবল জানতে চায়, কনের নাম কী? ও প্রান্ত থেকে উত্তর আসে, তমা! 

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৬
এসএনএস
 
 
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ