ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

গল্প

খাসির মাংসের গন্ধ | সরোজ দরবার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৭
খাসির মাংসের গন্ধ | সরোজ দরবার খাসির মাংসের গন্ধ | সরোজ দরবার

- কতো, চারশো তো?
মরা খাসির উপর ভারী ছুরিটা চালাতে চালাতে অভ্যেসমতো জিজ্ঞেস করল গোপাল। আজ এতো বছর ধরে দেখছে দীনুকে। মাসে ওই একবারই আসে। বাঁধা মাপ চারশো। তার বেশি ওঠেও না, নামেও না। তবু দোকানির কাজ একবার জেনে নেওয়া। প্রতিবারই তাই এক প্রশ্ন করে। আর ঘাড় হেলিয়ে হ্যাঁ বলে দীনু।

আজ অবশ্য না বলল। ২শ গ্রাম আরও বাড়িয়ে দিতে বলল।

পাল্লায় মাংস চাপিয়ে দিয়েছিল গোপাল। দীনুর কথায় আন্দাজমতো আরও খানিকটা কাটতে কাটতে বলল, ঘরে কুটুম এয়েচে নাকি রে? 
ওরা এক পাড়ারই ছেলে। একসঙ্গে নেয়ে-খেলে বড় হয়েছে। দীনুর বাপটা যখন মরল তখন ওর ভাইটা সবে হয়েছে। তারপর থেকে বেদম কষ্ট, অনেক লড়াই করে দু’-ভাইকে বড় করেছে ওদের মা। সেসব খুব ভালো করেই দেখেছে গোপাল। অবশ্য ভাই ভাই করে দীনুটার আর বিশেষ কিছু হয়নি। অল্প বয়সেই ইশকুল ছেড়েছে। তারপর ওই মুদি দোকান। তখন গোপালরা অন্য পাড়ায় খেপ খেলতে যেত। ক্লাবে যাত্রার পাট আওড়াত। গোঁফ গজানো বয়সে যা হয় আর কী। দীনু ওসবের মধ্যে থাকতে পারত না, সে শুধু দোকান চালাত। সংসার চালাতে চালাতে ছেলেটার বয়স যেনো গামছায় জলের মতো গলে গেলো। ওদের বাড়িতে কখনও বিশেষ লোকজন আসতে দেখেনি গোপাল। আগে একটা মামা আসত। তিনিও নাকি অনেকদিন হলো আর ইহজগতে নেই। মাংস বেশি নেওয়ায় তাই খটকা লেগেছিল গোপালের। দীনু হাসিমুখে অবশ্য তা ভাঙিয়ে দিল। বলল, না রে, মিনুটার চাকরি হলো তো, তাই।
-তাই নাকি? যাক তোর ভাবনা ঘুঁচল।
কালো প্লাস্টিকটা এগিয়ে দিয়ে দাম বুঝে নিলো গোপাল। বাড়ি ফেরার পথে আচমকা খুব আনন্দ হলো দীনুর। গুনগুন করে গান গাইছে। নিজেই খেয়াল করল, মাথুর পালার ‘মুখ তুলি চাহ...’ জায়গাটাই গাইছে। কেন আনন্দের দিনে এমন গান মনে এলো! কে জানে! হেসে ফেলে দীনু। এমন সময় বিধান মাস্টারের সঙ্গে দেখা।
 -ও দীনু, দোকান খুলিসনি?
-একটু দেরি হয়ে গেলো গো কাকা। সাবু এনিচি, এখন যাবে, নাকি বিকেলে?
-বিকেলেই যাবোখ’ন। দেরি করলি কেন আজ?
-মিনুটা চাকরি পেল তো, তাই একটু মাংস কিনতে এসে দেরি হয়ে গেলো।
হাতের প্যাকেট দেখিয়ে বলে দীনু। তারপর হনহনিয়ে এগিয়ে যায়। সত্যিই বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। এখনও ঠাকুরকে ধূপ-জল দেওয়া হলো না।

২.
-এমন আষাঢ় মাসেই খুন হয়েছিলেন মহাপ্রভু। বিধান মাস্টারের কথা শুনে ধূপ ঘোরানো থমকে গেলো দীনুর। তাড়াতাড়ি ধূপদানিতে সেটা গুঁজে দিয়ে বলল, সত্যি খুন? আমরা তো শুনে এয়েচি, সমুদ্রে মিলিয়ে গেলেন প্রভু।  
-তোরা তো আবার আধা বোস্টম বাড়ি। এর বাইরে বেরোবিই না।
হেসে ফেলে দীনু। সত্যিই একসময় তাদের ঘরে মাংস-ডিম ঢুকত না। বাবার গলাতে তুলসী মালাও ছিলো। পরে পরে মা সব তুলে দিয়েছে। আজ আর বোষ্টম বলা যায় না তাদের। তবে ওই ছোটবেলায় শোনা পালা-কীর্তনগুলো মনে আছে। নীলাচলে মহাপ্রভু... সমুদ্রে কৃষ্ণ দেখে সেই যে ঝাঁপ দিলেন আর উঠলেন না প্রভু। বিধান মাস্টার বলল, কেন শুনিসনি, জগন্নাথ বিগ্রহে মহাপ্রভুর মিলিয়ে যাওয়ার কথা? দীনু ঘাড় নাড়ল। শুনেছে বটে। বিধান মাস্টার হু হু করে বলল, আস্ত মানুষটা কী আর মিলিয়ে যায় রে? খুন হয়ে গিয়েছে।  

কথাটা কানে বাজতে থাকে দীনুর। মাস্টারকে সাবু দানা মেপে দিয়ে একা একা ভাবে সে। সত্যিই মানুষ কী আর মিলিয়ে যায়! খুন হয়। তার জীবনের বছরগুলোও কী মিলিয়ে গেছে, নাকি খুন হয়ে গেলো! এই দোকান আর ভাই, এর দিকে তাকিয়েই তো এতোগুলো বছর কেটে গেলো। কবে যেনো একদিন বিয়ে হয়ে গেলো মৌসুমীর। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে দীনুর। কতোদিন এমনিই দোকানে এসেছে মৌসুমী। যখন খদ্দের নেই দাঁড়িয়ে থেকেছে। যা বলার ছিলো বলার হয়ে গিয়েছে। নতুন কিছু বলার নেই। বলতও না। দীনুরও কিছু বলার ছিলো না। মৌসুমী সামনে এসে দাঁড়ালেই সে শুধু গন্ধরাজ ফুলের গন্ধ পেত। মাথাটা কী এক নেশায় ঝিমঝিম করত। তবু নিজেকে প্রবোধ দিয়ে বলত, সামান্য মুদি দোকানির এই বিলাসিতা সাজে না। কাউকে ভালবাসলে তার জীবন নষ্ট করতে নেই। কেন মৌসুমী একটা সুখের জীবন পাবে না? কেন তার দিন আনি দিন খাইয়ের ঝামেলায় সে আজীবন জড়াবে?
প্রশ্নগুলোই শুধু গুমরেছে অস্ফুটে। আর দিনের পর দিন তারা চুপ করে থেকেছে। আচমকা খদ্দের চলে এলে, মৌসুমী টুকিটাকি কিছু একটা নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। বহুবার তার দোপাট্টার মিলিয়ে যাওয়া শেষ অংশটুকুর দিকে তাকিয়ে দীনুর মনে হয়েছে ডেকে বলে, মৌসুমী কথা আছে, একটু দাঁড়িয়ে যাও...। কিন্তু বলা আর হয়নি। বরং দোকানীর ধর্ম পালন করে খদ্দেরে মন দিয়েছে। দোকান আর সংসার, এর বাইরে আর কিছু ভাবাই হলো না দীনুর। তার ফুটবল খেলার দিন, প্রেমে পড়ার দিন, বিচ্ছেদের দিন— সব যেনো কোনো বিগ্রহের মধ্যে মিলিয়ে গেলো। বিধান মাস্টারের কথা মিলিয়ে দীনু আজ ভাবে, খুনই হয়েছে তার সব দিন। সেইইই চাপা দিয়ে রেখেছে। যেমন কীর্তনে করে থাকে।
সেদিনের মতো দোকান তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দেয় দীনু। মনটা ভালো লাগে না। ওদিকে আবার আষাঢ়ের বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে।

৩.
যে সুদিন সুদিন করে হেদিয়ে মরেছে দীনু, সেটা শেষমেশ মিনুই আনল। সংসার এখন তরতরিয়ে চলছে। মিনুটারও মতি ভালো। বাজে খরচ করে না। মা-দাদার থেকে আলাদাও হয়নি। এখন প্রতি হপ্তায় খাসির মাংস আনতে যায় দীনু। ৬শ নয়, ৮শ গ্রাম করেই নেয়। মাসের শেষ হলেও আর তেমন টানাটানি পড়ে না।
দোকানে বসাটা এখন যেনো স্রেফ অভ্যেসের ব্যাপার হয়েছে। আজকাল খদ্দের আর কোথায়! ওই রান্না করতে গিয়ে কারও কিছু দরকার পড়লে ছেলেদের হাতে পয়সা গুঁজে দোকানে পাঠিয়ে দেয়। আর বাকি কটা ঘর এখনও মাসকাবারি তোলে, খাতার হিসেবে। আর লোক কই! সবাই শপিং মল থেকে বাজার করে। বুধবার বুধবার বেশি ছাড় দেয়। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দীনু দেখে, প্যাকেটের চাল, আটা, তেল নিয়ে সবাই ফিরছে। সস্তা হচ্ছে। সাইকেল থামিয়ে কেউ ওকে বলে যায়, মীনুই তো সব দেখিয়ে দিলো, কোনটা নিলে কম পড়বে, কোনটার সঙ্গে কী ফ্রি আছে, সব। বড় সুবিধা হয়েছে গো দীনু। পাড়ার ছেলে আছে বলে নিজেদের মতো করে সব বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেয়।
হাসে দীনু। এই অজ পাড়াতেও কোনোদিন শপিং মল হবে কে ভেবেছিল! ঠিক পাড়াতে নয়, একটু দূরেই হয়েছে। তবে সাত গাঁয়ের লোক যাতে জুটতে পারে তেমন জায়গাই বেছে নিয়েছে বড় মালিকরা। দীনু খবর নিয়ে দেখেছে, কাপড়ের দোকানও মার খাচ্ছে। শপিং মলে নাকি রোজই অমুখ তমুখ সেল লেগে থাকে। রোজ নাকি চৈত্রমাস। দিব্যি কম দামে নামী জামাকাপড় পাওয়া যায়। মিনুই তো তার জন্য এনে দিয়েছে। মাকেও দিয়েছে।
মিনুর উন্নতির কথা ভাবলে চোখে জল আসে দীনুর। ছোট ভাইটা ভালো থাকুক, এ কথা দু’বেলা মহাপ্রভুকে বলেছে সে। ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছে। এর থেকে ভালো আর কী হতে পারে! 
দোকানে আজকাল প্রায় একা একাই বসে থাকে দীনু। দু’-একটা খদ্দের যা আসে। মাল গস্ত করাও একরকম ছেড়ে দিয়েছে। যেটুকু লাগে মিনু সস্তায় এনে দেয়। সেটাই মোটামুটি লাভ রেখে বেচে দীনু। বহু দোকানদারই তাই করছে। এমন করলে দোকান থাকবে না। বোঝে দীনু। কিন্তু অমন অসুরের মতো মাল তোলার ক্ষমতা তার নেই। শুধু তার কেন, সাতটা দোকান এক হলেও পারবে না। তারা তাই অতো সস্তাতেও মাল দিতে পারে না। আর লোক হাতের কাছে সস্তায় পেলে খামোখা মুদির কাছে লাইন দেবে কেন! গরমে ঘামে কেন দাঁড়াবে, যদি ঠাণ্ডা ঘরে বাজার করতে পায়!
দীনু বুঝতে পারে দোকান আর আগের মতো চলবে না। ওই বিরাট বিগ্রহে মিলিয়ে যাওয়ার মতো একদিন ফুরিয়ে যাবে। বিধান মাস্টারের কথা সত্যি হলে, মহাপ্রভুরও তো তাইই হয়েছে। বা খুন হয়েছেন। তবু রথে কি আর ধুমধাম হয় না? হয় তো, আজও হয়। আগের থেকে বরং বেশিই হয়। দীনু বোঝে, মলটা এখানে হলো বলেই না মিনুটা উন্নতি করল। সংসারটা সচ্ছল হলো। প্রতি হপ্তায় মাংস যে হয়, সে কী এমনি এমনি!
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই দীনুর মনে পড়ে আজ উল্টোরথ। ও হরি! তাহলে তো এমনিই লোকজন আসবে না। ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টিও হচ্ছে। দোকান বন্ধ করেই দেবে ভাবল দীনু। একবার তার আসন ছেড়ে বাইরেটা এসে দাঁড়াল। আর এদিক-ওদিক তাকাতেই তার চোখ পড়ল, বৃষ্টি কেটে কেটে দূর থেকে এগিয়ে আসছে মৌসুমী। আজ এমন দিনে দেখা হবে কে ভেবেছিল! দীনুর ইচ্ছে করে বলে, মৌসুমী দাঁড়াও। দোকান বন্ধ করে একসঙ্গে ফিরি। কিন্তু সামলে নিলো। হয়তো ওর বর আছে কাছেপিঠে কোথাও। কিন্তু যতদূর চোখ যায় কাউকে চোখে পড়ল না। হাঁটতে হাঁটতে মৌসুমী তখন দোকানের একদম পাশটিতে। কী মনে করে বলেই ফেলল দীনু, দু’মিনিট দাঁড়িয়ে যাও। বিষ্টিটা ধরলে না হয়...
থমকায় মৌসুমী। তাকায় দীনুর দিকে। চুল ওঠা, টাক পড়া দীনু। চোখে অনেক কাকতি ধরে রাখা দীনুর চোখে চোখ রাখে সে। ভিতর অবধি কেঁপে ওঠে দীনুর। কিন্তু আর কিছু বলা হয়ে ওঠে না। ওই একপলক মাত্র পৃথিবী অন্যরকম। তারপর আবার নিজের মতো হাঁটতে শুরু করে মৌসুমী। এগিয়ে যায়। ঘাড় ঝুঁকে পড়ে দীনুর। নিজের অজান্তেই হাতটা উঠে যায় কপালে। অদৃষ্ট! আর দীনু টের পায়, এই প্রথম মৌসুমীকে কাছে পেয়েও গন্ধরাজের গন্ধ পেলো না সে। তার নাকে ঝাপটা দেয় খাসির মাংসের গন্ধ। আজ সকালে নিজেই কিনে এনেছিল সে।

যোগাযোগ

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৭
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ