২৩ জুলাই সোমবার সকালে ফিরে আসেন নিথর হুমায়ূন। বিমানবন্দর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে জাতীয় ঈদগাহ পর্যন্ত জনতার সমুদ্র।
অভূতপূর্ব বরণ ও বিদায়ের জনউচ্ছ্বাসে আগলে রাখা হলো জ্যোতির্ময় নক্ষত্রতুল্য জীবন্ত কিংবদন্তিকে। পুষ্প ও অশ্রুসিক্ত বিদায় অভিষেক শিরোনাম ছাড়া অন্য কোনো নামে ডাকা যায় না সেই জনআবেগের ইতিবৃক্তকে। কিংবা বলা যায়, হুমায়ূন আহমেদ সেদিন ছিলেন সত্যিকার অর্থেই ‘অভিষিক্ত নক্ষত্র’।
হুমায়ূন আহমেদের প্রত্যাবর্তনের দিনটির কথা যাদের স্মরণ আছে, তারা বলতে পারবেন, এ যেন শবানুগমন নয়। নয়নের জলে বরণের-বিদায়ের সমারোহ। পুষ্প ও অশ্রুসিক্ত অভিষেক। বরণের, বিদায়ের। শেষকৃত্যের আবহে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় একদিকে বিদেশাগত প্রিয়জনের জন্য বরণের ঢালী আর অন্যদিকে চিরবিদায়ের আয়োজন।
জনউচ্ছ্বাসের বাধভাঙা বেদনার্ত-কুসুমিত দ্যোতনায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মহাপুরুষ হুমায়ূন আহমেদ এভাবেই ফিরে আসেন স্বদেশে। স্বজনের প্রিয় প্রাঙ্গণে। প্রিয়তম বাংলাদেশে। তিনি এসেছেন চিরপ্রস্থানের মহাপথে চলে যাবার জন্যে। ট্র্যাজিডির রাজপুত্রের মতোই তার আসা আর যাওয়ার পথরেখা নীল জোছনার মায়াবী উথাল-পাথালে ভাসিয়েছে সবাইকে।
সমগ্র জাতির অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় ২৩ জুলাই সোমবার সকাল ৯টায়। ঢাকার মাটি স্পর্শ করে নিথর হুমায়ূন আহমেদকে বহনকারী উড়োজাহাজ। লাখো ভক্তের হাহাকার ও রোদনে ভারি হয় চারপাশের বাতাস। বুকচাপা কান্নায় তখন পুরো দেশ।
বিমানবন্দর থেকে শহীদ মিনারের পথে ঐতিহাসিক শবানুগমন। মৌন, তাপিত মানুষের আদিঅন্তহীন পদধ্বনি। রমনার সবুজে বিষাদের নীলজলে স্নাত লাখো মানুষের মাঝে জাতির সাংস্কৃতিক আত্মার প্রতীক শহীদ মিনার। জনতা সাগরের ঊর্মিমালায় সফেদ দ্বীপের মতো স্নিগ্ধ, শান্ত, সমাহিত হুমায়ূন। তারপর জাতীয় ঈদগাহ ময়দান। সার্বজনীন মানুষের সম্মিলিত প্রার্থনায় শেষতম বিদায়ের করুণতম সুর। মাটির গভীর টানে তখন এ মৃত্তিকার আদি, অকৃত্রিম ও শ্রেষ্ঠতম সন্তান।
শ্রাবণের রাত নেমে এলে সঙ্গে আসে হিমঘরের সযতন অপেক্ষা। বাংলাদেশের হৃদয়ের ঠিকানায় চলে যাওয়ার অপেক্ষা হুমায়ূনের। এ যেন অপেক্ষার রহস্যময় খেলা। হুমায়ূনের জন্যে মানুষের অপেক্ষা। দেশ ও বিদেশের তিরিশ কোটি বাংলাভাষীর অন্তহীন অপেক্ষা। অন্যদিকে মাটির আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য হুমায়ূন আহমেদের অপেক্ষা।
ইতিহাস কি কখনও দেখেছে মানুষের উন্মাতাল শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কষ্টের এমনই বরণ আর বিদায়? নিয়তির নির্মম ইঙ্গিতে হুমায়ূনকে বরণ করা হয়েছে বিদায় জানানোর জন্যেই। পৃথিবীর বুকে নিজের কয়েকটি শেষঘণ্টা তিনি বরণ আর বিদায়ের মেরুকরণে জনসমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে কাটিয়ে দিলেন।
আরও পড়ুন: নায়কের বীরোচিত প্রত্যাবর্তন
বাংলাদেশের মানব-হৃদয়ে বিষাদের মগ্ন-সুরে তিনি যাপন করলেন তার অন্তিম যাত্রা। পুরো যাত্রা পথটিকেও অঙ্কন করে রাখলেন ইতিহাসের বুকে। জীবনের মতোই মৃত্যু ও বিদায়ের কালেও তিনি ইতিহাসের জনক!
অখণ্ড বাংলা সাহিত্যে আর কাকে নিয়ে রচিত হয়েছে এমন বিষাদের-বিদায়ের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস? মাইকেল মধুসূদনের অন্তিম যাত্রা হয়েছিল নীরবে, অলক্ষ্যে। সত্যজিতের শেষযাত্রাপথ নিজের শহরকে স্পর্শ করলেও তার পুরো দেশবাসীকে নাড়াতে পারেনি। হুমায়ূন একটি আস্ত জাতিসত্ত্বাকে আন্দোলিত করে চলে গেলেন।
চলে গেছেন মানবসত্তার হৃদয়ে একটি কোমল পরশের ব্যাথা-জাগানিয়া মরমী সংগীত হয়ে। তুলনারহিত রবীন্দ্রনাথের কথা আনা যাবে না স্থান, কাল, প্রেক্ষাপট ও অতিমানবীয় আবেগের স্পর্শকাতরতার কারণে।
কিন্তু মানুষ রবীন্দ্রনাথকেও প্রকৃতি ও অগ্রযাত্রার শর্ত মেনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিক্রমের পথ করে দিতে হয়। উত্তরণের দিশা জাগাতে হয়। মানব ইতিহাস একজন থেকে আরেকজনে উত্তীর্ণ হতে হতে গড়ে তোলে নতুন ইতিহাস ও সভ্যতা। এভাবেই সভ্যতার মুকুটে যুক্ত হয় নতুন নতুন সোনার পালক। হুমায়ূন সোনার পালক নয়, কোহিনূর-খচিত আস্ত একটি হীরকদীপ্তিমান মুকুট সমকালীন বাংলা সাহিত্যের শিরে স্থাপন করে গেছেন। বাংলা সাহিত্যের আদি থেকে অন্তের সামগ্রিক ইতিহাসে তিনি হয়ে আছেন বহুমাত্রিক জ্যোতির নান্দনিক বলয়; দ্যুতিমান নক্ষত্র।
অসাধারণ মানবিক সত্ত্বার ব্যক্তিত্ব হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে অন্তরাল ভেঙে বাইরে আসতে থাকে বহু ঘটনা ও কাহিনী। হুমায়ূন আহমেদের গোপন পরহিত, মানব-কল্যাণের নানাদিক আবেগী উচ্চারণে প্রকাশ পেতে থাকে বহু কণ্ঠে। ভাবতে কষ্ট হয়, এত লোকপ্রিয়, মিডিয়ার কেন্দ্রবিন্দুর মানুষটির ভেতরের কষ্ট, একাকীত্ব, মানবসেবার গোপন বিষয়গুলোকে কী অসীম প্রচারবিমুখতায় লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি নিজেই! জনপ্রিয়তার সঙ্গে প্রচারবিমুখতার মহৎ সম্মিলন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তার মৃত্যুতে যে সত্যটি জানা সম্ভব হয় সকলের পক্ষেই।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটানা ছয়-সাত দিন লিড শিরোনাম থাকার মতো ঘটনা হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর কাকে নিয়ে হয়েছে? অদূর ভবিষ্যতে কাউকে নিয়ে এমনটি হওয়ার কারণও দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন প্রতিটি বাংলাভাষী মানুষ নিউনির্য়ক থেকে ঢাকার শেষ বিশ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি মূহুর্ত মানসিকভাবে হুমায়ূনের শবানুগমন করেছে। মানুষের আত্মা ও মননের সঙ্গী হয়ে তিনি সবাইকে তার সহযাত্রী করেছেন। মৃত্যুর দিগন্তবিস্তারী কালো চাদরের সীমানায় একাকার করেছেন বাংলা সাহিত্যের সকল পাঠককে; নিজের বিচ্ছিন্ন পরিবারকে; গুলকেতিন, শাওন, নুহাশকে, পুত্র ও কন্যাগণকে। জীবনে বারবার ব্যর্থ হলেও মরণের যাত্রাপথে তিনি ছুঁয়ে ছিলেন তার আত্মার সকল আত্মীয়কে।
যারা বেঁচে আছেন, হুমায়ূন আহমেদ তাদের সামনে কর্ম-কীর্তি ও ভালোবাসার এক মহারাজপথ উন্মুক্ত করে দিয়ে গেছেন। আবেগের জলোচ্ছ্বাস শেষে বাস্তবের কঠিন মাটিতে এসে তার পদচিহ্ন ধরে সৃষ্টি ও নির্মাণের আরও দীর্ঘতম পথে চলার আবাহন জানিয়ে গেছেন তিনি। তিনি কালান্তরের কণ্ঠে বাংলার মানুষ, ভাষা সাহিত্যের অবিনাশী গান গেয়ে গেছেন। জাতির সাংস্কৃতিক সত্তার সেই যাত্রাপথে হুমায়ূন আহমেদ বাংলার ভাবসম্পদের আলো-ছায়ায়, লোকান্তরের মরমী মায়ায়, পরম্পরায়, প্রেমে ও ভালোবাসায় সঙ্গী হয়ে আছেন সমগ্র জাতির।
লেখক: ড. মাহফুজ পারভেজ, কবি, লেখক ও অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল:
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৭
এমএ