ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

গল্প

এই সময়ের গল্প-১

টান । আকাশ মামুন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২০ ঘণ্টা, আগস্ট ১, ২০১৭
টান । আকাশ মামুন টান । আকাশ মামুন

মেরুন শাড়িতে মুড়ে বসে আছে জেবিন। জীবনের প্রথম শাড়ি পরার সময় যেমন হাঁসফাঁস লাগে, বিতৃষ্ণা জাগেÑ তেমনটা লাগছে। প্রথম কবে শাড়ি পরেছিল সেই স্মৃতি মনে নেই জেবিনের। শাড়ি পরতে যে তার খারাপ লাগে তেমনটাও নয়। বরং শাড়ির প্রতি বাড়াবাড়ি রকম একটা প্রীতি আছে।

তবে আজ লাগছে, অপ্রকাশযোগ্য বিরক্তি লাগছে। যেনো মানুষখেকো লতানো গাছের মতো শাড়িটা শরীরে জড়িয়ে গলা অব্দি উঠে এসেছে।

নিজের প্রতি নিজের কর্তৃত্ব খর্ব হতে হতে নাটাই ছেড়া ঘুড়ির মতো দূরে সরে যাচ্ছে। যার পতন নিশ্চিত, কিন্তু ভবিতব্য কল্পনার বাইরে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। অনুভূতি অবশ হয়ে যাচ্ছে। এখন শুধু পতনের অপেক্ষা।

শরীরের দৃশ্যমান জায়গাগুলোতে ভারি গহনার ভার। যেনো অজগরের মতো জড়িয়ে আছে। গিলে ফেলার আগে করায়ত্বে নিয়ে নিচ্ছে জেবিনকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত রক্ত শুষে নেবে, নিস্তেজ হয়ে চোখ বুজে না ফেরার দেশে চলে যাবে জেবিন। অদৃশ্য জায়গাগুলোরও যতœ নেওয়া হয়েছে যতœ করে, সময় দিয়ে। ইচ্ছা না থাকলেও করা হয়েছে, সবার চাপাচাপিতে। পুতুলের মতো সে শুধু নিজের অস্তিত্বকে স্বীকার করেছে। বাকি সব অন্যদের ইচ্ছার দাস হয়ে পূরণ করতে সাহায্য করেছে।  

অরিত্র যা করেছে তার সঙ্গে আর স¤পর্কটা টেনে দীর্ঘ করবার কথা চিন্তা করতে পারেনি জেবিন। মাস ছয়েক আগে অরিত্রদের বাসা থেকে জেবিনকে দেখতে আসার কথা ছিলো। সব কিছু ঠিকঠাক। কাছের আত্মীয়দের জানানো হয়ে গেছে। আর মাত্র একদিন বাকি। রাত পোহালেই দেখতে আসবে। দীর্ঘদিন থেকে যে ঘর-সংসারের স্বপ্ন দেখে আসছে, তা পূরণ হওয়ার দোরগোড়ায় এসে, নিজেদের আট বছরের চড়াই-উৎরাইয়ের স¤পর্কটা ভেবে পুলকিত বোধ করছিল জেবিন।
দেখতে দেখতে আট বছর চলে গেছে। অথচ মনে হচ্ছে, সেদিন ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের ফিজিক্স ল্যাব থেকে অপ্রত্যাশিত পরিচয়। ভার্নিয়ার স্কেল ভেঙে ফেলেছিল জেবিন। নিশ্চতভাবে কামরুল স্যারের বকা খেতে হবে। শাস্তি হিসেবে আর একটা ভার্নিয়ার স্কেল কিনেও দিতে হবে। ল্যাব টেকনিশিয়ান সুবোধ সান্ন্যালকে ফাঁকি দিয়ে আর একটা ভার্নিয়ার স্কেল এনে দিয়েছিল অরিত্র। সেই থেকে পরিচয়-বন্ধুত্ব। থিউরি-ল্যাবের পড়া, আড্ডা, চা আর শিঙাড়ার ফাঁকে বন্ধুত্ব কখন যে প্রেমে গড়িয়েছে, টেরই পায়নি। অনার্স-মাস্টার্স পেরিয়ে অরিত্র এখন রূপপুর অ্যাটমিক পাওয়ার প্ল্যান্টের রিসার্চ উইংয়ের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
বিসিএস দিয়ে জেবিন ঢুকেছে প্রশাসন ক্যাডারে। দু’জনের বাসা থেকেও চাপ ছিলো। তাই বিয়েটা সেরে ফেলতে চাইছে দু’জনই। হঠাৎ রাত আটটার দিকে মোবাইলে টেক্সট এলো অরিত্রর। কোনোভাবেই তোমার মতো স্বার্থপরকে বিয়ে নয়। এতোটুকুই। কোনো ব্যাখ্যা নেইÑ কেন এই টেক্সট। টেক্সট পেয়ে জেবিন কয়েকবার চেষ্টা করেছে অরিত্রর সাঙ্গে যোগাযোগ করতে। অরিত্র সাড়া দেয়নি। শেষে ফোন বন্ধ করে রেখেছে। এদিকে, কাছের সব আত্মীয়দের জানানো হয়েছে। রাত পোহালেই তারা চলে আসবেন। বিয়েটা এখন শুধু জেবিন আর অরিত্রর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন সেটা রীতিমতো পারিবারিক-সামাজিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেখানে দু’টি পরিবার, এর সঙ্গে জড়িত আরও অনেকগুলো পরিবার এবং একটা বৃহৎ সমাজ জড়িয়ে পড়েছে। এই আন্তঃসম্পর্কের জালে অরিত্রর চেয়ে ভাবনা জেবিনের বেশি। জবাবদিহিতার দায় তীব্র। বিষয়টা তাই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ালো। রাত দশটায় জেবিনের কান্নায় মা হুমায়রা পারভিন অরিত্রর মায়ের সঙ্গে কথা বললো। অরিত্রের মা বলল, আপা দেখেন ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে।
তাদের নিজস্ব পৃথিবী, পছন্দ-অপছন্দ আছে। সেখানে আমাদের প্রবেশ অধিকার সংকীর্ণ। তবে অরিত্র রাজি হলে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু সেটা বোধ হয় আর হচ্ছে না সহজে। কোনো সমাধান না পেয়ে শেষে যাদের আসার কথা ছিলো তাদেরকে ঘটনা স্ববিস্তারে বলে দেওয়া হলো, কাল ছেলেপক্ষ আসছে না।
সেই থেকে অরিত্রকে একেবারে মন থেকে মুছে দিয়েছে বলে নিজেকে বুঝিয়েছে জেবিন। বাবার পছন্দের ছেলেকে নিজের অপছন্দ সত্বেও মেনে নিয়েছে।
বাবা হাত ধরে বলেছে, মা, অরিত্রকে-তো তুই-ই আর স্বীকার করিস না, ফয়সালকে তুই মেনে নে। ফয়সাল ভালো ছেলে। ভালো চাকরি, তিতাস গ্যাস ফিল্ডের সিনিয়র সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার। বাবা হয়ে তোর কাছে আমি অনুরোধ করছি।
আমাকে আর চিন্তায় রাখিস না। বয়স হয়ে গেছে মা। আমার চিন্তা হয়তো তুই আজ বুঝতে পারবি না। আল্লাহ যদি কোনোদিন মা করে তবে সেদিন নিশ্চয় বুঝবি। হয়তো আমি সেদিন থাকবো না। বলতে বলতে বাবা হাত ধরে কাঁদতে লাগলো। তাইতো সেদিন আর না করতে পারেনি। বাবাকে হ্যাঁ করে দিয়েছিল।
বাবার সঙ্গে কেঁদে-কেটে বলেছেল, বাবা আমি তোমার মেয়ে, তোমাকে কষ্ট দিতে পারি? তোমার যা ভালো মনে হয় করো। তোমাদের শান্তিই আমার সুখ।
হ্যাঁ-রে মা, বাবা হয়ে আমি কি তোর অমঙ্গল হতে দিতে পারি! তুই ফয়সালের সঙ্গে সময় নিয়ে কথা বল। এতো তাড়াহুড়ো নেই। ও খুবই ভালো ছেলে। আমি নিশ্চিত তোর ভালো লাগবে।
এসবের কিছুই প্রয়োজন হবে না বাবা। তুমি দ্রুত বিয়ের আয়োজন কর।
দেখিস মা একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই সুখী হবিÑ পাশে বসে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বাবা বললেন। জেবিনের চোখে নির্লপ্ততায় জল গড়িয়ে যাচ্ছিল।

আজ বাবার পছন্দের ছেলে ফয়সালের সঙ্গেই বিয়ের পিঁড়িতে বসছে জেবিন। কিন্তু সব কিছু উলট-পালট করে দেয় অরিত্রর ফিরে আসা। রেস্টুরেন্টে গতকাল হাত ধরে ভেউ-ভেউ করে কান্না শুরু করে দেয়। চারপাশের মানুষ আড়চোখে তাদের দেখছিল। জেবিন অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। চারপাশে সবার দৃষ্টি বিব্রত করছিল তাকে।
দীর্ঘ ছয় মাসে অরিত্রর বিরুদ্ধে জমানো ক্ষোভ আর ঘৃণা তার ভিতরে অরিত্রকে প্রতিহত করার যে দেয়াল তৈরি করেছিল, চোখের পানির স্রোত সে দেয়ালকে বালির বাঁধের মতোই ভেঙে দিলো। অরিত্রর কান্নাকে উপেক্ষা করার শক্তি জেবিনের মধ্যে আর অবশেষ রইলো না। নিজের অজান্তে জেবিনও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁপে উঠলো। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। বিয়ের সব যোগাড়যন্ত শেষ। চব্বিশ ঘণ্টাও বাকি নেই। এখন জেবিনের আর কিছুই করার নেই।
শেষে অরিত্র হাত জড়িয়ে ধরা গলায় বলেছে, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। ততোদিন আমি একা থাকবো। তোমার মন চাইলে নির্দ্বিধায় ফিরে আসতে পার। বিনা প্রশ্নে আমি তোমাকে আমার করে নেবো।
জেবিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলেছিল, ফিরে যদি আসবে তবে আর একটু আগে এলে না কেন? অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমার হাতে কিছুই অবশিষ্ট নেই।
অরিত্র বলেছিল, তুমি চাইলে সবই সম্ভব। সবই তোমার হাতেই আছে। শুধু তোমার ইচ্ছাই অনেক কিছুই বদলে দিতে পারে।
না, তা নেই আরিত্র-নাক টানতে টানতে জেবিন বলেছে। বলেছে, নাটাই ছেড়া ঘুড়ি এখন আমি। আমার ইচ্ছে এখন অদৃশ্য কারও হাতে।
অরিত্র বলেছে তবে তাই যদি হয় তবে পতন অব্দি অপেক্ষা তো করতে পারি আমরা, শেষ দৃশ্যের জন্য। আগেই কেন হাল ছাড়বো?
তা হয় না অরিত্র, সব পতনই মধুরেন হয় না। তার চেয়ে নিজেদের পথেই হাঁটা ভালো। নিজের জীবন গুছিয়ে নাও। আমাকেও গোছাতে দাও। কষ্ট হবে, তবে সয়ে যাবে। সময় কী না সয়।
অবিরত ঝরে চলা চোখের জলকে বাধা দেওয়া বা মোছার কোনো চেষ্টা ব্যাতিরেকে অরিত্র বললো, তবুও আমি প্রতীক্ষায় থাকতে চাই। শেষ দৃশ্য করুণ না হয়ে মধুরও-তো হতে পাওে, যদি তুমি চাও। আমি দেখতে চাই।
অরিত্রের শেষ কথাগুলো জেবিনের কানে বাজছে কাল থেকে। তাইতো এই জাঁকজমক, এই সাজ-সজ্জা, চারপাশের আনন্দ তার কাছে হাসফাঁস লাগছে। শত অনিচ্ছাকে ঠেলে শেষতক বিয়েটা হয়েই গেলো। অপ্রত্যাশিত কিছুই ঘটলো না। কোনোকিছুই আর বাধা হয়ে দাঁড়ালো না। জেবিনের সব প্রার্থনা, অনিচ্ছা, না-চাওয়াকে ব্যর্থ করে দিয়ে ফয়সাল সঙ্গে করে নিয়ে গেলো জেবিনকে।
কিন্তু জেবিন কোনোভাবেই মনকে বোঝাতে পারছে না। ফয়সাল যে অপছন্দ করার মতো তেমনটা নয়। একটা বলিষ্ঠ, প্রগাঢ় ব্যক্তিত্ব যেনো ঘিরে থাকে তাকে। দেখলেই নির্ভর করা যায়। কিন্তু জেবিনকে তার কিছুই আকৃষ্ট করলো না। তার সমস্ত হৃদয়জুড়ে কেবল অরিত্র ভর করে রইলো। তাই তো স্বিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। ফয়সালকে সব খোলে বলবে। বলবে কোন ভাবেই তার পক্ষে ফয়সালকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তার চেয়ে এই ভালো আলাদা হয়ে যাবে তারা।

কথা শুনে ফয়সাল যেনো বজ্রাহত হলো। শুধু জিজ্ঞেস করলো, আপনি আগে কেন বলেননি? সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিজের দোষ স্বীকার করে নিয়ে জেবিন বললো, ভেবেছিলাম সবকিছু মানিয়ে নিতে পারবো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তা আর পারবো না। সারা জীবন আপনাকে ঠকাতে চাই না। নিজেও ঠকতে চাই না। এতে দু’জনের কেউই সুখী হতে পারবো না।
উত্তেজিত হয়ে ফয়সাল বললো, স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের সুখটাই দেখলেন, আমার কথা কী একবারও ভেবেছেন? আমার যে একটা পরিবার আছে, একটা সমাজ আছে, সামাজিক মর্যাদা আছে, এর কী হবে একবারও ভেবেছেন? জেবিন কোনো উত্তর করেনি। পরক্ষণেই ঠা-া হয়ে গেলো ফয়সাল। আড়চোখে জেবিন দেখলো, বেশ অসহায় লাগছে তাকে। একজন ব্যর্থ ভেঙেপড়া মানুষের সত্যিকারের চিত্র ভেসে উঠছে তার চেহারায়। জেবিন ভেবে দেখেছে-সে আসলে অসহায়। বেলকনির গিয়ে বসেছে ফয়সাল। দীর্ঘক্ষণ হলো। সময়ের হিসেবে ত্রিশ মিনিট। জেবিন স্থির দৃষ্টি নিয়ে খাটে বসে আছে।
বুঝতে পারছে না, তার কী করা উচিত। সে কি বেলকনিতে গিয়ে দেখবে নাকি এভাবেই বসে থাকবে। সাত-পাঁচ ভেবে যখন কোনো কিনারা পাচ্ছিলা না, তখনই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো ফয়সাল। এসে অনেকক্ষণ পায়চারি করে শেষমেশ সোফায় বসলো। বোধ হয় সিগারেট টেনে এসেছে। বেশ গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এয়ার ফ্রেশনারের কড়া গন্ধ ঠেলেও নাকে এসে লাগছে। হয়তো কোথা থেকে শুরু করবে ভাবছে। এতোক্ষণ ভেবে যে সিদ্ধান্তটা নিয়ে এসেছে তা গুছিয়ে বলতেই এই সময় নিচ্ছে। পরিবেশ সহজ করতেই জেবিন বললো, আপনার অস্বস্তি লাগছে? বিশ্রাম নিন। ফয়সালের সাড়া না পেয়ে খানিকটা থেমে বললো, ঘেমে যাচ্ছেন, এসিটা কমিয়ে দেবো? ফয়সাল বললো, না, ঠিক আছে। যেনো বলার পথটা সহজ হয়ে গেলো।
কথা বলার সুযোগ পেয়ে ফয়সাল বললো, আপনার অনুভূতিকে আমি সম্মান করি। আমি আপনাকে জোর করবো না, যদিও চাইলেই তা করতে পারি।
কথাটা শুনে জেবিনের মাথাটা ভনভন করে উঠলো রাগে। জোর করবে মানে। আমি কি গরু নাকি! যা ইচ্ছে হবে, গলায় দড়ি লাগিয়ে তাই করবে! কিন্তু পরক্ষণেই কৌতুহলি করে তুললো।
ফয়সাল বললো, আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি, তবে একটা শর্তে।
সেটা কেমন? জেবিন সোজাসোজি ফয়সালের চোখে তাকিয়ে বললো। আসলে বোঝার চেষ্টা করলো কোনো চালাকি আছে কিনা! কিন্তু একজন পরাজিত মানুষের যে চেহারা হয়, ফয়সালের মধ্যে এর পুরোটাই ফুটে উঠেছে। চালাকি করার সময় এটা নয়। চালাকির কোনো কিছু খুঁজেও পেলো না জেবিন।
ফয়সয়াল বললো, কালই খবর পেয়েছি। ভেবেছিলাম, খুশির খবরটা আজ এই সুখের রাতে আপনাকে জানাবো। সেরকমটি আর হচ্ছে না। আমার জীবনের অনেক বড় একটা সাফল্যের খবর আপনার সঙ্গে উৎযাপন করবো ভেবেছিলাম। ইচ্ছেটা অপূর্ণই রয়ে গেলো। ছয় মাসের মধ্যে আমি পিএইচডি করতে অস্ট্রেলিয়া চলে যাবো।
আপনার কাছে অনুরোধ থাকবে, এই ছয় মাস আমকে সময় দেবেন। তারপর আপনার ইচ্ছেমতো আমি সব ডকুমেন্ট আপনার হাতে তুলে দেবো। আপনি অরিত্রকে বুঝিয়ে বললে আমার মনে হয় সে বুঝবে, যদি সে আপনাকে ভালোবাসে। আর এর মধ্যে যদি আপনার মনের পরিবর্তন হয় তবে সেটাও জানাবেন। আমি আপনার পরিবর্তিত মনের প্রতীক্ষায় থাকবো। তখন একসঙ্গে মেলবোর্ন চলে যাওয়া যাবে, আপনার অতীত রেখে অনেক দূরে। বলেই আবার বারান্দায় চলে গেলো ফয়সাল।

শর্তমতোই সবকিছু এগোচ্ছে। কেউই তাদের সীমা লঙ্ঘন করেনি। সীমার মধ্যে থেকেই কাগজসর্বস্ব আকারহীন স¤পর্কটা গড়িয়েছে বন্ধুত্বে। প্রথমদিকের সেই অস্বস্তি কেটে গেছে মাস ঘুরতেই। ফয়সাল অফিস থেকে ফেরার সময় খুঁজে খুঁজে জেবিনের শখের ঝুমকা নিয়ে আসে। এখন অব্দি সাতাশ জোড়া পূর্ণ হয়েছে। তাছাড়া ঘোরাঘুরি, নৌকায় চড়ে বেড়ানো বন্ধুত্বটাকে আরও গাঢ় করেছে।

অরিত্রর সঙ্গে নিয়মিত দেখা হচ্ছে। ফয়সালই সুযোগ করে দিচ্ছে। একদিন জেবিন দীর্ঘ সময় নিয়ে আয়নার সামনে সাজগোছ করছিল। ড্রইংরুম থেকে ফয়সাল এসে বললো, চলো আজ তোমাকে আমি দিয়ে আসছি। আশ্চর্য হওয়ার মতো কণ্ঠে উদ্বেগ চড়িয়ে জেবিন বললো, দিয়ে আসছি মানে কোথায়? মুচকি হেসে ফয়সাল বললো, তুমি যে অরিত্রের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছো, সে তোমার সাজের সময় আর ধরন দেখেই বুঝতে পেরেছি। অস্ফুটস্বরে জেবিন শুধু বললো, ঠিক আছে যেয়ো।

অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছে ফয়সাল। শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বিদায় জানাতে এসেছে ফয়সালের বাবা-মা, বোন আর শ্বশুর-শাশুড়ি। বিদায় বেলা জেবিনের চোখ কী একটু ভারী হচ্ছে? এতোদিনে কী ফয়সাল তার ভেতরে কোনো পরিবর্তন আনতে পেরেছে? তবে তার চোখ ভারী হচ্ছে কেন? জেবিন প্রাণপণে চোখ ভেঙে জল আসা আটকাচ্ছে। বাড়ির কুকুরের প্রতিও তো মানুষের মায়া জন্মায়। আর অনেকটা সময় ফয়সালের সঙ্গে কাটিয়েছে জেবিন। তাই মায়া হওয়াটা স্বাভাবিক, অন্যকিছু নয় বলে নিজেকে বোঝালো জেবিন। জেবিনের শ্বশুর বলছিল, বউমা তুমি ফয়সালের সঙ্গেই ইমিগ্রেশন এরিয়া অব্দি যাও, ওর ভালো লাগবে। শত বাধা সত্বেও এক ফোটা জল জেবিনের চোখ থেকে টুক করে পড়ে গেলো। ফয়সালের চোখ এড়ালো না সে দৃশ্য। ফয়সালই বললো, না বাবা, মায়া বাড়িয়ে কাজ নেই। তোমরা বরং যাও এবার। একান্তে জেবিনকে বললো, সব কাগজ তৈরি করেই যাচ্ছি। দু-এক দিনের মধ্যেই পেয়ে যাবে। তোমার ওই এক ফোঁটা জল আমি সারা জীবন বুকের মধ্যে জমা রাখবো। কখনও টলতে দেবো না। তুমি ভালো থেকো। চোখ মুছতে মুছতে নিরাপত্তা দোর গলিয়ে আড়াল হয়ে গেলো ফয়সাল।

অরিত্র আর জেবিন বিয়ে করেছে। ওহাইয়ো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ন্যানো পার্টিকেল নিয়ে পড়তে যাচ্ছে অরিত্র। এফ-২ ভিসাতে জেবিন অরিত্রের সঙ্গে যাচ্ছে। প্রফেসরের সঙ্গে কথা হয়েছে, সামনের ¯িপ্রংয়ে ফান্ডিং থাকলে জেবিনও ভর্তি হয়ে যাবে। কিন্তু বিপত্তিটা শুরু হয়েছে ওহাইয়োতে আসার পর। একদিন ল্যাব থেকে ফিরে এসে দেখে বাসার সব অগোছালো। রান্নাঘরে যাচ্ছেতাই অবস্থা। নিজে থেকেই বাইরে গিয়ে হাবিজাবি অনেক কিছুই কিনে এনেছে জেবিন। সেগুলো মেঝেতে ছড়ানো। চিৎকার-চেচামেচি করতে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলো অরিত্র। কেমন বাচ্চাসুলভ আচরণ করছে জেবিন। যেমনটি আগে কখনও দেখেনি। সন্দেহ হওয়ায় আট ঘণ্টা ল্যাবের ধকল শেষে ক্লান্ত শরীরে ডাক্তারের কাছে ছুটলো অরিত্র। অনেকগুলো টেস্ট রিপোর্ট দেখে পরদিন ডাক্তার বলেলো, যেমনটা সন্দেহ করেছিলামÑ বায়পলারের সঙ্গে সায়কোসিস দেখা দিয়েছে। হ্যালুসিনেশন, ডিলিউশন আর ডিপ্রেশন দিন দিন বেড়ে যাবে। মানসিক কোনো আঘাত থেকে এমন হতে পারে। অরিত্র তাদের বিয়েপূর্ববর্তী সব ঘটনা ডাক্তারকে বললো। ডাক্তার সব শুনে যা বলেছে, তাতে অরিত্রর ভিতরটা শিকারির গুলিতে আহত পাখির মতো তপড়াতে থাকলো। নিজেকে অভিকর্ষজ ত্বরণহীন শূন্য মনে হলো। ডাক্তার বলেছে, ফয়সালের প্রতি জেবিনের একধরনের টান তৈরি হয়েছিল। সেখান থেকে ছেড়ে আসার পর হয়তো তার ভিতরে অপরাধবোধ কাজ করে থাকবে এবং সেটা তার ভাবনার জগতে গভীর ছাপ ফেলে। ধীরে ধীরে সে ডিপ্রেসড্ হতে থাকে এবং সে এখন বাইপলারের তৃতীয় স্তরে আছে। একমাত্র নিয়মিত চিকিৎসা আর মানসিক পরিচর্যাই পারে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। ডাক্তারের চেম্বারের কাঁচ ভেদ করে বাইরে একবার জেবিনের দিকে তাকালো অরিত্র। তিনটি সেলফোন নিয়ে শিশুদের মতো খেলছে। একটা ফোনে প্রশ্ন করে অন্য কানে আরেকটা ফোন ধরে নিজেই উত্তর দিচ্ছে। বেশকিছ ুদিন থেকেই কিছুটা অসংলগ্ন আচরণ খেয়াল করেছে কিন্তু আমলে নেয়নি অরিত্র। ল্যাবের চাপে ওসবে মনযোগ দিতে পারেনি। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিলো অরিত্র। নিজেকে বুঝিয়েছে, স্রষ্টাকে সাক্ষী রেখে সুখে-দুখে তোমার সঙ্গে থাকবো ওয়াদা করেছিলাম। নিশ্চয়ই আমি সেই ওয়াদা রাখবো।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে এসেছে। তুষার পড়ছে। একা একাই হেসে গড়িয়ে পড়ছে জেবিন। তুষার কুড়িয়ে অরিত্রের দিকে ছুড়ে মারছে আর খিলখিল করে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। নিজেকে দৃঢ় করে অরিত্রও তুষার ছোড়াছুড়িতে যোগ দিলো আর লক্ষ্যহীনভাবে হেসে চললো।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০১৭
এসএনএস

এই সময়ের এক কুড়ি গল্প পড়ুন বাংলানিউজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ