ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

গল্প

এই সময়ের গল্প-৬

জীবনের ছুটি নেই । জব্বার আল নাঈম

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২৬ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১৭
জীবনের ছুটি নেই । জব্বার আল নাঈম জীবনের ছুটি নেই

অনেক দূরে বিল। বিলের এপাশ থেকে ওপাশের কিছু দেখা যায় না। সামনে কোথাও যেনো আকাশ নেমে গেছে। ভাবি, কৌতূহলে দৌড়ে গেলেই ছোঁয়া সম্ভব! ইচ্ছে হলেই সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উপরে ওঠা যাবে। অথচ তা কখনই হয়ে ওঠে না। আশপাশেও দেখা যায় না জীবনের অস্তিত্ব। তবে, অনেক দূরে বিলের অন্য মাথায় ছোট একটি গাছের মতো দেখা যাচ্ছে। সেটা গাছ নাও হতে পারে। রোদের প্রতাপকে প্রতিবাদ জানিয়ে দূরের গাছ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কালের সাক্ষী কিনা তাও জানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

প্রচণ্ড শরীরে সমস্ত সূর্য মেখে তার উপর নদীর জল ঢেলে, নিজের কাছে নিজেকে ছেড়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া। মাথায় তখনও বারোয়ারি ভাবনারা কিলবিল করছে পৃথিবীর বাইরে।

জীবন্ত মরুভূমির আকৃতি যেনো! না হয় পথে তৃষ্ণা মেটানোর জল থাকবে না কেন?

প্রেমের কলঙ্ক গলায় লেপ্টানো আছে। টানতে হচ্ছে মায়ের মুখের চির সত্য ভবিষৎবাণী। মনের অলিগলির সেই সত্য কেউ টানতে পারছে না। আমার অবাধ্যতা সহ্য করতে না পেরে বাবা আগেই পরপারের সওদাগর হয়েছেন। অসহায়গ্রস্ত জীবন সাজাতে জ্বলন্ত কয়লা হাতে হেঁটেছি কতো কতো রাস্তা! হাজার মাইলের পানিপথ। সেখানেও চরম রকমের ক্রোধ জমা। ক্রোধের গায়ে আগুনের নগ্ন নৃত্যের আসর বসে রোজ।

শুনেছি জলের হাত-পা, চোখ-মুখ এবং শ্বাস-প্রশ্বাস আছে। নারীর মতো দেখতে সুশ্রী, সুন্দর। তুলতুলে হাত, টলটলে দেহ, সুডৌল যুগলস্তন। আবেগপ্রবণ মায়া আমার নিষ্কাম মস্তিষ্কে লোভের ব্যাকরণ মুখস্ত করায়। নিরূপায় আমি গলতে থাকি হাতের উপর হাত রেখে। সূর্যের তাপে। চোখের ভেতর অপ্রকাশিত চোখের ভাষা। কিছুটা আবেগ। কিছুটা আবেশ। নিশ্চিত মূর্খতায়। বোকাগলির অন্ধ পথে হাঁটতে হাঁটতে চালাক হওয়ার সৌভাগ্য হলো না আর!

ভালোবাসতে বাসতে গুরুত্বপূর্ণ অনেক অধ্যায় ভুলে বসেছি। কোনো কালে ব্লেইসি প্যাসকেলের ক্যালকুলেটরেও তা ধরবে না। একদা মোহের ছলাকলায় নিঃস্বার্থ কলমে লিখে নিয়েছিলাম তোমার নাম। মাটিকে কাগজ বানিয়ে। ফলস্বরূপ জিকির বনে বসে তসবিহ গুনতে গুনতে ধ্বংসের দিকে গিয়েছে পিতামহের প্রাচীন শহর। বিত্ত ভৈবরে মিথ্যা আশ্রয় ও আশায়। পিঁপড়াকে প্রণাম জানিয়ে সাম্রাজ্য জ্বালিয়ে দিয়েছে দ্বিতীয় মোঘল বংশ। ভুলের খেসারত দিতে মোঘলরা প্রতাপ ও প্রভাব হারানোর সাথে হারিয়েছে ভারতবর্ষ। হায়, অধঃপতন! মানুষ যাকে অভিশাপ বলে বাতাসে ভাসিয়ে দিতে চায়, আসলে তা অসুস্থ চিন্তার প্রতিফসল। এমন চিন্তা সময়কে নিশ্চিত পরাজয়ের প্রান্তে পৌঁছে দেবে। যা রাজ্যের সর্বশক্তি প্রয়োগেও উদ্ধার করা অসম্ভব!

০২
একটানা দুইদিন দুইরাত ধরে হাঁটছি। শরীর সামনের দিকে এগোচ্ছে না। এটাই নিয়ম! তখনও সূর্যকে ক্লান্ত অবিশ্রান্ত লাগেনি। অথচ প্রতিদিন বিশ্রামের খুপড়ি ঘরে প্রবেশ করে সে। আমার চোখে রাজ্যের ঘুম। নিজেকে মাটিতে এলিয়ে দিলাম। সূর্য বিশ্রাম শেষ করে কপালে আলোর স্ফুরণ ফেলে। আড়মোড় ভেঙে হাঁটতে শুরু করি। হঠাৎ চোখে পড়ে একটি বিড়াল। আমার ছায়ায় হাঁটছে। বিষণœতা কাঁটিয়ে কৌতূহলে দাঁড়াই। বিড়ালও দাঁড়িয়ে যায়। করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। তখন নানান ভাবনা মাথায় কাজ করে। এটি হয়তো খারাপ কিছু হবে। আবার ভাবি, সম্ভবত দৃষ্টিভ্রম। এক সময় এসব ভাবনা মিথ্যা প্রমাণিতও হয়। আসলে সে আমার মতো সংসার ত্যাগী। নিঃসঙ্গতার বন্ধু। আমার বন্ধু ভাগ্য বরবরই ভালো। তবে দুর্দিনের নয়। সুদিনের।  

পুনরায় চলতে শুরু করি। বিড়াল আমার আশ্রয়-প্রশ্রয়ের ছায়ায় হাঁটছে। যদিও কিছুটা ক্লান্ত সে। মাঝে মাঝে পায়ের খুব কাছাকাছি চলে আসে। বিরক্ত হই। আবার বিরক্তিভাব কেটেও যায়। আস্তে আস্তে প্রগাঢ় মমত্ববোধ কাজ করে। আবেগ হারানো আমি অচেনারে চিনি নিজের বিসর্জনে। বিড়ালের প্রতি অদ্ভুত রকমের মায়ার জন্ম হয়েছে। ঠিক কেন জানি না। হয়তো সে ক্লান্ত শরীর নিয়ে হাঁটতে পারছে না বলে। অনেকক্ষণ দৌড়ে হাঁটার পর আরও ক্লান্ত। ক্রমেই নিস্তেজ হচ্ছে।

দ্বিতীয় জীবনের কাছে যেতে চাই না। ভালোবাসা দিতে বা নিতেও না। নিঃসঙ্গতায় মন খারাপ করে বসে থাকব অথবা হাঁটব উদ্দেশ্যহীন দিকে। দ্রুত পায়ে সামনে অগ্রসর হই। সঙ্গে বিড়ালও। আবার পিছিয়ে পড়ে। একটা সময় অনেক পিছিয়ে যায়। ছায়ার সাথে হেঁটে কুলোয় না। বার বার পিছিয়ে পড়তে থাকে। আমার মায়ার দরজা দ্বিগুণ প্রশস্ত হতে থাকল। হাঁটু গেড়ে সামনে বসি। বিড়াল সামান্য ভয় পেয়েছে বলে মনে হলো না। চোখে মুখে অস্থিরতা নেই। একদম স্বাভাবিক। জানতে চাই, তুমি কোথায় যাবে? কথা শুনে সামনের দিকে তাকায়। বুঝতে পারি, সে আরও দূরে যাবে। জানতে চাই, তুমি খুব ক্লান্ত? বিড়াল দু’চোখ বোজে। কিছু বোঝার ভান করে বামহাত সামনে রাখি। বিড়াল সাবলীল ভঙ্গিতে উঠে আসে। ঘাড়ের উপর বসিয়ে হাঁটতে থাকি। আমি ফ্লাশব্যাকের রাস্তায় ভিডিও অন করে অতীতকে সামনে দাঁড় করালাম। কিছুটা বিস্ময় বাড়ল।

আমরা দু’জনেই ক্লান্ত। ভাবলাম জিরিয়ে নিই। বিড়ালকে জিজ্ঞাসা করি, বাড়ি কোথায়? বাবা-মা কোথায় থাকে? উত্তর নেই। বোবার মতো ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে আছে। এখন বিড়ালকে কাছের স্বজন মনে হয় আমার। আচ্ছা, তোমাকে বারবার বিড়াল ডাকতে ভালো লাগে না। বরং একটা নাম দেই। কেমন? সে মাথা কাত করে উচ্ছ্বাসে সহমত প্রকাশ করে। মিতু। মিতু আমার খুব কাছে একজনের নাম। আজ থেকে তুমিও ‘মিতু’।

এখন দু’জনের ভবিষৎ এক। অজানা। ক্লান্ত মনে মিতুকে পেয়ে একটু হালকা অনুভব করছি। কিন্তু, সে ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এখানে ডাক্তার পাবো কোথায়! চিকিৎসা দেবো কীভাবে? উদ্বিগ্নতা বাড়তে থাকে কয়েকগুণ। আমিও বুঝতে পারি দুর্বলতার কারণ। মিতু ঘাড়ে বসে ঝিমোয়। ঝিমোতে ঝিমোতে নিচে পড়ে। সামান্য আহত হয়। কষ্টটা হৃদয়ে লাগে। বাজতে থাকে বেসুরের ভায়োলিন। কোথা থেকে আসে মোহমুগ্ধ এমন সুর! ঠিকানা নেই। নির্জন পথে মাঝে মাঝে অনেক শব্দ হয়। শব্দের উৎপত্তিও খুঁজে পাওয়া যায় না। কষ্টকে দূরে সরিয়েও কষ্ট। প্রাণের সন্ধান পেলেই কষ্টরা মিছিল দিয়ে আসে। বাড়তে থাকে দু’জনের বেদনার কাব্য। কাব্যে কাব্যে ফুলের মালা বানানো যায়। খোপায় গাঁথা হয়। দেখতে সুন্দর হলেও সবশেষে দুঃখই তার অস্তিত্বে। আসলে দুঃখের সূত্রপাত সেদিনই হয়েছে যেদিন গাছ হতে ডাল কেটে বাঁশি বানানো হয়। এমন সাংঘাতিক উপলব্ধি ছিলো রুমীর। কেন এমন উপলব্ধি ছিলো তা বসে বসে ভাবছি।

পরম মমত্বে হাতে তুলে নিই দুখের ক্যানভাস। মিতু সংকটমুহূর্তে আছে। পানি হলে বেঁচে থাকবে। এদিক-সেদিক চোখ ফেলি। আশপাশের কোথাও পানি নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মুখে থুথু ছিটিয়ে দিলাম। মিটমিট করে চোখের পাতা। প্রাণ ফিরে পায়। তাতে কিছুটা স্বস্তিবোধ করছি আমি। আবারও থুথু ছিটিয়ে দিলে মিতু এদিক-সেদিকে তাকায়। বুঝতে কষ্ট হলো না। পানির অভাবে তার দুর্বলতা প্রকট হয়। চোখ দু’টি আবারও বন্ধ হয়ে আসছে। একবার চোখ মেলে আমার দিকে তাকায়। সেই তাকানোতে ছিলো মায়ার পাহাড়। ছোট বাচ্চারা দেবতাতুল্য। তাদের নিষ্পাপ পলকে শত্রু আর শত্রু থাকে না। বন্ধু হয়ে প্রেমে জড়ায়। এখন আমার অবস্থা এমন। আবারও থুথু ছিটিয়ে দিই। মিতু নড়ছে না। অর্ধেক মৃত অর্ধেক জীবিত! সম্ভবত বাঁচার মোহ ত্যাগ করেছে, অনন্তের দিকে হাঁটছে। খুব মায়া হলো। চোখের পানি বাঁধ মানছে না আর।

মিতু নামের মানুষটি চলে যাওয়ার পর বহুদিন নিঃসঙ্গ ছিলাম। বিরহের আগুনে পুড়েছি। আর এখন অজানা-অচেনায় হাঁটছি। সেই কষ্ট দিয়ে মালা বানিয়ে অনুভবের গলায় ঝুলিয়ে রাখছি। কোথা হতে মিতু নামের বিড়ালটি এসে ভালোবাসায় টোকা দিয়ে গেলো। কিছুটা আবেগ দ্বারা আক্রান্ত হই। অজান্তেই চোখে পানি নামে। চিকচিক করা জলে সূর্যের বিকিরণ। মিতুকে গর্তে শুইয়ে রাখি। কিছুক্ষণ পাশে বসে থাকি। মায়া ও মোহকেও মাটি চাপা দিয়ে গাছের উদ্দেশ্যে আবারও রওয়ানা হলাম।

০৩

হাঁটতে থাকা মানুষের গান। বলতে থাকা মানুষের কথা। শোনার কেউ নেই নির্জনে। দেয়া-নেয়ার পৃথিবীতে। ভোগ-বিলাসের কাতরতা দেখে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মতো গম্ভীর হতে চেয়েছি। মানুষ কতো অজানারে জানার ও দেখার সাধনায় মগ্ন। পশ্চাৎ দেখার চেষ্টায় একটা জীবন অতিবাহিত করার পরও অদেখাই থাকে সব। জীবিতরা সত্তর ভাগ জল পান করেও ক্ষুধা মেটাতে পারে না। কীভাবে মিটবে তাদের ক্ষুধা। এমন ভাবনার সামনে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে দীর্ঘদেহী সাপ। ভয় পেয়ে কয়েক কদম পেছনে আসি। সাহস নিয়ে উঁকি দিই। সাপটি বেশ ক্লান্ত। আরও সামনে এগিয়ে আসি। মাথার অংশ নড়ছে না। সামান্য লেজ ছাড়া। ভয়কে তাচ্ছিল্য ঠেলে মাথার সামনে বসি। চোখের দিকে তাকাতেই দেখি, বিশ্বাসঘাতক প্রিয়তমার ছায়া! ভুলেবালে আবার সামনে! নিস্তার নেই। হতাশাগ্রস্ত অথবা হতাশাবাদীদের কাছে গেলে আশা ও স্বপ্নের সম্ভাবনা থাকে না। কেউ কি সাপের ওপর ভর দিয়ে আমার পথ প্রতিবন্ধকতা করতে চাইছে? বিভ্রান্ত সময়ে ভুল পথে পরিচালনা করাই যেনো উদ্দেশ্য।  

মৃত্যুপথযাত্রায় সাপটি বাঁচানো আমার পক্ষে অসম্ভব। উঠে দাঁড়াই। সামনের দিকে হাঁটতে থাকি। কিছুদূর হাঁটার পর বিবেকবোধ পথ আগলে ধরে। হাঁটতে চেষ্টা করি। কিন্তু পারছি না। কেউ যেনো পেছন থেকে টেনে ধরছে। বিবেক আমাকে দংশন করছে। পেছন ফিরে সাপের সামনে ফিরি। চোখ মেলে বসি। মায়ার দৃষ্টিতে মিথ্যাবাদী প্রেমিকার চোখ তাকিয়ে আছে আমার দয়ার দিকে। পানির সন্ধানে ফেরারী আমি। মরুভূমি সমান বিলে পানি পাওয়া দুষ্কর। চারপাশে পানি নেই। আলোর মাঝে ছায়া নেই। তাই মায়াঘর এখানে অচ্ছুত। মাথা উঁচু করে আমার চোখের দিকে তাকায় সে। চোখ দিয়ে আস্তে করে পানি বেরিয়ে আসে। সাপের মাথা আমার হাতের উপর। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। ইশারা ইঙ্গিতও করে না। বলতে পারছে না কোন জনমানবহীন এলাকা হতে মরু বিলে আগমন? মিতুর মতো সাপটিও অনন্তের পথে হামাগুড়ি দিচ্ছে!

ক্লান্ত শরীর ও ভাঙা কণ্ঠে জানতে চাই, তুমি বিদায় নিচ্ছ? প্রতিউত্তর না করে সে ঘুমিয়ে পড়ল! নিথর দেহ। সৎকার শেষে মন খারাপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকি। আমার বিষাদের প্রহর যেনো কাটছে না।

চার দিন হাঁটার পরও ক্লান্তির পথ ফুরলো না। মানুষের ছুটি কতো কিছু থেকেই মেলে! স্কুল থেকে ছাত্র ও শিক্ষকের। অফিস থেকে কর্মকর্তা কর্মচারীর। প্রেম থেকে প্রেমিক-প্রেমিকার। ফুলের বাগান থেকে মালির। গাছ হতে ফুল ও ফলের। অথচ জীবন থেকে জীবনের ছুটি নেই! ছুটছে তো ছুটছে। শেষ নেই। শুরু নেই। আজ এখানে কাল অন্য কোথাও। এই কয়দিন চিড়া-মুড়ি ছাড়া অন্য ধরনের নাওয়া-খাওয়া নেই। পানিও নেই। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, ক্ষুধা আমাকে স্পর্শ করছে না। শুধু ক্লান্তি। ক্লান্ত শরীর টেনে প্রতিদিন সামনে হাঁটছি।

সামনে একটি কুকুর জিহ্বা বের করে হাঁপায়। ভাবতে থাকি, আরেকটি ভয় খাম্বার মতো দাঁড়াল বুঝি। সে অনড়। আমিও। ভয় কাটিয়ে অবচেতন মনে ইশারা করি। কাছে আসে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মাথায় হাত বুলালে মমতায় কাছে আসে। জানতে চাই, সবার মতো তুমিও মরার জন্য এসেছ? কুকুরের গায়ে কুকুরের গন্ধ নেই। যে গন্ধ বাতাসে ভাসছে তা আমার পরিচিত। পরিচিত শ্যাম্পুর গন্ধ। পারফিউমের ঘ্রাণ। বিভ্রান্ত গন্ধ ও ঘ্রাণে অতীতের পৃষ্ঠা আঁকি। পারফিউমের অহংকারের কথা মনে আসে। ম্লান মুখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি, কেন আবার দোলা দিলে পুরনো কথায়? পুরনো দিন সামনে আনতে গেলে। স্কেল করা খাতা ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছি। কাঞ্চননগরের ছায়াবীথি পাড়ের সুবাসফুলের কথা, আতর চন্দনের ঘ্রাণের কথা কেন স্মরণ করালে? কথার অর্থ বুঝল কী বুঝল না, আমাকে বুঝতে না দিয়েই তিন পাকের মাথায় শুয়ে পড়ল সে। কুকুরের গায়ে হাত বুলাই। আদর পেয়ে চোখ বুজে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে জানতে চাই, তুমি কী করে এখানে এসেছ? আমাকে মুক্তি দিচ্ছ না কেন? জীবন থেকে মুক্তির জন্য সংসার বিচ্ছেদ হয়েছি। কুকুরের মুখ থেকে লালা ঝরছে! লালার সাথে একটি ডায়মন্ডের আংটি বেরিয়ে আসে। হাতে নিয়ে দেখি আমাদের বিবাহের স্মারক। মা তার পূত্রবধূকে দিয়েছিল। কুকুরটি আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। চোখ দিয়ে পানির স্রোত। স্রোতে সূর্য ঝিলিক মারে। যেনো কড়কড়ে মেজাজ টর্চ লাইটের আলো দেয়। আলো অতিক্রম করে পৃথিবীর বাইরে নিঃশ্বাসও যেতে পারছে না। দূরে যেতে পারছি না আমিও। মানুষের কাছ থেকে যতোটা দূরে যায় মানুষ। মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে যায় ততোই। কাছে আসে। যদিও সবসময় এ কথা সত্যি নয়। এগুলোই সেই প্রমাণ। আমি মায়া পর্বের মায়াপীর!

জীবন বাঁচাতে ও সাজাতে কতোবার কতো বাঁধনে আটকে গেছি, তা সুপার কম্পিউটারের ডাটায়ও আঁটবে না! সব বাঁধন ছিন্ন করে পথে ছুটছি। অতীতের ঘরে ঘুরতে গেলে পথ চলাটা হবে নিদারুণ কষ্টের। কতোবার কতো সলতে আগুন জ্বালিয়েছি, তারও ইয়ত্তা নেই। সেই আলোয় জীবনের অন্ধকার দূর না হয়ে বরং জ্বলেছি দ্বিগুণ উত্তাপে। আত্মজিজ্ঞাসায় ভুলবালে ধরা পড়েছি জালে। সময়ের সংকীর্ণতায়ও যেনো পরাধীন। সংসার হচ্ছে, সুখ ও সম্ভাবনার ঠাকুর মহাশয়ের নাম। বিচ্ছেদ ও বিরহের জননী। সেই আমি সংসার যাপন করব কীভাবে? মৃতুপথযাত্রী কুকুরীর মুখে একফোঁটা পানি দিতে না পারার ব্যর্থতাও বয়ে বেড়াই। কেন যে এমন ব্যর্থতা বয়ে বেড়াতে হয়! আংটিটা সঙ্গে নিতে ইচ্ছে করল না। কবরের পাশেই রেখে হাঁটতে থাকি।  

গাছ অনেক দূরে। এতো দূরে কেন? দূর কী কখনও সামনে আসবে না? বিভ্রমে বিভ্রান্ত আমি? মানব জীবনই বিভ্রান্ত? অকারণে বিভ্রান্ত। কারণ ছাড়াই মায়া। কারণে-অকারণে অবহেলা। ভালোবাসাবাসি। কারণে-অকারণে বেঁচে থাকার চিন্তা। সম্ভবত এটাই পৃথিবীর মানুষের অন্যতম গোপন রহস্য। রহস্যের নিষ্ঠুর জাল অভেদ্য নয়। গাছের কাছে পৌঁছতে পারছি না। না, গাছ আমার কাছে আসতে চাচ্ছে না। নাকি দূরের ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা অদৃশ্য ভবিষ্যৎ প্রতারণা করছে চোখের সাথে? বৃক্ষটি কখনও সামনে এসে জড়িয়ে ধরে অথবা তার নিচে ছায়া নেওয়ার সুযোগ করে দেবে না? সূর্য নিয়মের জ্যামিতি মেপে পশ্চিমের খুপড়ি ঘরে ঢুকে পড়ছে আর চাঁদ স্বমহিমায় তার জ্যোতি পৃথিবীর গায়ে ঢেলে তারকারাজির নৃত্য দেখছে। আমি চাঁদের আলোয় ঘুমাতে গেলাম। বিষণœ ক্লান্ত ঘুম।  

শেষ না হওয়া পথ ধরে হাঁটছি। অবসরের অবসর নেই। ঘুরে দেখি সামনে সাজানো গরুর গাড়ি। আগের আমলের বরযাত্রীর জন্য সাজানো। খুশিতে গরুর গাড়িতে চড়লাম। রাতভর গাড়ি চলে। মধ্যরাতের তর্জমা না করেই গরু দুটি ছাগলে রূপান্তর ঘটে! ভয় পেয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিই। ভয়ে বিভ্রান্ত হলেও মুক্তি নেই। বিষাদের ডালপাল জড়িয়ে। অনেক অপেক্ষার পর সামনে আসে কাঙ্ক্ষিত সেই গাছ। গাছের ডালে প্রজাতির অসংখ্য পাখি। এদের কিছু পাখি চিনতে কষ্ট হচ্ছে। গাছের অপর পাশে সাদা কাপড় জড়িয়ে কেউ একজন দাঁড়ানো। শরীরের ঘ্রাণ আমার নাকে গতদিনের কথায় ভাবায়। ভয়ে শরীর ঝিম মেরে আসে। আবার কোন নতুন আতংক! গাড়িটিও নেই। কীভাবে কোথায় উধাও হয়ে গেলো! চারপাশ সুগন্ধি আর তবলার আওয়াজ। বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি লাগছে। আপাতত সব চিন্তা বাদ দিয়ে অচেনা ঘ্রাণে বুঁদ হতে থাকলাম। কিন্তু সেই ঘ্রাণ বেশিক্ষণ স্থির থাকেনি। মাথার উপরের গাছটি বৃদ্ধ মানুষের হাড় মটকানোর মতো কড়মড় কড়মড় করে ভেঙে পড়ছে। অভাবনীয় গঠনতন্ত্রের মতো দাঁড়ায় শরীর। ভয়ে দৌড়ে সরে গেলাম।
কে? 
আমি তো তুমি! তোমার বাম পাঁজর।  
বাম পাঁজর মানে? 
তোমার প্রতিবিম্ব।
মুখের পর্দা সরালে পৃথিবীটা এলোমেলো হয়ে আসে। যে রাজা, রাজ্য, রাজধানী ও সাধারণ নিরীহ মানুষদের শাসন করে চলছে, সমুদ্রের ঢেউয়ে আগুন জ্বালিয়ে শিশুর কান্না থামাচ্ছে! সেই সুর এই মরুদ্যানে! ছুটতে থাকা মানুষের মতোই উল্টো পথে দৌড়। দৌড়ের গতিতেও ক্রমান্বয়ে নিস্তেজ ভাব! আমি উঁইপোকার মতো পৃথিবীর আগুনে আবার ঝাপিয়ে পড়ছি!

** খুচরো আলাপ | কিঙ্কর আহ্‌সান
** যেভাবে এহসানের ট্রেন বিষয়ক গল্পে ঢুকে পড়ি | এনামুল রেজা
** যেভাবে অনিকেতের মৃত্যু হয়েছিল | আবু উবায়দাহ তামিম
** আদিম | আবদুল্লাহ আল ইমরান
** টান । আকাশ মামুন
**এই সময়ের এক কুড়ি গল্প পড়ুন বাংলানিউজে

বাংলাদেশ সময়: ১০২৭ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ