তখনও তার হাতে বিশ্বকাপের শিরোপা তুলে দেওয়া হয়নি। গোল্ডেন বলের পুরস্কার নিয়েছেন কেবল।
অপলক দৃষ্টিতে মেসির তাকিয়ে থাকা ওই ছবিটা ইন্টারনেটে সবচেয়ে বেশি দেখার একটা হওয়ার কথা। ক্লিশে শোনায়, তারপরও ‘এত কাছে তবুও কত দূরে....’ কথাটার উজ্জ্বল উদাহরণই যেন হয় সেদিন।
আট বছরে কত জল বয়ে গেছে নদীতে। কোভিড এসেছে, অস্থির যুদ্ধের নাভিশ্বাসে পুড়ে ছাই হচ্ছে দুনিয়া। ক্লিন সেইভ মেসির মুখে এখন জমা হয়েছে ৩০ পেরোনোর ছাপ। আট বছরে চলে গেছেন কতজন, দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনাও তাদের একজন।
মেসির সঙ্গে কোনো কিছুতেই মিল নেই তার। কথাবার্তায়, আচরণে, খ্যাপাটেভাবে, পাগলামোতে ম্যারাডোনা অন্য উচ্চতায়। মেসি স্বল্পভাষী, নম্র-ভদ্র, শান্ত, পরিমিত। তবুও আজীবন তাদের মধ্যে চলেছে অদৃশ্য এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। মেসি কি ছুঁতে পারবেন ম্যারাডোনাকে?
সেলিয়া ওলিভেইরার নাতি, যার ফুটবলটা শুরু হয়েছিল দাদির অনুরোধে। গ্রান্দোলির কোচ সালভাদোরের দলে একজন ফুটবলার কম ছিল। সেলিয়া আবদার করলেন পাঁচ বছরের মেসিকে নিতে। বয়স এতই কম সালভাদোর কিছুতেই নেবেন না। সেলিয়ার অনুনয়ে সেই যে নিলেন...এরপর হয়তো গ্রান্দোলির কোচ নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে দেন প্রতিদিন। আর মেসি তো স্মরণ করেন প্রতি গোলের পরই।
ছেলেটার ফুটবল শেষ হয়ে যেতে পারতো এরপরও। বাকিদের মতো গড়নে বেড়ে উঠছিলেন না, বাবার কাছে ছিল না যথেষ্ট টাকাও। ঈশ্বর লিখে রেখেছিলেন তার স্ক্রিপ্ট, কোনো সুদূরের ক্লাব বার্সেলোনা নয়তো কেন আসবে সাহায্যে!
এরপরও কি কম পথ, বঞ্চনা, হতাশা আর লড়াই সঙ্গী হয়েছে তার। ওইটুকু বয়সে বাড়ি ছেড়ে আসার মানসিক অবসাদ পেয়ে বসতে পারতো চাইলে, পায়নি। ভিনদেশি মানুষ, খাদ্যভাস, পরিবেশ...কতকিছুর সঙ্গেই তো মানিয়ে না নিতে পারতেন।
অথবা স্বদেশেই যখন তাকে বলা হয়েছে, ‘তুমি আমাদের নও...’। অন্তত যখন বলে দিয়েছিলেন, ‘আমাকে দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল আর হচ্ছে না...’ এরপর যদি আর না ফিরতেন? তেমন হলে আর তিনি লিওনেল মেসি কী করে হতেন!
জীবনজুড়ে কী করেননি! চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগা, লিগ ওয়ান; সাতটা ব্যালন ডি’অর, অনেক অনেক ব্যক্তিগত পুরস্কার। সবকিছুকেই মেসি তুচ্ছ করেছিলেন একটা বিশ্বকাপের আশায়।
লুসাইলে যখন তিনি গোল্ডেন বল হাতে নিয়ে ছবি তুলতে যাচ্ছেন, তখন এঁকে দিয়েছিলেন চুমুও! কারো কি ‘১৪ এর সময়টার কথা মনে পড়েনি?
অনেকের চোখে শিরোপায় ওই স্পর্শে লিওনেল আন্দ্রেস মেসি ধরে ফেলেছেন ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনাকেও। মেসির যাত্রা শুরু হয়েছিল লাল কার্ডে, তখন তাকে আগলে রেখেছিলেন একজন। তিনি থেকেছেন ‘আল্টিমেট গ্লোরির’ সময়টাতেও। কে? লিওনেল স্কালোনি। ১৭ বছর, ১৭২ ম্যাচ, ৯৮ গোল, এক বিশ্বকাপ পর...শুরুতে সতীর্থ, পরে কোচ হিসেবে।
ভদ্রলোক বিশ্বকাপ জেতার পরও ডাগআউটে বসেছিলেন। কী করবেন বুঝছিলেন না, কেউ কেউ জড়িয়ে ধরছিলেন মাঝেমধ্যে, হু হু করে কান্না করেছিলেন অনেকক্ষণ বাদে। লিওনেল স্কালোনি কি না জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে গিয়েছিলেন পানি খেতেও। তিনি এতই সাধারণ, অথচ অনন্য।
আরেক লিওনেল জীবনে বহুবার হোঁচট খেয়েছেন। তিনবার এগিয়ে তাকে থমকে যেতে হয়েছে লুসাইলের ফাইনালেও। এরপর যখন টাইব্রেকার এলো, গোল করলেন। মন্তিয়েল বল জালে জড়িয়ে জার্সিটা খুলে ফেললেন, টিভিতে তখন পিটার ড্রুরি বললেন, ‘আর্জেন্টিনা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, আবারও, অবশেষে...’
মেসি তখন শক্তি হারিয়ে ফেললেন সব, মাঠেই বসে পড়লেন। সতীর্থদের কেউ কেউ এসে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। এমিলিয়ানো মার্তিনেস কাঁদলেন, দি মারিয়াও। আরও কত মানুষের পৃথিবীর নানা প্রান্তে চোখে জল এসেছিল, সংখ্যাটা জানা যায়নি এখন। কখনও কি যাবে? তাদের মেসি ধন্যবাদ জানালেন কি না কে জানে!
একটু বাদে লুসাইলের মাঝমাঠে স্টেজ বসলো। কাতারের রাজা পরিয়ে দিলেন ঐতিহ্যের পোশাক। মেসি হাসলেন। একটু একটু করে এগিয়ে গেলেন ট্রফিটা নিয়ে। তাড়াহুড়ো নেই এটুকুও। লিওনেল এরপর ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরলেন সতীর্থদের চারপাশে রেখে। আরব ঐতিহ্যের পোশাক তাকে বানালো জাদুকরও।
মেসি এরপর বাচ্চার মতো দুলালেন বিশ্বকাপ ট্রফিকে। ক্যারিয়ারের সূর্যাস্তের আগে তিনি খুঁজে পেলেন সবচেয়ে উজ্জ্বল আলো। মেসি এমন কিছু বললেন এরপর, যেন কোথাও-কখনো দেখেননি তেমন কিছু। ‘বিশ্বকাপটাকে দেখুন, কী যে সুন্দর...’ বলেন রোজারিওর ছেলে। জানান, ‘এটা আসলে পাগলামি...’। মেসি কি জানেন, এই পাগলামো ব্যাপারটা তাকে এনে দিয়েছে অমরত্বও?
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০২২
এমএইচবি