বিভিন্ন মানবিক সমস্যা থাকলেও তখন যুদ্ধ ছিল না। প্লে-মেকার হিসেবে মোটামুটি সুনাম কুড়িয়ে ফেলেছিলেন ২৩ বছর বয়সী আহমেদ হাসান।
কিন্তু গাজার আরও অনেক ফিলিস্তিনির মতোই ইসরায়েলি বিমান হামলায় হাসানের বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। যে কারণে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। কিন্তু সেখানেও শান্তি নেই। ইসরায়েল হামলার ক্ষেত্রে কোনো শরণার্থী শিবিরকেও বাদ দিচ্ছে না। ফলে প্রাণ বাঁচাতে এক শিবির থেকে আরেক শিবিরে দৌড়াতে হচ্ছে তাকে। শুধু জুনেই তিনবার শিবির বদলেছেন তিনি। চোখের সামনে সব শেষ হয়ে যেতে দেখেছেন; পেরিয়ে এসেছেন রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাজারো মরদেহ।
বর্তমানে গাজার কেন্দ্রে অবস্থিত আজ-জাওয়াইদা শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছেন হাসান। সেখানেই প্রীতি ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করেছেন তিনি। 'সুন্দর দিনগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করতে'- এমন স্লোগানে এই ম্যাচ যখন আয়োজিত হয়, কাছে কোথাও তখন ইসরায়েলের নারকীয় হামলায় কারো না কারো মৃত্যু হচ্ছে, বাড়িঘর ধ্বংস হচ্ছে।
যুদ্ধের কারণে হাসানের বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্বই নেই আর। একটা শিক্ষাবছর তার জীবন থেকে নাই হয়ে গেছে। চারদিকে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ভুলে থাকতে হাসানের মতো ফিলিস্তিনে অনেক তরুণ এখন ফুটবল খেলায় মনোযোগ দিচ্ছেন। যদিও সেই মাঠেই তাদের সলিল সমাধি হয়ে যেতে পারে। একটি স্কুলের মাঠে খেলার আয়োজন করেন হাসানরা। যুদ্ধের বিভীষিকার শিকার হওয়া এক ঝাঁক তরুণ নিজেরা দুই দলে ভাগ হয়ে নামেন খেলার মাঠে। দুই দলে থাকে পাঁচ জন করে খেলোয়াড়। বাড়তি খেলোয়াড়দের কেউ আবার রেফারির ভূমিকা থাকেন।
হাসান যখন বল নিয়ে প্রতিপক্ষের পোস্টের দিকে এগিয়ে যান, মাঠের চারদিকে ঘিরে দাঁড়ানো দর্শকদের ভেতরে থাকা তার ছোট ভাই মোহাম্মদ (ডাক নাম তোতা) তখন বড় ভাইয়ের জন্য সজোরে গলা ফাটায়।
হাসানদের ফুটবল ম্যাচে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের মধ্যে স্থানীয়রা আছে, আছে শরণার্থীরাও। সবাই মিলেমিশেই খেলে। তাদের মধ্যে দুজন আবার হাসানের শৈশবের বন্ধু। তাদের একজন মোহাম্মদ সাবরা, ২৪ বছর বয়সী মিডফিল্ডার যিনি গাজার ঐতিহাসিক আল-জায়তুন স্পোর্টস ক্লাবের হয়ে খেলেন; আর দ্বিতীয়জন ২৫ বছর বয়সী মাহমুদ কাহলুত, যিনি প্যালেস্টাইন স্পোর্টিং ক্লাবের রাইট-ব্যাক। দুরন্ত গতির জন্য পরিচিত কাহলুত এবং সাবরার পরিচিতি চাপের মুখে শান্ত থেকে আক্রমণ গোছানোর জন্য। হাসানের দাবি, তারা তিনজন মিলে আজ পর্যন্ত কোনো ম্যাচ হারেননি।
হাসান মাঠের খেলা ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বেশ সক্রিয়। নিজেদের খেলার ভিডিও প্রায়ই পোস্ট করেন তিনি। এর একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কৃত্রিম টার্ফে তার এক সতীর্থ লাথি মারার সময়, কাছেই কোথাও পুরু ধূসর ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। হাসানকে ওই ভিডিওতে বলতে শোনা যায়, 'দুই দিন আগে, আমরা যখন আজ-জাওয়াইদায় ফুটবল খেলছিলাম, কাছেই কোথাও ভারী বোমাবর্ষণ হয়েছে। এটা খুবই ভীতিকর ছিল, কিন্তু আমরা খেলা চালিয়ে গেছি। ইনশাল্লাহ, এই যুদ্ধ থামবে এবং এসব দৃশ্য জীবনে আর কোনোদিন দেখতে হবে না। '
৭ অক্টোবর (ইসরায়েলে হামাসের হামলার ঘটনা) থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত, ফিলিস্তিনি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (পিএফএ) এর হিসাবে এখন পর্যন্ত নিহত ৪১০ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে ২৯৭ জন পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়। তাদের মধ্যে ৮৪ জনই শিশু, যারা স্থানীয় ক্লাবগুলোর বয়সভিত্তিক দলে খেলতো।
গত ১০ মাসে হানি আল মাসদার এবং মুহাম্মদ বারাকাতের মতো গাজার বিশিষ্ট ফুটবলার নিহত হয়েছেন। মাসদার একসময় জাতীয় দলের খেলোয়াড় ছিলেন। অবসর নেওয়ার পর তরুণ ফুটবলারদের পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন। ১১৪ গোলের মালিক বারাকাত ছিলেন ফিলিস্তিনের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার। এরপর একের পর এক হত্যা চলতেই থাকে। গত ৭ মে, রাফায় খাদামাত রাফাহ ক্লাবের গোলরক্ষক মাহমুদ ওসামা আল-জাজ্জার নিহত হন। তার ক্লাব তার কিছুদিন আগেই গাজা প্রিমিয়ার লিগের চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় গাজায় প্রাণহানি তো ঘটছেই, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ক্রীড়া অবকাঠামোগুলোও। কমপক্ষে ৫৪টি ক্রীড়া অবকাঠামো হয় ধ্বংস হয়ে গেছে, অথবা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার মধ্যে আছে বেইত হানুন মিউনিসিপাল স্টেডিয়াম, গাজা স্পোর্টস ক্লাব এবং আল মিলা স্পোর্টিং ক্লাব স্টেডিয়াম। ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ইয়ারমুক স্টেডিয়াম এখন হাজারো শরণার্থীর আশ্রয়স্থল।
এতসব প্রতিকূলতার মধ্যে হাসান ও আল-জাওয়াইদায় থাকা তার সতীর্থদের কাছে ফুটবল শুধুই খেলা নয়, একধরনের প্রতিরোধও। কেড়ে নেওয়া খুশিকে দুনিয়ার কাছ থেকে জোর করে আদায় করা যেন। যদিও এজন্য চরম মূল্য চোকাতে হচ্ছে তাদের।
ফিলিস্তিনিদের স্বপ্ন চুরি করছে ইসরায়েল
ফিলিস্তিনের সাবেক ফুটবলার ও বর্তমান ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার খলিল জাদাল্লাহ ফুটবলের প্রেমে পড়েছিলেন শৈশবেই। আরব টুর্নামেন্টের নবম আসরে তার দেশ ফিলিস্তিনের জাতীয় দল অংশগ্রহণ করেছিল। ফুটবল মাঠে ফিলিস্তিনের জাতীয় পতাকা উড়তে দেখে নয় বছরের জাদাল্লাহর বুক গর্বে ফুলে উঠেছিল। ধারাভাষ্যকার যখন চিৎকার করে বলে উঠেন, 'ফিলিস্তিনের গোল'; তখন থেকেই তার মনে গেঁথে যায় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন।
ফুটবল নিয়ে ফিলিস্তিনিদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে জাদাল্লাহ বলেন, 'ফিলিস্তিনিদের জীবন ফুটবল সংগ্রামের আরেক নাম। ফিলিস্তিনিরা ফুটবল খেলে যুদ্ধবিমানের গর্জনের নিচে, খেলা না থামিয়েই। '
ফিলিস্তিনে সবমিলিয়ে ২২০টি ফুটবল ক্লাব আছে। এর মধ্যে ৭০টির মতো আছে গাজায়। আগে গাজা থেকে অনেকেই ফিলিস্তিনের জাতীয় দলে ডাক পেতেন। কিন্তু জাদাল্লাহ জানান, গাজার যুদ্ধ আর সীমান্তে প্রতিবন্ধকতা থাকায় এখন পশ্চিম তীর থেকেই খেলোয়াড়দের নিয়েই দল সাজানো হয়। তারপরও এখন গাজা থেকে তিন খেলোয়াড় আছেন জাতীয় দলে- মাহমুদ ওয়াদি, মুহাম্মদ সালেহ এবং ইয়াসের হামাদ।
২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকে ৮ জন ফিলিস্তিনি অ্যাথলেট অংশ নিয়েছিলেন। যা দেখে জাদাল্লাহ খুব খুশি। কিন্তু তার আক্ষেপ, ফিলিস্তিনের নারী কারাতে চ্যাম্পিয়ন নাঘাম আবু সামরা তাতে অংশ নিতে পারেননি। কারণ ইসরায়েলি বিমান হামলায় তার ডান পা খুইয়েছেন। আরেকজন ভারোত্তোলক মুহাম্মাদ হামাদা, যিনি যুদ্ধের কারণে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। না খেতে পেয়ে তার ওজন কমে গেছে এবং ইসরায়েলের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি দেশ ছাড়তেও পারছেন না।
ইসরায়েল অবশ্য দীর্ঘদিন ধরেই ফিলিস্তিনিদের অ্যাথলেট হওয়ার পথ রুদ্ধ করে রেখেছে। ২০০৮ সালে তিন সপ্তাহের যে যুদ্ধ হয়েছিল, তখন ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ১১ জন ফিলিস্তিনি অ্যাথলেটের মৃত্যু হয় এবং ১৫টি ক্রীড়া অবকাঠামো ধ্বংস করা হয়। ২০১২ সালে ইয়ারমুক ও ফিলিস্তিনি স্টেডিয়ামকে যুদ্ধবিমানের হামলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালের হামলায় নিহত হন ১৬ জন ফিলিস্তিনি অ্যাথলেট। সেবার ২০টির বেশি ক্রীড়া অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ফুটবল যেভাবে ফিলিস্তিনিদের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছে
২০১৫ সালে, প্রথমবারের মতো ফিলিস্তিনের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল শীর্ষ কোনো ক্রীড়া আসরে: অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে এশিয়ান নেশনস চ্যাম্পিয়নশিপে। যদিও অস্ট্রেলিয়া ফিলিস্তিনকে দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু তারপরও মাঠে জাতীয় পতাকা উড়তে দেখে এবং ক্রীড়াবিদদের মুখে জাতীয় সঙ্গীত শুনে অনেক ফিলিস্তিনি আনন্দাশ্রু ফেলেছেন। অনেক ফিলিস্তিনি এই ঘটনায় উৎসাহিত হয়েছেন।
হাসান, সাবরা এবং কাহলুতের জন্য ওই মুহূর্ত ছিল স্বপ্ন দেখার শুরু। পরে তারা ফিলিস্তিন জাতীয় দলে ডাক পান। এমনকি তারা স্বপ্ন দেখতেন ইউরোপের কোনো শীর্ষ ক্লাব থেকে ডাক পাওয়ার। যুদ্ধ শুরুর আগে তারা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং স্প্যানিশ লা লিগার খেলার দেখতে নিয়মিত ক্যাফেতে হাজির হতেন। ফিলিস্তিনের অনেকের মতোই তারা রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার সমর্থন। তবে স্প্যানিশ ক্লাবগুলোর বাইরে কাহলুতের পছন্দ স্কটিশ ক্লাব সেল্টিক। কারণ স্কটল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাবটি ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে।
গাজার মতো যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অঞ্চলে, ফুটবল আসলে বিলাসিতার নামান্তর। যেখানে যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধবিমান হানা দিতে পারে। মুহূর্তে ধ্বংস করে দিতে বাড়িঘর, খেলার মাঠ সবকিছু। কিন্তু ফুটবল খেলা তাদের জন্য একটা মেটাফোর (রুপক অর্থে) বলা যায়। এর মাধ্যমে তারা বিশ্বকে বার্তা দিতে চায় যে, ইসরায়েল যতোই তাদের ধ্বংস করার চেষ্টা করুক না কেন, তারা ঠিকই ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়াবে।
লেখিকা: সামা ফারুকি, টিআরটি ওয়ার্ল্ড
অনুবাদক: মোয়াজ্জেম হোসেন, স্পোর্টস ইনচার্জ (বাংলানিউজ)
বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০২৪
এমএইচএম