ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ফুটবল

কী ঘটেছে আফগানিস্তানের খুদে মেসির ভাগ্যে?

মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০২১
কী ঘটেছে আফগানিস্তানের খুদে মেসির ভাগ্যে?

লিওনেল মেসির নাম লেখা পলিথিনের 'জার্সি' পরিহিত ছোট্ট আফগান বালকের কথা মনে আছে? সেই যে ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয় কেড়ে নেওয়া যে শিশুটি মাত্র ৫ বছর বয়সেই হয়ে উঠেছিল ইন্টারনেটের হার্টথ্রুব। খোদ মেসির কাছ থেকেই যে উপহার পেয়েছিল এবং একসময় যে সাক্ষাৎ পেয়ে গিয়েছিল খুদে জাদুকরের।

এমনকি যার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘খুদে মেসি’।

আফগান সেই শিশুটির নাম মুর্তজা আহমাদি। পলিথিন দিয়ে আকাশি-সাদা ডোরাকাটা আর্জেন্টিনার জার্সি বানিয়ে তাতে মেসির নাম ও জার্সি নম্বর (১০) লিখে ফুটবল খেলে বেড়ানো সেই আহমাদি চোখে পড়েছিল স্বয়ং মেসির। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার তার জন্য এমনকি উপহারও পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ওই ঘটনার পর শিশুটির জীবন ‘দুর্বিষহ’ হয়ে উঠেছিল।

মুর্তজার স্বপ্ন ছোঁয়ার গল্প

মুর্তজার বড় ভাই শখের বসেই ছোট ভাইয়ের ফুটবল খেলার ছবি ফেসবুকে আপলোড করেছিলেন। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তিনি তের পাননি ছোট্ট শিশুটির জীবন তাতে কতটা বদলে যেতে পারে। পলিথিনের তৈরি মেসির নাম ও জার্সি নম্বর লেখা টি-শার্ট পরে তোলা ওই ছবি ইন্টারনেটে ঝড় তুলেছিল। রাতারাতি তারকা বনে গিয়েছিল ছোট্ট মুর্তজা। তাকে বলা হতো ‘খুদে মেসি’।

ছবিটি এতটাই ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল যে, আর্জেন্টিনা ও সে সময়ের বার্সেলোনা তারকা মেসি ইউনিসেফের সঙ্গে যোগাযোগ করে উপহার পাঠিয়েছিলেন। নিজের আইডল মেসির কাছ থেকে আর্জেন্টিনার জার্সি ও ফুটবল উপহার পায় সে। দুটিই মেসি স্বাক্ষরিত। ৫ বছরের মুর্তজা তখন যেন রীতিমত স্বপ্নের জগতে বাস করছিল। কিন্তু ঘটনার এখানেই শেষ নয়।

‘ব্লিচার রিপোর্ট’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুর্তজা বলেছিল, ‘আমি মেসির কাছে যেতে চাই। আমি মেসির সঙ্গে দেখা করতে চাই। ’ এরপর গজনী রাজ্যের দক্ষিণের জেলা জগুরির ছোট্ট গ্রামের শিশুটির জীবনে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। তার স্বপ্নও সত্যি হয়।  

২০১৬ সালের শেষদিকে, কাতারে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলতে যায় বার্সেলোনা। সেখানেই মুর্তজাকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ম্যাচের মাসকটের ভূমিকায় থাকা শিশু মুর্তজা স্টেডিয়ামের টানেলেই মেসির দেখা পেয়ে যায়। এরপর সে স্বপ্নের খেলোয়াড়ের হাত এত শক্ত করে ধরে রাখে যে, ম্যাচ শুরুর আগে খোদ মেসিকেই বুঝিয়েশুনিয়ে তাকে গ্যালারিতে থাকা তার বাবার কাছে পাঠাতে হয়।  

সমস্যার শুরু যেখানে

মুর্তজা অনেক স্বপ্ন নিয়েই মেসির কাছে গিয়েছিল। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে বেশি সময় লাগেনি। মেসির কাছ থেকে উপহার পাওয়ার পর থেকেই তার জীবন ওলটপালট হয়ে যায়। তার নিজ দেশের অনেকে ভাবতে শুরু করে, সে ও তার পরিবার নিশ্চয় মেসির কাছ থেকে অনেক অর্থ সহায়তা পেয়েছে। এমনকি মুর্তজার পরিবারের সবাইকে অপহরণের হুমকি দেয় তালেবান।  

তালেবানের হুমকিতে মুর্তজার পরিবারের সদস্যদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। ‘ব্লিচার রিপোর্ট’-কে মুর্তজার মা শফিকা আহমাদি বলেন, ‘তালিবান আমাদের এলাকায় আসার খবর পেয়ে আমরা রাত ৮টার (স্থানীয় সময়) দিকে জগুরি থেকে পালিয়ে যাই। আমরা ভীত হয়ে পড়েছিলাম। আমরা নিশ্চিত ছিলাম তালিবান মুর্তজার ব্যাপারে জানতে চাইবে। কারণ তালিবান আগেই একবার বলেছিল, আমার ছেলে মেসির জার্সির সঙ্গে ছবি না তুলে পবিত্র কোরআনের সঙ্গে ছবি তোলেনি কেন। ’

দীর্ঘ সময় পর ফের আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করা তালেবান আগেই মুর্তজার তুমুল জনপ্রিয়তাকে অপছন্দ করতো। এমনকি তাদের হুমকির কারণে মুর্তজাকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হয়। এমনকি ঘরের বাইরে খেলতে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় ‘সকার স্টোরিজ’-কে মুর্তজা বলেছিল, ‘আমি আমার স্কুলকে অনেক মিস করি, আমি যেতে চাইলেও সেখানে যেতে পারি না। আমার শুধু মনে হতো, কেউ আমার পিছু নিচ্ছে। ’

তবে সমস্যাটা সবচেয়ে ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন মুর্তজার বাবা। ‘ব্লিচার রিপোর্ট’-কে তার বাবা মোহাম্মদ আহমাদি বলেছিলেন, ‘আমি যখন (মেসির দেওয়া উপহারের) বাক্সগুলো দেখলাম, আমি ভেবেছিলাম একটিতে হয়তো মুর্তজার জন্য খেলনা এবং অপরটিতে ডলার রয়েছে। কিন্তু তাতে ছিল জার্সি এবং বল। ’

আফগানিস্তানের অর্থনীতির অন্যতম খুঁটি হচ্ছে বিদেশি অনুদান। বিদেশি কারো সঙ্গে সম্পর্ক বা পরিচিতি মানেই, মনে করা হয় তারা নিশ্চয় আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। কিন্তু মুর্তজার ব্যাপারটা পুরোটাই আলাদা। সে মেসির কাছ থেকে কোনও আর্থিক সহায়তা পায়নি। কিন্তু তালেবান তা কিছুতেই মানতে রাজি ছিল না। ধারাবাহিক হুমকির চাপে এমনকি তার পরিবারকে পাকিস্তানে গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হয়।  

মুর্তজার বাবার দেওয়া তথ্যমতে, পাকিস্তানে অবস্থিত স্প্যানিশ দূতাবাস তাদের ভিসা দিতে চেয়েছিল। এমনকি তারা সরাসরি বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারেও চেষ্টা চালিয়েছিল। কাতালান জায়ান্টদের পক্ষ থেকে ৪-৫ দিন পর উত্তর দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয় এবং তাদের নিজ গ্রামে ফিরে যেতে হয়।

মুর্তজার ভাগ্যে কি ঘটেছে?

বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সাক্ষাতের পর মেসির কাছে মুর্তজা আবদার করেছিল, যেন বিশ্বসেরা ফরোয়ার্ড তাকে নিজের সঙ্গে করে নিয়ে যান। কিন্তু দুজনের ভাষাগত ব্যবধানের কারণে হয়তো মেসি তা বুঝতে পারেননি। তবে মুর্তজার বাবা মেসির কাছ থেকে আরও বেশি প্রত্যাশা করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম দোহায় গিয়ে মেসির সঙ্গে দেখা হলে, তিনি নিশ্চয় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো কিছু করবেন। আমরা দোহায় গিয়েছিলাম এটা ভেবে যে মেসি আমার ছেলের জন্য কিছু করবেন, কিন্তু তিনি মুর্তজার জন্য কিছুই করেননি। ’

মুর্তজার বাবা ভেবেছিলেন, সিরিয়ান শরণার্থী শিশুর প্রতি রোনালদো যে দয়া দেখিয়েছিলেন, মেসিও হয়তো সেভাবে তার ছেলেকে অনেক অর্থ অনুদান দিয়ে কোথাও আশ্রয় পাইয়ে দেবেন। কিন্তু তা হয়নি। এতকিছুর মাঝে ছোট্ট মুর্তজার জীবনে কিন্তু অন্ধকার নেমে আসে। জীবন সংশয়ের কথা চিন্তা করে কাবুলে তার এক চাচার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু এখন আফগানিস্তানের রাজধানীও তো তালেবানের দখলে। তাহলে ‘খুদে মেসির’ ভাগ্যে কি ঘটেছে? এখন পর্যন্ত এর কোনো জবাব নেই।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০২১
এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।