এনভার্স, প্যারিস থেকে: মেট্রো থেকে নেমে ডানে মোড় নিয়েই মনে হলো, সিলেটের হযরত শাহজালালের মাজারের সামনেই বুঝি আছি। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি স্যুভেনিরের দোকান।
রাস্তায় জুয়ার বোর্ড নিয়ে তুর্কি যুবকেরা তিন বাটি এক বলের খেলা দেখাচ্ছেন। হাতের কারসাজিতে বলটি কোনো এক বাটির মধ্যে চালান দিয়ে জানতে চাইছেন, কোনটার মধ্যে বল আছে!
১০, ৫০, ১০০ ইউরো বাজি ধরে কেউ কেউ বাটি উল্টিয়ে হয়তো ডাবল জিতছেন, নয়তো বা ফকির হচ্ছেন। যখন এ খেলা মন দিয়ে দেখছিলাম, তখন কেউ একজন পিঠে হাত রাখলেন। ফিরে তাকাতেই জানতে চাইলেন, কেমন আছি!
এভাবেই পরিচয় দোহারের জাকিরের সঙ্গে। ছয়মাস হলো প্যারিসে এসেছেন। হাতে একগাদা সেলফি স্ট্যান্ড। এনভার্সের বিখ্যাত ওভ্যের (এনভার্স) মৌমার্ত গির্জায় আসা পর্যটকদের কাছে ফেরি করে সেলফি স্ট্যান্ড বিক্রি করেন তিনি।
কেবল জাকিরই নন, এমন বাংলাদেশি হকারের সংখ্যা এখানে অসংখ্য। প্রায় সবার বাড়ি হয় সিলেট বিভাগে নয়তো ঢাকা জেলার দোহার।
জাকির জানান, তুর্কি এই তরুণরা জুয়ার প্রলোভনে ফকির বানান পর্যটকদের। যারা টাকা জিতছেন, সেসব তরুণ-তরুণীরা ওদের দালাল। পুলিশ এলেই বোর্ড-বাটি সব চালান হয়ে যায় কোটের মধ্যে।
এবার হাঁটতে হাঁটতে গল্প জাকিরের সঙ্গে। পাহাড়ের ওপর গির্জার দিকে যাই তার সঙ্গে।
জাকির জানান, ভাগ্যান্বেষণে প্রথমে লিবিয়ায় গিয়েছিলেন। পরে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ত্রিপোলির অবস্থা যখন খারাপের দিকে যেতে থাকে, তখন দোহারের ইউরোপ প্রবাসী প্রতিবেশিদের মাধ্যমে খোঁজ পান ফ্রান্সে আসার দালালের। দেশ থেকে টাকা এনে দালালের হাতে তুলে দিয়ে ইতালি হয়ে চলে আসেন ফরাসিদের দেশে।
তবে সেই আসাও সহজ ছিল না। পাকিস্তানি দালালেরা প্রথমে লিবিয়ার উপকূলে নিয়ে ঘরে বন্দি করে রেখেছিলেন। পরে সুযোগ বুঝে তুলে দেওয়া হয় ট্রলারে। ট্রলার থেকে ইতালিতে নামিয়ে আবার লুকিয়ে রাখা হয় তাদেরকে। এরপর মালগাড়িতে করে আনা হয় প্যারিসে। এ যাত্রাপথে সময় লেগেছে তিন মাস। এই সময়টাতে খেয়ে না খেয়ে হাঁটতে হয়েছে শত শত মাইল। নির্ঘুম থাকতে হয়েছে রাতের পর রাত।
জাকির জানান, এখানে পৌছানোর পর শুরু হয় আসল লড়াই। লিবিয়া থেকে প্যারিস পৌছাতেই ডাংকি (দালালি) দিতে হয়েছে বাংলাদেশি অর্থে সাত লাখ টাকা। এখন সে টাকা ওঠাতে কাজের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, প্যারিসে সাধারণত অবৈধ অভিবাসীদের কাজের সুযোগ খুব কম। কখনো কখনো কোনো কোনো মালিক হয়তো দয়াপরবশ হয়ে কাজ দেন, কিন্তু তার হার খুবই কম। কেবল ভাগ্যবানেরাই সে কাজ পান।
তিনি জানান, এখানে ভাষাটাই কাজ পাওয়ার মূল সমস্যা। এরা ইংরেজি খুব বোঝেন না। আর বাংলাদেশ থেকে আসা প্রবাসীরা শুরুতে মোটেও ফ্রেঞ্চ বোঝেন না। তাই তাদের হকারি করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
প্যারিসে এসেই এখানে থাকার আবেদন (অ্যাসাইলাম) করেন জাকির। দুইবার তার আবেদন বাতিল হয়ে গেছে। এবার আপিল করতে হবে। আপিল গ্রহণ না হলে সারা জীবন অবৈধই থেকে যেতে হবে। ফেরা হবে না প্রিয় মাতৃভূমিতে।
আবার আবেদন গ্রহণ করা হলেও যাওয়া যাবে না দেশে। আবেগ আপ্লুত জাকির বলেন, ‘দেশে কোনো কাজ না থাকায় বিদেশে এসে দেশকে ছোট করেছি। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো না বলে এখানে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় চেয়েছি। আবেদন গ্রহণ হলে ট্রাভেল পাস পাবো। তাতে লেখা থাকবে, ‘উইদাউট বাংলাদেশ’।
তিনি বলেন, ‘দেশকে ছোট করেছি ঠিকই, কষ্টের উপার্জনের টাকা কিন্তু আমরা সবাই দেশেই পাঠাই। এখানে শরণার্থী জীবন কাটাচ্ছি। হকারি করছি, সবই করছি সময়ের প্রয়োজনে। দেশের প্রয়োজনে। মন তো পড়ে থাকে বাংলাদেশের দোহারে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৫
আরএম/এএসআর
** বাস্তিল ঘিরে পর্যটন
** প্যারিসের গণতন্ত্র ময়দান
** বাতাক্লঁয়ে প্রতিদিনই আসছে মানুষ