এনভার্স (এ্যাভোর), প্যারিস, ফ্রান্স: মহান স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী সালভাদর দালির প্যারিসের আড্ডার স্থান ছিল এনভার্সের মৌমার্ত গির্জার পেছনে। এখানেই তিনি আড্ডা জমাতেন সমকালীন ফরাসী ও প্যারিসবাসী চিত্রশিল্পীদের সাথে।
ফরাসীরা ভোলেননি পরাবাস্তব শিল্পের এই জনককে। তার আড্ডাস্থলকে তারা নাম দিয়েছে ‘প্যালেস ডি সালভাদর দালি’। এখানেই প্রতি বছরের একটি সময়ে নিয়ম করে জড়ো হন পৃথিবীর সব কোনার দালি প্রেমিক চিত্রশিল্পীরা।
তবে সারা বছরই প্যারিসে আসা শিল্পপ্রেমীরা দালিকে স্মরণ করতে ছুটে আসেন প্যালেস ডি সালভাদর দালিতে।
এখানে পর্যটকদের জন্য দালি প্রেমিক চিত্রশিল্পীরা অপেক্ষা করেন সারা বছরই। পর্যটকদের ছবি এঁকেই জীবিক নির্বাহ করেন তারা। কেবল পর্যটকদের পোট্রেটই নয়, তারা আকেঁন নানা মাধ্যমে নানা শিল্পকর্ম ও প্যারিসের নানা স্থানের ছবি।
কেউ বসে থাকেন নির্দিষ্ট স্থানে, আবার কেউ হেঁটে হেঁটেই যান পর্যটকদের কাছে। ৫০ ইউরোর মধ্যেই আকেঁন পোট্রেট। তবে ডিল ভালো হলে ইউরোর পরিমানও কমে।
প্যালেস ডি সালভাদর দালিতে আছে নানা শিল্পকর্মের স্টুডিও, শিল্প কর্মের দোকান, আর্ট গ্যালারি ও কফিশপ।
সালভাদর দালি
পরাবাস্তবতার একাধিপত্য শাসনকারী ছিলেন সালভাদার দালি। ‘পারসিসটেন্স অফ মেমোর’ ছবির মাধ্যমে চিত্রকলার জগতে তিনি সাড়া ফেলেছিলেন। স্প্যানিশ এই পরাবাস্তব চিত্রকরের এই ছবি প্রথম প্রদর্শিত হয় ১৯৩২ সালে নিউইয়র্ক এর জুলিয়েন লেভি গ্যালারিতে। ১৯৩৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এটি নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টে সংরক্ষিত আছে।
অনেকের মতে আলবার্ট আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সালভাদর দালি। ছবির গলিত ঘড়িটি সময়ের প্রবাহের প্রতীক। তবে দালির মতে, ছবিটি হল, একজন ঘুমন্ত মানুষের স্বপ্নে সময়ের আবর্তন সম্পর্কিত। পরাবাস্তবতার দিক থেকে এটিকে অনেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন।
সালভাদর দালি যেন তার অসম্ভব দম্ভ নিয়ে শাসন করেছেন সময়কে। সর্বময় শিল্পের অধিকারী এই শিল্পী সারা জীবন ধরে নানা স্বাদের সৃষ্টিতে মেতে ছিলেন।
১৯৪২ সালে নিউইয়র্কের দালি প্রেস থেকে প্রকাশ করলেন বিতর্কিত আত্মজীবনী ‘ দি সিক্রেট লাইফ অব সালভাদর দালি। লুই বুনুয়েলের সঙ্গে কাজ করে দালি অর্জন করেছিলেন ফিল্ম তৈরির অভিজ্ঞতা।
১৯৪৫-এ আলফ্রেড হিচককের স্পেলবাউন্ড ছবির বিখ্যাত স্বপ্নদৃশ্যের সেট নির্মাণ করে দিলেন সালভাদর দালি। নিজের চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লিখেছেন, কস্টিউম ডিজাইন, সেট ডিজাইন করেছেন।
১৯৪৬ সালে আমেরিকায় ওয়াল্ট ডিজনির সঙ্গে এনিমেশন ফিল্মের জন্য কাজ করেন। মঞ্চের জন্যেও বহু কাজ করেছেন দালি। ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা নাট্য-ব্যক্তিত্ব ও পরিচালক পিটার ব্রুকের মতো গুণীজনের সঙ্গেও কাজ করেছেন তিনি।
প্রচণ্ড শিল্পের ক্ষুধা নিয়ে জন্মেছিলেন দালি। তৃপ্তি খুঁজে পেতেন না কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ রেখে। দশহাতে কাজ করে গেছেন। এমন কী দোকানের ইন্টেরিয়র ডিজাইনার হিসাবেও ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
সমগ্র শিল্প-বিশ্বটাকে চষে বেড়িয়েছেন সালভাদর দালি। লেখালেখিতে কেবল আত্মজীবনীই নয়— নভেল, ফিকশন, স্ক্রিপ্ট, প্রবন্ধ, বক্তৃতা অন্যদিকে তেলরঙ, জলরঙ, ড্রইং, গ্রাফিক্স, ভাস্কর্য, ফটোগ্রাফি, লিথোগ্রাফি, ফিল্ম, অভিনয়, জুয়েলারি— সব যেন অকাতরে ধরা দিয়েছে এই শিল্পীর হাতে, তুলিতে ও কলমে। সবকিছুই যেন চূড়ান্ত এক শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও রুচি নিয়ে সফলভাবে প্রকাশিত হয়েছে তার হাতে।
১৯৮২-র গ্রীষ্মে শিল্পী সালভাদর দালির দীর্ঘদিনের সঙ্গিনী ও স্ত্রী গালার মৃত্যু তাকে স্তব্ধ করে দেয়। জীবনের প্রতি সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন তিনি, আগ্রহ হারালেন শিল্প সৃষ্টির প্রতিও। বরং অনেকটা যেন আত্মহননের পথে ঝুঁকে পড়লেন। মানসিকভাবে এতটাই বিধ্বস্ত হয়ে পড়লেন যে, একবার তো শোবার ঘরে আগুনের মুখোমুখি পর্যন্ত হলেন। এর ফলে তার প্রতি সতর্ক নজরদারের মাত্রাও বাড়াতে হলো। গালার মৃত্যু সংবাদ শোনার পর তিনি কেবল বলেছিলেন, “…সে মরেনি, সে মরতে পারেনা…। ’
দালি শেষ ছবি আঁকলেন ১৯৮৩ র মে মাসে, ‘দ্যা স্যাডো’স টালি’। তারপর বেঁচে থাকলেন আরো ছয় বছর। হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন, পেসমেকার বসানো হলো। অবশেষে ১৯৮৯-এর ২৩শে জানুয়ারিতে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন শিল্পী সালভাদর দালি। খুব অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে এসে জীবনের শেষ কটি দিন বার বার রেকর্ডে বাজিয়ে শুনেছেন তার প্রিয় অপেরা ত্রিস্তান এন্ড ইজোলদ। এভাবেই পরম শান্তিতে নতুন এক পৃথিবীর পথে যাত্রা করেছেন বিংশ শতাব্দীর অসম্ভব প্রতিভাধর এই শিল্পী। সমাধিস্থ করা হলো স্পেনের বার্সেলোনায় তারই গড়া ‘মিউজিয়াম থিয়েটার অব দালি’র ভূগর্ভস্থ কক্ষে।
পৃথিবীতে দালিই একমাত্র শিল্পী যার প্রতি নিবেদিত হয়েছে দুটি একক চিত্রশালা। যেখানে কেবল তারই সৃষ্টি দিয়ে সাজানো হয়েছে এই মিউজিয়ামগুলো। এর একটি আমেরিকায় ‘দ্য সালভাদর দালি মিউজিয়াম ফ্লোরিডা’, অন্যটি স্পেনে ‘দালি থিয়েটার অ্যান্ড মিউজিয়াম’। যেগুলোতে রয়েছে এই শিল্পীর আঁকা ও গড়া অসংখ্য তেলরঙ, ভাস্কর্য, স্কেচ ও গ্রাফিক্স। এছাড়া সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে আছে তার অসংখ্য শিল্পকর্ম। সালভাদর দালিই অন্যতম সেই শিল্পী যে কিনা তার জীবন কাটিয়েছেন একজন সার্বভৌম স্বাধীন স্রষ্টার মতোই।
বাংলাদেশ সময়: ০৬২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০,২০১৫
আরএম/আরআই
** গির্জাভিত্তিক পর্যটন
** এনভার্সে জাকিরের দেখা
** বাস্তিল ঘিরে পর্যটন
** প্যারিসের গণতন্ত্র ময়দান
** বাতাক্লঁয়ে প্রতিদিনই আসছে মানুষ