বিশ শতকের ষাটের দশকে বাংলাদেশের কবিতা বিষয় ও শিল্পমূল্যের বিচারে যে সম্পন্নতা অর্জন করে, তার উত্তরাধিকার মেনে নিয়ে কবিতায় নতুন আলোড়ন সৃষ্টি সহজ কাজ ছিল না। এ সময়ের কবিতার প্রধান প্রবণতাই ছিল ‘জন্মান্ধ’, ‘জন্মেই কুঁকড়ে’ যাওয়া, ‘স্বপ্নের বাস্তবে’র মুখোমুখি আত্মবিসর্জন।
মা আমাকে ক্রন্দনসিক্ত একটি চুম্বনের মধ্যে লুকিয়ে রেখে/অনেক জঙ্গলের পথ অতিক্রম করে/পুকুরের জলে চাল ধুতে গেলেন। /আমি ঘরের ভিতরে তাকালুম, দেখলুম দু’ঘরের মাঝামাঝি/যেখানে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি ছিল/সেখানে লেনিন, বাবার জমা-খরচের পাশে কার্ল মার্কস,/আলমিরার একটি ভাগ কাচের অভাব পূরণ করছে/স্ক্রুপস্কায়ার ছেঁড়া ছবি।
[হুলিয়া, প্রেমাংশুর রক্ত চাই]
এভাবেই সমকালের আত্মমুখী, উল্লম্বধর্মী চেতনার জগৎ থেকে কবিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হলো জীবনের আনুভূমিক রেখা ধরে। আত্মগত প্রেমকে জনসম্মুখে প্রকাশের উদ্দাম আকাঙ্ক্ষায় কবি তার প্রেমিকাকে পল্টনের জনসমাবেশে উপস্থিত করেন। এবং প্রেম, নারী ও যৌনতার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে ক্রমাগত উত্থাপন করতে থাকেন সমাজ-রাজনীতি-আন্দোলন ও সংগ্রাম সম্পর্কে অপার অনীহার কথা। এটা যে এক ধরনের কূটাভাস, তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবে কাব্যবস্তু উপস্থাপনের ক্ষেত্র নির্জন গৃহকোণ অপেক্ষা লোকালয় প্রিয় হয়ে ওঠায় কবিতার শব্দবিন্যাস হয়ে ওঠে ভাষণধর্মী ও লোকরঞ্জক। নির্মলেন্দু গুণের প্রথম পর্বের তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই (১৯৭০), না প্রেমিক না বিপ্লবী (১৯৭২) ও কবিতা, অমীমাংসিত রমণী (১৯৭৩) থেকে তার কবিস্বভাবের যে লক্ষণগুলো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, তার মধ্যে কখনও প্রেমের প্রাধান্য, কখনও-বা বিপ্লবের প্রাধান্য, আবার কখনও কখনও দুয়ের সমান্তরাল উপস্থিতি। প্রেমিক ও বিপ্লবীর দ্বৈতসত্তার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় না বরং আবেগের স্বতঃস্ফূর্ততা উদ্দামতায় প্রেম, নারী, রমণেচ্ছা ও সংগ্রামী চেতনার সহাবস্থান ঘটে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যেতে পারে:
১. তুমি বোললে তাই আমরা এগিয়ে গেলাম,/নিষ্পাপ কিশোর মরলো আবদুল গনি রোডে। /তুমি বোললে রাজপথ মুক্তি এনে দেবে—/আমরা ভীষণ দুঃখী, নিপীড়িত শত অত্যাচারে/‘গীতাঞ্জলি’ অকর্মণ্য হবে। /আমরা তাই রঙিন প্লাকার্ড/সাজিয়েছি মাও-সে-তুং, গোর্কি, নজরুলে।
[জনাকীর্ণ মাঠে জিন্দাবাদ, প্রেমাংশুর রক্ত চাই ]
২. পুলিশ স্টেশনে ভিড়, আগ্নেয়াস্ত্র জমা নিচ্ছে শহরের/সন্দিগ্ধ সৈনিক। সামরিক নির্দেশে ভীত মানুষের/শটগান, রাইফেল, পিস্তল, কার্তুজ যেন দরগার/স্বীকৃত মানত্। টেবিলে ফুলের মতো মস্তানের হাত। /আমি শুধু সামরিক আদেশ অমান্য করে হয়ে গেছি/কোমল বিদ্রোহী। প্রকাশ্যে ফিরছি ঘরে/অথচ আমার সঙ্গে হূদয়ের মতো মারাত্মক/একটি আগ্নেয়াস্ত্র, আমি জমা দিই নি।
[আগ্নেয়াস্ত্র, না প্রেমিক না বিপ্লবী ]
৩. অশৈশব স্বাধীনতা লোভে যে যুবক/হিংসাহীন প্রেমের বিক্ষোভে বলেছিল;/‘যুদ্ধ নয়, ভালবেসে জিতে নেবো তারে। ’/মানুষের মৃত হারে সে এখন সশস্ত্র সন্ত্রাস।
[মুখোমুখি, না প্রেমিক না বিপ্লবী ]
৪. আমি চালের আড়তকে নারীর নগ্নতা বলে ভ্রম করি। /রাজবন্দীর হাতের শৃঙ্খল আমার চোখের মধ্যে নারীর/শাঁখার মতো প্রেমের বন্ধন হয়ে কাঁপে; আমি ভ্রম করি।
[সর্বগ্রাসী হে নাগিনী, অমীমাংসিত রমণী]
উদ্ধৃত কবিতাংশগুলো থেকে হূদয়বৃত্তি ও প্রেমের প্রতি কবির পক্ষপাত সম্পর্কে যেমন ধারণা পাওয়া যায়, তেমনি দ্রোহ ও সংগ্রামে তার অকুণ্ঠ অংশগ্রহণের ইঙ্গিত বিদ্যমান। হূদয়বৃত্তিকে সবকিছুর কেন্দ্রে স্থাপন করায় গুণের কবিতা সমকালের অস্থির তরুণ-মানসকে সর্বাধিক আকর্ষণ করেছিল। ‘হূদয়ের মতো মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র’ও জাগতিক নিরাত্তার কোনো বিঘ্ন ঘটায়নি। না প্রেমিক না বিপ্লবীতে মুক্তিযুদ্ধোত্তর জীবনাবেগের পাশাপাশি নারীসান্নিধ্য ও রমণপ্রিয়তা প্রাধান্য পেয়েছে। ‘তুমি যেখানেই স্পর্শ রাখো সেখানেই আমার শরীর’ (তুলনামূলক হাত) জাতীয় উচ্চারণ যেমন আছে, তেমনি আছে ‘রূপসী নারীর চুল ফুল নয়, গুচ্ছ গুচ্ছ শোকের প্রতীক (প্রথম অতিথি)। প্রথম তিনটি কবিতাগ্রন্থে নির্মলেন্দু গুণ তার কবিস্বভাবের যে প্রান্ত উন্মোচন করেন, তা আবেগধর্মী অথচ প্রেমে-দ্রোহে উচ্চকিত। যে স্ববিরোধ তাকে নেতিবাচক মনে করার কোনো কারণ দেখি না। আবেগ-উচ্ছ্বাসের মধ্যে তারল্য থাকে, আত্ম-উন্মোচনের মধ্যে থাকে স্বতঃস্ফূর্ত বিবরণধর্মিতা। কিন্তু এক মৌলিক শিল্পপ্রক্রিয়ায় নির্মলেন্দু গুণ তাকে কালের যুবমানসের আবেগের কাছে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন।
নির্বাচিতা নামক কবিতা সংকলনের প্রথম সংস্করণের (১৯৮৩) ভূমিকায় নির্মলেন্দু গুণ তার কবিতাচর্চার একটা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ থেকে তার কবিসত্তার মৌল রূপ এবং রূপান্তরের গতিবিধি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়:
সহজ করে পাওয়ার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। চারপাশের কঠিনের ভিড়ে আমি চাই সহজ করে বলতে— জানি এ স্বভাব নাগরিক-কবির নয়, লোককবির। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র কবিদের মধ্যে আমার জন্ম। আমার জীবনের প্রথম ষোল বছর একটানা কেটেছে গ্রামের আউল-বাউল আর চাষাভুষাদের মাঝে। খুব ছোটবেলা থেকেই তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার স্পর্শ পেয়েছি আমি। সেখানেই আমার কবিসত্তার জন্ম হয়েছে। আমি অনুভব করেছি, আমাদের আপাতনির্দোষ সমাজব্যবস্থার গভীরে একটা বড় রকমের ব্যধি আছে লুকানো। আমি আহত হয়েছি এই সমাজের দিকে তাকিয়ে। তারপর যে সময়টাতে কবি হওয়ার উদ্দেশ্যে ময়মনসিংহ ছেড়ে আমি ঢাকায় যাই, সেই সময়টা উদ্দাম যৌবনতরঙ্গের মতো এমই মুক্তিমন্ত্রে ফুঁসে উঠেছিল যে, ওই সময়ের ঢেউ যার রক্তে লেগেছে তার পক্ষে নিরপেক্ষ বা নির্ভেজাল রোমান্টিক কবি হওয়া একবারেই সম্ভব ছিল না। বাধ্য হয়েই শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আমাকে কলম ধরতে হয়েছে। এভাবেই আমার কবিতার সংগ্রাম রূপান্তরিত হয়েছে সংগ্রামের কবিতায়।
কবির এই স্বগতকথন থেকে কবিচৈতন্যের যে বৈশিষ্ট্যগুলো উন্মোচিত হয়, তা-হলো, লোকজীবনাভিজ্ঞতা, সমাজমনস্কতা এবং রাজনীতিসজ্ঞানতা। এই তিন স্রোতের সঙ্গে সমান্তরাল প্রবাহিত হয়েছে শিল্পের সেই অনির্বচনীয় ও রহস্যময় স্রোতস্বিনী— যার নাম রোমান্টিক প্রেমাবেগ। এই রোমান্টিকতা যে উনিশ শতকীয় রোমান্টিকতার স্বভাবধর্ম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তা বলাই বাহুল্য। কবি স্বীয় স্বভাবধর্ম ও কাব্যবস্তু সম্পর্কে যে অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন, সেখানও এ উক্তির সত্যতা প্রমাণিত হয় : আমার কবিতা আমার সংগ্রামী আত্মার হূত্স্পন্দনচিত্র। আমার আত্মার আনন্দের সঙ্গে, উপলব্ধি ও আর্তির সঙ্গে একাকার হয়ে মিশেছে বলেই আমি যখন শ্রমিক-কৃষকের কথা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রাহের কথা বলি, তখন কেউ কেউ ভুল করে ভাবেন আমি বুঝি কবিতা বাদ দিয়ে রাজনীতি করছি। প্রকৃতপক্ষে মোটেও তা নয়। অপরের মুখ যখন আপনার হয়ে ফিরে আসে, তখনই বন্দনা গাই সেই মুখের। দুর্বলের প্রতি আচরিত অত্যাচার যখন ঘা দেয় আমার বুকে তখন আমার নয় বলে তাড়িয়ে দিই না তাকে— আপনার বলে সে অনায়াসে গৃহীত হয় আমার কবিসত্তার ভেতর-মহলে। এভাবেই আমার কবিচিত্ত অপরের নিত্যদিনের জীবন-সংগ্রামে যুক্ত হয়। এই যুক্ত হওয়াটাই আনন্দের; নারীর সঙ্গে, সন্তানের সঙ্গে... সুন্দরের স্বপ্নের সঙ্গে যেমন। মৃতের দেশে অমৃতকুম্ভের স্বপ্ন নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছি আমি। আমি অন্তহীন এক আনন্দের উৎস খুঁজে পেয়েছি জীবনের মাঝে। পরিপার্শ্ব যত বৈরীই হোক না কেন— আমি তো আর মেনে নিচ্ছি না তা। আমি জানি, সংগ্রামই সত্য, সংগ্রামই সুন্দর। প্রেম, সে-ও এক সংগ্রাম। ’ (ভূমিকা : নির্বাচিতা)
এই সহজ স্বীকারোক্তির মাঝেই কবির রোমান্টিক চিত্তবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায়। ‘সুন্দরের স্বপ্ন’ এবং জীবনের মাঝে ‘অন্তহীন এক আনন্দের উৎস’ খুঁজে পাওয়ার মধ্যে কবির রোমান্টিক মানসিকতাই মূলত ক্রিয়াশীল। কবি নির্বাচিতার ভূমিকা লিখেছিলেন ১৯৮৩ সালের শেষ দিকে। এর আগেই তার কবিজীবনের, কাব্যবস্তু ও প্রকরণের একাধিক পালাবদল ঘটে গেছে। প্রথম পর্যায়ের প্রেম ও বিষণ্নতা ও নৈঃসঙ্গ্যবোধে আকণ্ঠ নিমজ্জিত তিনি। দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী (১৯৭৪), চৈত্রের ভালোবাসা (১৯৭৫), ও বন্ধু আমার (১৯৭৫) এবং আনন্দকুসুম (১৯৭৬) কাব্যগ্রন্থে সমাজ ও সংগ্রাম থেকে বিছিন্ন কবি এক আত্মমুখী, নির্জন বিরহলোকের অধিবাসী। এর ফলে কবিতার রূপকল্পেও বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। তার ভাষণধর্মিতার পরিবর্তে কবিতা হয়ে উঠেছে গীতল ও চিত্ররূপময়।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মধ্যবিত্তের স্বপ্নভঙ্গ এবং ১৯৭৫ পরবর্তী কালপরম্পরায় সেনাতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির পুনরুত্থানের যে কোনো সংবেদনশীল কবিচিত্রে পরাজয়ক্লিষ্টতা ও বিপন্নতাবোধ জাগ্রত হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। নির্মলেন্দু গুণের বিশেষত্ব এখানে যে, আত্মরতি কিংবা দেহজ আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তে তিনি স্মৃতি ও স্বপ্নের এক বাসনালোক সৃষ্টি করেন। কাব্যগ্রন্থ বাংলার মাটি বাংলার জল (১৯৭৮) থেকেই গুণের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে। সামাজিক উপযোগিতাবোধের সঙ্গে কবিতার অন্তর্ময় সঙ্গতি শিল্পের ইতিহাসের একটা স্বীকৃত পন্থা। তার আগে চাই সমাজতন্ত্র (১৯৭৯) চাষাভুষার কাব্য (১৯৮১), দূর হ দুঃশাসন (১৯৮৩) প্রভৃতি কাব্যে তিনি শিল্প অপেক্ষা বক্তব্যের চাহিদাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে কবি যে সচেতনভাবে এই নতুন কাব্যবস্তু গ্রহণ করলেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক বোধ ও অঙ্গীকারের প্রশ্নে কবির সোচ্চার আত্মপ্রকাশ কখনও কখনও পাঠকচিত্তকেও আলোড়িত করছে প্রবলভাবে। বাংলার মাটি বাংলার জল থেকেই নির্মলেন্দু গুণের মধ্যে জাগ্রত হতে থাকে প্রত্যাবর্তনস্পৃহা। একটা সুস্থ রাজনৈতিক অভিজ্ঞান থেকে যেন তার পুনর্জন্ম ঘটে। রাজদণ্ড, তোমার মুক্তির জন্য হে সুন্দর, আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসি নি, প্রত্যাবর্তন, কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে আলাপ প্রভৃতি কবিতায় গুণের এ পর্যায়ের আত্মস্বরূপ শিল্পিত অভিব্যক্তি পেয়েছে। কবির প্রত্যাবর্তনের অন্তর্গূঢ় রহস্যলোক আমরা স্পর্শ করতে পারি :
আমি নষ্ট হতে হতে ফিরে এসেছি
মানুষ আমাকে গ্রহণ করবে।
আমি মানুষের দেয়া দুখের পাহাড় বুকে বয়ে
শস্যশূন্য রিক্ত খামারে এবার ফুল্ল ফসল ফলাবো।
খামার আমাকে গ্রহণ করবে।
... ... ...
আমার অস্তিত্বের সদাজাগ্রত মাঠে
সময় এখন শস্য বুনছে, শস্য ফলবে।
[প্রত্যাবর্তন, বাংলার মাটি বাংলার জল]
সামরিক স্বৈরশাসন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও কবির কিছু বক্তব্যের সাহসিকতা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। দুটি উদ্ধৃতি থেকে আমরা কবির বিশ্বাস ও চেতনার কেন্দ্রমূল স্পর্শ করতে পারি :
১. সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,/রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেই সব গোলাপের একটি গোলাপ/গতকাল আমাকে বলেছে : আমি যেন কবিতায়/শেখ মুজিবের কথা বলি। আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি,
[আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি, বাংলার মাটি বাংলার জল]
২. শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হূদয়ে লাগিল দোলা,
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা—,
কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠবাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর
অমর কবিতাখানি :
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ’
সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।
[স্বাধীনতা, এই শব্দটি কি ভাবে আমাদের হলো,
তার আগে চাই সমাজতন্ত্র]
রাজনৈতিক বক্তব্যের গণমুখিতা একজন কবিকে কতটা পাঠকপ্রিয়তা দান করে, কাজী নজরুল ইসলামের দৃষ্টান্ত থেকে তা আমাদের জানা। এ জাতীয় অনেক কবিতায় নির্মলেন্দু গুণ বাঙালি পাঠকচিত্তের গভীরতল স্পর্শ করতে সমর্থ হয়েছেন। বিশেষ করে শ্রেণীবৈষম্যহীন, সুষম বণ্টনের মাধ্যমে একটি সাম্যবাদী সমাজ ও এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে, কার্ল মার্কস, লেনিন, মাও সে তুংয়ের আদর্শের পথ ধরে সমাজের যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধিত হবে— এ জাতীয় স্বপ্ন ইউটোপীয় মনে হলেও কবির বিশ্বাসের কেন্দ্র থেকেই উত্থিত।
নির্মলেন্দু গুণ বাংলাদেশের স্বাধীন কবিতা-ভূখণ্ডের মৌলিক কবি। ব্যক্তি ও সমষ্টির ভেতর-বাইরের সংগ্রামের সমান্তরালে তিনি কবিতার বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। আবেগ ও বিশ্বাসের সততায় তিনি স্পর্শ করেছেন বাঙালি-জীবনের মৌল প্রাণস্পন্দন। জীবনসংগ্রামের সঙ্গে শিল্পসংগ্রামের যৌথায়নে তার যে কাব্যলোক গড়ে উঠেছে, তা বাঙালি জতিকে পথ দেখাবে বহুকাল। (পরিমার্জিত)
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১৪