ঢাকা : ২০০২ সালের ওই ঘটনাটি না বললেই নয়। খুলনার পাইকগাছার একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একবার একটি বিচার করেছিলেন।
যে মা তাকে খাইয়ে দিয়েছে, সেই মায়ের সামনে নিজের সন্তান ও স্ত্রীর মুখে ভাত তুলে দিলেও মাকে অভুক্ত রাখতো। ভাত চাইলে মাকে মারধরও করতো। তারপরও মা নালিশ করেনি, করেনি অভিযোগ। একমাত্র সন্তানের এমন আচরণ প্রতিবেশীদের চোখ ভিজিয়ে দেয়। তারা বিচার চায় চেয়ারম্যানের কাছে।
চেয়ারম্যান পরবর্তী সময়ে ওই পাষণ্ড ছেলেকে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা ও বিচার করেও কোনো ফল পাননি। তার নিয়মিত ব্যবহার অব্যাহত ছিল।
পরে একদিন বিচার ডেকে তিনি বললেন, তোকে যেহেতু শোধরানো গেলো না সেহেতে তোর দায়িত্ব আজ থেকে শেষ। বৃদ্ধ ভাতা আর প্রতিবেশীদের সহায়তা নিয়েই তোর মা বেঁচে থাকবে।
আজ থেকে তোর মায়ের কোনো সন্তান রইল না। হ্যা, তবে আজ থেকে যে নয় মাস তোর মা তোকে পেটে করে ঘুরে বেড়িয়েছে, সমস্ত কাজ করেছে, সেরকম ওজনের ইট তোর পেটে বেধে দেওয়া হবে। তোকে ওভাবেই নয় মাস কাজ করতে হবে, ওভাবেই ঘুমাতে হবে এবং পেট থেকে ইট খোলা যাবে না।
তাহলে তোর জন্মদাতা মাকে অস্বীকার করতে পারবি এবং এরপর থেকে সমস্ত সম্পত্তি তোর থাকবে। তোর মাকে আমরা দেখবো।
বিচার শুনে উপস্থিত সকলে খুশি এবং ওই পাষণ্ড ছেলেও খুশি। সে ভেবেছিল এ আর এমনকি। পেটে ইট নিয়ে ঘোরা কোনো বিষয় না। তাহলে মার ঝামেলাও গেলো, সঙ্গে সম্পত্তিও পেলাম।
ওই ছেলে পেটে ইট বেধে দু’দিনও পার করতে পারেনি। বুঝেছিল জন্মদাত্রী মায়ের কষ্ট, বুঝেছিল তার ভুল। শুধরে নিয়েছিল নিজেকে, সেবা করেছিল মাকে।
জানিনা ওই মা বেঁচে আছে কিনা? তবে এমনভাবে কাউকে যেন বুঝতে না হয় আমাদের অগ্রজদের ভূমিকা। আমাদের অগ্রজরা বন্ধুর পথকে মসৃণ করেছে। তাই তাদের যতেœ তাদের পাশে আমাদের থাকতে হবে।
আজ বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। এ বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ‘প্রবীণদের যতœ নিন’। প্রবীণদের যতœ, তাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা, তাদের সমস্যা এবং সমাধান নিয়েই পালিত হচ্ছে দিবসটি।
সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশও পালন করছে দিবসটি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের প্রবীণরা এখনও আমাদের বোঝা হননি। আমাদের পারিবারিক কাঠামো, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সংস্কৃতি প্রভৃতি প্রবীণদের প্রতি সম্মান এবং ভালোবাসা বোধ সৃস্টি করে।
প্রবীণদের ডায়েট সচেতনতায় কি কি করণীয় এবং কি কি করা যাবে না তা নিয়ে আজকের আয়োজন:
যখন মানুষের বয়স বাড়তে থাকে তখন তার শরীরে পুষ্টির চাহিদা বাড়তে থাকে। তখন তার শরীর ভেঙে পড়ে। এসময় তার শরীরে টিস্যু এবং বৃদ্ধির সেলগুলোর অনেক পরিবর্তন ঘটে।
এসময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও হজম ক্ষমতা কমে যায়, হাড় এবং মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যায়। এমনকি শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগে।
ফলে বৃদ্ধ বয়সে শরীরের ক্ষমতা কমে যায়। এমনকি ডায়াবেটিস, বাত, উচ্চ রক্তচাপসহ রক্তে কোলেস্টরল বেড়ে যেতে পারে।
আর এগুলো হলে অবশ্যই খাওয়া কমাতে হবে। তবে খাওয়া কমানোর চেয়ে সঠিক পদ্ধতি মেনে কাওয়া-দাওয়া করলে এ ধরণের রোগ থেকে মুক্ত করা যাবে বৃদ্ধদের। ফলে পরিবারের লোকজনের যতœ এবং নিয়মিত তাদের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন এনে বার্ধক্য থেকে তাদের দূরে রাখতে পারেন।
ভিটামিন, প্রোটিন, মিনারেল, তরল এবং কার্বোহাইড্রেড জাতীয় খাদ্য তাদের বারেবারে খেতে হবে। একবারে বেশি খাওয়া যাবে না। তবে অবশ্যই দেখতে হবে যে, যেসব খাবারের মধ্যে উপরোক্ত পুষ্টিগুণ থাকবে এবং যেগুলো সহজে হজম হবে।
বৃদ্ধ হওয়া হলো একটি প্রক্রিয়া। নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে ধীরে ধীরে মানুষ বৃদ্ধ হয়। একে বলা হয় শরীরের কোষের ‘অক্সিডেশন’। এই অক্সিডেশনের ফলে পেশি দুর্বল হয়ে যায়, চুল সাদা হয় ও ঝরে পড়ে যায়, চামড়া ঢিলে হয়ে যায় এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
শরীরের অক্সিডেশনের প্রভাব কমাতে ভিটামিন ই, সি এবং এ এর পাশাপাশি তরল জাতীয় খাদ্য। দেখা যায় পরিবারের অন্য সদস্যদের তুলনায় বৃদ্ধরা একটু বেশি অলস সময় পার করেন। এজন্য খাওয়া দাওয়ার বিষয়ে তাদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
বিশেষ করে বৃদ্ধ নারীদের ডায়াট বিষয়ে বেশিই সতর্ক থাকতে হবে। কেননা এসময়ে তাদের মনোপোজ চলে, তাদের শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দেয়। ফলে শরীরের সংযোগ স্থলগুলো দুর্বল হয়ে যায় এবং যে কোনো সময় ফ্রাকচার হয়ে যেতে পারে।
এজন্য খাবার রান্না করার সময় নরম রাখতে হবে। যাতে খাবার খেতে আরামদায়ক হয়, তাতে পুষ্টিগুণ থাকে এবং সহজে চিবানো যায়।
বৃদ্ধ বয়সে সঠিকভাবে খাওয়ার টিপস:
• প্রাকৃতিক বিভিন্ন রঙের খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। দিনে দুই থেকে তিন বার মৌসুমি ফল খেতে হবে। মৌসুমি ফল দ্রুত বৃদ্ধ হওয়া রোধ করে অর্থাৎ শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট তৈরি করে এবং কোষ্ঠকাঠিণ্য প্রতিরোধ করে।
• ডিমের সাদা অংশে প্রচুর প্রোটিন থাকে। এই প্রোটিন শরীরের সেল এবং টিস্যু পুনর্গঠনে সাহায্য করে। তবে যারা নিরামিষ খান তারা কম ফ্যাট যুক্ত দুধ থেকে প্রোটিন পেতে পারেন।
• সরিষার তেল বা জলপাই তেল (অলিভ ওয়েল) দিয়ে রান্না রক্তে ক্ষতিকারক কোলেস্টরল কমাতে এবং ভালো কোলেস্টরল বাড়াতে সাহায্য করে।
• দিনে ঘন ঘন অর্থাৎ ছয় থেকে সাত বার খেতে হবে। তাহলে হজমে সুবিধে হবে এবং ক্লান্তি দূর হবে।
• রাতে হালকা ধরণের খাবার খেতে হতে পারে। এক্ষেত্রে সবজির স্যুপ বেশ উপকারী।
• ঘর থেকে বের হওয়ার আগে অবশ্যই ব্যাগের মধ্যে স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস সঙ্গে নিতে হবে।
• খাবার রং এবং প্রিজারভেটিভ দেওয়া প্রক্রিয়াজাত খাবার বর্জন করতে হবে। সবসময় তাজা খাবার খেতে হবে।
• পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার জিরা, মেথি, ডাবের পানি প্রভৃতি মাংসপেশির জন্য ভালো। উচ্চরক্তচাপ কমাতে এগুলো সাহয্য করে এবং শরীরে পানির অভাবও পূরণ করে।
• এসময় দই শরীরের জন্য ভালো।
• ডিহাইড্রেশন কমাতে দিনে কমপক্ষে ১৫ গ্লাস পানি খেতে হবে। বৃদ্ধ বয়সে ডিহাইড্রেশন বাড়ে। আর গরম কালে এর প্রবণতা বেশি থাকে তাই বেশি করে পানি পান করতে হবে।
• বেশি সময় ধরে রান্না করা খাবারে পুষ্টিগুণ কমে যায়। তাই কম সময়ে রান্না করা খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।
• মনে রাখতে হবে প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হবে। এক্ষেত্রে যোগ ব্যায়াম খুবই উপকারী।
এরপরও যদি কোনো কারণে শরীরে সমস্যা দেখা দেয় তাহলে ভালো একজন ডাক্তারকে দেখিয়ে তাদের পরামর্শ মতো চলতে হবে। বৃদ্ধদের পাশে দাঁড়িয়ে আমারা যদি তাদের শরীরের প্রতি যতœ নিতে পারি তাহলে আরও হয়তো কিছুদিন এসব জ্ঞানী মানুষগুলোর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভাগীদার হতে পারবো।
তাই বৃদ্ধদের বোঝা মনে না করে, পারিবারিক বলয়ে তাদের দেখভাল করি। ঠিক যেমনটি তারা আমাদের জন্য করেছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৭, ২০১২
সম্পাদনা: তানিয়া আফরিন, বিভাগীয় সম্পাদক