ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

ম্যালেরিয়া সম্পর্কে এখনই সাবধান হোন

শহীদুল ইসলাম, চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১২
ম্যালেরিয়া সম্পর্কে এখনই সাবধান হোন

ঢাকা: বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস আজ। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘ম্যালেরিয়া রোগে বিনিয়োগ ও সাফল্য ধরে রাখি: জীবন বাঁচাই।



গবেষকরা আশঙ্কা করেছন যে, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে পতঙ্গবাহিত রোগ বেশি বেড়ে যাবে। তার মধ্যে মারাত্মক আকার ধারণ করবে ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ।

এজন্য প্রয়োজন কিছু স্বচ্ছ ধারণা। যাতে সাধারণ মানুষ ম্যালেরিয়া জ্বর থেকে নিজেকে রাখতে পারে দূরে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিতে পারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

ম্যালেরিয়া কি: ম্যালেরিয়া এক প্রকার পরজীবী দ্বারা সংঘটিত সংক্রামক জ্বর। এ ধরণের জ্বর সাধারণত এনোফিলিস জাতীয় স্ত্রী মশা দ্বারা ছড়ায়। ম্যালেরিয়ার জীবাণু মানুষের দেহে বসবাস করে, বংশ বৃদ্ধি করে এবং বেঁচে থাকে। এজন্য একে পরজীবী বলে।

মূলতঃ প্লাজমোডিয়াম চার রকমের থাকলেও, বাংলাদেশে প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপ্যারাম এবং প্লাজমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স দ্বারা ম্যালেরিয়া হয়ে থাকে।

ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ: মনে রাখা প্রয়োজন যে, মশার দেহে ম্যালেরিয়া জীবানুর যৌনচক্র সম্পন্ন হয়। প্রজাতি ভেদে এ চক্রটি সম্পন্ন হতে ৭ থেকে ১৪ দিন সময় লাগে।

বাহক মশা ম্যালেরিয়া রোগীকে কামড়ানোর সময় পরজীবী গ্রহণ করে এবং ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে সংক্রমণযোগ্য হয়ে পড়ে। এই সংক্রমণযোগ্য মশা সুস্থ মানুষকে কামড় দিলে তার শরীরে ম্যালেরিয়ার পরজীবী প্রবেশ করে এবং সেই ব্যক্তি আট থেকে ১০ দিনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

অসুস্থ ব্যক্তি চিকিৎসা না পেলে গ্যামেটোসাইটধারী বাহকে পরিণত হয়। এই রোগীকে ভেক্টর মশা কামড়াবার সময় ম্যালেরিয়ার পরজীবী গ্রহণ করে। এইভাবে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ চলতে থাকে।

ম্যালেরিয়া সংক্রমিত এলাকা: বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি। এছাড়া চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চল- হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ এবং শেরপুর ও উত্তরাঞ্চলের মধ্যে কুড়িগ্রামে ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি।

ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী:  
•    ম্যালেরিয়া ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের পাঁচ বছরের নিচের শিশু।
•    ম্যালেরিয়া প্রকোপ এলাকার গর্ভবতী নারী। বিশেষ করে যারা প্রথম সন্তান সম্ভবা।
•    কম ম্যালেরিয়া প্রকোপ অঞ্চলের সমস্ত জনগোষ্ঠী।
•    খুবই কম প্রকোপ অঞ্চল অথবা একবারেই ম্যালেরিয়া নেই, সেই সমস্ত এলাকা থেকে ম্যালেরিয়া প্রকোপ এলাকায় ভ্রমণ করতে আসা জনগণ।
•    উচ্চ ম্যালেরিয়া প্রকোপ অঞ্চলের ব্যক্তি যারা বেশ কয়েক বছর অন্য অঞ্চলে (যেখানে ম্যালেরিয়া নেই) বসবাস করে পুনরায় ফেরত আসেন।


ম্যালেরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপসর্গ:
•    রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়। এটি সেলিব্রাল ম্যালেরিয়ার লক্ষণ।
•    বার বার খিঁচুনি হওয়া। যেমন- হাত-পা ঝাঁকুনি দেওয়অ, চোখ উল্টে যাওয়া, জিহ্বায় কামড় খাওয়া। এমনকি কাপড়ে প্রসাব-পায়খানা করে ফেলা।
•    হঠাৎ করে অসংলগ্ন আচরণ করা কিংবা পাগলামী করা।
•    অত্যাধিক দুর্বল হয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে রোগী অন্যের সাহায্য ছাড়া বসতে, উঠতে ও দাঁড়াতে পারবে না।
•    এ সময় শিশুরা মায়ের বুকের দুধ খেতে পারে না। কিংবা বোতলের দুধ খেতে পারে না।
•    বার বার বমি হয়। যার ফলে খেতে পারে না, দুধ বা অন্য পানীয় পান করতে পারে না।

ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে ব্যবস্থা: ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ে যে সমস্যা হয় তা হলো সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করা। যদি সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করা যায় তাহলে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থাগুলো হলো-
•    দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা দেওয়া।
•    মশার কামড় হতে আত্মরক্ষা করা।
•    এলাকাতে মশার জন্ম ও বংশ বিস্তার রোধ করা।
•    মহামারী দ্রুত চিহ্নিত করে তা নিয়ন্ত্রণ করা।
•    ম্যালেরিয়া উপদ্রুত অঞ্চলের জনগণকে উপযুক্ত স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান।
•    এই রোগ এবং তার বিস্তার সম্পর্কে জনগণকে বাস্তব ধারণা দিয়ে তাদের বিভিন্ন প্রতিরোধ কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
•    বিভিন্ন প্রকার পোস্টার, ব্যানার, বিল বোর্ড ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমরে সাহায্যে জনগণকে সচেতন করে তোলা।

মশার কামড় থেকে আত্মরক্ষার উপায়:
•    ঘুমানোর সময় মশারি (ম্যালেরিয়া ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কীটনাশকে চুবানো) ব্যবহার করতে হবে।
•    মশা তাড়াতে ধোঁয়া ব্যবহার ব্যবহার করা।
•    যতটুকু সম্ভব শরীর ঢেকে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে নারী ও পুরুষদের ফুল হাতা ব্লাউজ ও শার্ট এবং শিশুদেরও শরীর ঢেকে রাখতে হবে।
•    সম্ভব হলে শোবার ঘরে দরজা জানালায় মশার প্রতিবন্ধক জাল ব্যবহার করতে হবে।

মশার জন্ম ও বংশ বিস্তার রোধে ব্যবস্থা: মশার বংশ বিস্তার রোধে আমাদের খুবই সচেতন হতে হবে। সচেতন নাগরিকই পারে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ করতে পারে।

•    আবদ্ধ জলাশয় যেমন: অপ্রয়োজনীয় ডোবা, গর্ত, নর্দমা ইত্যাদি জায়গা ভরাট করে ফেলতে হবে। কারণ এসব এলাকাতে মশা ডিম পাড়ে এবং বংশ বিস্তার করে।
•    স্থায়ী আবদ্ধ জলাশয় শুককীট খেকো মাছ চাষ করা এবং পানির কিনারায় ঘাস পরিষ্কার করা।
•    বিষেশ ক্ষেত্রে মশা ধ্বংসকারী কীটনাশক ছিটিয়ে মশা ধ্বংস করা।
•    সবত বাড়ি ও চারপাশে বেড়ে ওঠা অপ্রয়োজনীয় ঝোপঝাড় কেটে পরিষ্কার করা।

সবশেষে মনে রাখা ভালো যে, মারাত্মক ম্যালেরিয়া একটি মৃত্যু ঝুঁকিপূর্ণ রোগ। তবে দ্রুত এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেলে রোগী সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করতে পারে। তবে অবশ্যই হাসপাতালে যেয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।

লেখক: শহীদুল ইসলাম, চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ, স্বাস্থ্য অধিদফতর

বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১২
সম্পাদনা: তানিয়া আফরিন, বিভাগীয় সম্পাদক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।