ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

হারিয়ে যাচ্ছে ক্যানসার-ডায়াবেটিস প্রতিরোধী তুঁতফল

মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০২৩
হারিয়ে যাচ্ছে ক্যানসার-ডায়াবেটিস প্রতিরোধী তুঁতফল ছবি: বাংলানিউজ

দিনাজপুর: বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত প্রায় গাছগুলোর মধ্যে তুঁতগাছ অন্যতম। এ গাছের ফলের সঙ্গে অনেকের শৈশব স্মৃতি বিজড়িত থাকে।

লাল কালো বর্ণের হালকা টক মিষ্টি এ তুঁতফল।

উপকারী হলেও বর্তমানে এ ফলকে সংগ্রহ কিংবা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়না। আগে গ্রামের রাস্তার দুইপাশে তুঁতফলের গাছ লাগানো হতো। রাস্তা সম্প্রসারণ কিংবা বিভিন্ন কারণে নির্বিচারে কাটা হয়েছে এসব গাছ।

পরবর্তীতে আর লাগানো হয়নি উপকারী এ ফলের গাছটি। যার ফলে ক্রমশই কমে যাচ্ছে তুঁতগাছের সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ তুঁতফল নানা পুষ্টিগুণে ভরপুর। ডায়াবেটিস বা ক্যান্সারের মতো রোগ প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে এ তুঁতফল।

দিনাজপুরের শহর কিংবা গ্রাম কোথাও আর আগের মতো তুঁতগাছের দেখা মেলে না। তবে দিনাজপুর অঞ্চলে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের রেশম বীজাগারের অধীনে জেলা শহরের মাহুতপাড়া এলাকায় একটি বিশাল তুঁত বাগান রয়েছে।

রেশম বীজাগার সূত্রে জানা, এ বাগানে প্রায় ১১৮ একর জমিতে তুঁতগাছ ও চারা উৎপাদন করা হয়, যা রেশম গুটি উৎপাদনকারী পোকার খাদ্য সরবরাহের জন্য লাগানো হয়েছে। রেশম পোকা এই গাছের পাতা খেয়ে গুটি উৎপাদন করে থাকে। তবে তুঁতফল সংগ্রহ কিংবা সংরক্ষণ নিয়ে রেশম বীজাগারের কোনো উদ্যোগ নেই।

তুঁত বাগানে ফল খাওয়ার সময় কথা হয় দিনাজপুর উলিপুর এলাকার সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, তুঁত ফলের মৌসুমে একবার হলেও ফল খেতে আসি। ছোট বেলায় তো রাস্তার পাশে থাকা তুঁতগাছ থেকে অনেক তুঁতফল খেতে পারতাম। কিন্তু এখন তো আর আমাদের ওদিকে তেমন তুঁতগাছ নাই। এ ফল খাওয়ার সময় শৈশবের স্মৃতি মনে পড়ে। তাই এখানে ফল খেতে আসি। শুনেছি এ ফল খাওয়ার উপকারও আছে। মানুষের পাশাপাশি পশুপাখিরাও এ ফল খেয়ে থাকে।

 

বিলুপ্ত প্রায় তুঁতগাছ সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন উদ্ভিদ নিয়ে কাজ করা অনেকেই। কথা হয়েছিল উদ্ভিদ নিয়ে কাজ করা মোছাদ্দেক হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, তুঁতগাছ ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে। তুঁতগাছের পাতা রেশম গুটি পোকার খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হলেও তুঁতফল সংগ্রহ বা বাজারজাত করা হয় না। তুঁতফল মালবেরী প্রজাতির। এটা আমরা অনেকেই খেয়ে থাকি। এ গাছ সংরক্ষণ করা দরকার।

কৃষি বিভাগের খাদ্য শস্যের তালিকায় তুঁতফলের নাম নেই। তবে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকদের মতে, তুঁতফলে অনেক ওষুধি গুণ রয়েছে। বাত ব্যথা, পিত্তনাশক, বলকারক, দৃষ্টি ও শ্রবণ বৃদ্ধিকারক হিসেবে এর ব্যবহার ব্যাপক। পাশাপাশি মুখ ও গলার ঘাঁ, অজীর্ণ, জ্বর ও কৃমিনাশক হিসেবে তুঁতফল ব্যবহার হয়ে থাকে।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড প্রিজারেভেশন বিভাগের প্রফেসর ড. মারুফ আহমেদ বলেন, আমরা যেটাকে তুঁতফল বলে চিনি তাকে ইংরেজিতে মালবেরি ফ্রুটস বলে। এটি বাইরের দেশে অনেক জনপ্রিয় একটি ফল। এ ফলে অনেক পুষ্টিগুণ উপাদান আছে। জাত ভেদে প্রতি ১০০ গ্রাম তুঁতফলে ফাইবার আছে এক থেকে ১২ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৩২ থেকে ১৫২ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ৮৩৪ থেকে এক হাজার ৬৩৮ মিলিগ্রাম, আয়রন চার মিলিগ্রাম ও ম্যাগনেশিয়াম ১০৬ থেকে ১১৫ মিলিগ্রাম।

তিনি আরও বলেন, অনেক বিজ্ঞানীরাই প্রমাণ করেছেন ডায়াবেটিক, ক্যানসার রোধে এ ফল কাজ করবে। এছাড়াও অনেক স্বাস্থ্যগত গুণাগুণ এই তুঁতফলের মধ্যে পাওয়া যায়। এই তুঁতফল বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরিতে বাইরের দেশে ব্যবহার হয়ে থাকে। আমাদের দেশে হয়তো এই ফলের তেমন পরিচিতি নেই। খুব কম চাষাবাদ হয়। তবে এই ফলটির চাষাবাদ বাড়াতে পারলে এবং একইসঙ্গে বাজার সম্প্রসারণ করতে পারলে আমরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারি।  

সাধারণত অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে এই গাছের চারা রোপণ উপযোগী। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে এই গাছে ফল ধরে। যা পরবর্তীতে এক মাসের মধ্যে পাকতে শুরু করে। তুঁতফল প্রথম অবস্থায় সবুজ, পরে হালকা গোলাপি, লাল এবং সম্পূর্ণ পাকলে কালচে লাল রঙ ধারণ করে। তুঁতফল বা মালবেরি ফলের আদিবাস চীনে। তবে ভারত, বাংলাদেশসহ এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে তুঁতফলের চাষ হয়ে থাকে। যা দিয়ে বিভিন্ন প্রকার জুস ও জেলি তৈরি করা হয়।

১৯৮০ সালের পরে কোনো ধরনের বেসরকারি সংস্থাকে নিবন্ধন পেতে হলে সর্বপ্রথম শর্ত ছিল তুঁতগাছ রোপণ করতে হবে। মূলত, রেশমকে প্রাধান্য দিতেই তৎকালীন সরকারের এই পদক্ষেপ ছিল। এই নিয়মটি ছিল বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত। কিন্তু এখন আর এই শর্ত নেই। তাই গ্রামের রাস্তাঘাটে এ গাছ আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। ফলে দেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই ফলের গাছ।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০২৩
এসআইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।