ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

রোগীদের জায়গা নেই, হাসপাতাল ভবনে ব্যাংকের শাখা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০২৩
রোগীদের জায়গা নেই, হাসপাতাল ভবনে ব্যাংকের শাখা

বরিশাল: বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে প্রতিনিয়ত বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। জনবল ও স্থান সংকটে রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে।

 

আর বেড সংকটে বাড়তি রোগীদের নিয়মিত ওয়ার্ডের ভেতরে ও বারান্দার ফ্লোরেও থাকতে হচ্ছে।  

এমন পরিস্থিতিতেও হাসপাতালের পুরাতন ভবনের একটি সমিতির  অফিস এবং নতুন ভবনে বেসরকারি একটি ব্যাংকের শাখা অফিস বসানোর অনুমতি দিয়েছেন পরিচালক।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা চলছে।  রোগী ও তাদের স্বজনসহ নাগরিক সমাজ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

 হাসপাতালের নতুন ও পুরাতন ভবন ঘুরে দেখা গেছে, মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, অর্থোপেডিক্স, শিশু ও শিশু সার্জারিসহ যে সব ওয়ার্ডে রোগীর চাপ রয়েছে, সেসব ওয়ার্ডে পা ফেলার জায়গা থাকছে না। বিশেষ করে ভর্তির দিনগুলোতে ওই সকল ওয়ার্ডের রোগীদের রুমগুলোর নির্ধারিত বেডের বাইরে ও ফ্লোরে, বারান্দা, বাথরুমের সামনেসহ বিভিন্ন জায়গায় ফোম ও চাদর বিছিয়ে থাকতে হচ্ছে।  

আর এভাবে থাকা রোগীদের ভিড়ের মাঝেই কোনোভাবে গিয়ে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।

আর এ দুর্ভোগের মধ্যেই হাসপাতালের পুরাতন ভবনের দোতলায় একটি সমিতিকে আর নতুন ভবনের নিচতলার দক্ষিণপাশে একটি বেসরকারি ব্যাংককে (মেঘনা ব্যাংক) তাদের কার্যক্রম চালাতে জায়গা দেওয়া হয়েছে।  

যদিও সমিতির জন্য বরাদ্দ জায়গাটি আগে থেকেই খালি পড়েছিল, তবে ব্যাংকের শাখার জায়গাটি করোনা ওয়ার্ডের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে ব্যবহৃত হতো।

হাসপাতালের প্রশাসনিক শাখা সূত্রে জানা গেছে, মেডিকেল কলেজ, নার্সিং শিক্ষার্থীসহ রোগীদের কথা বিবেচনা করে কয়েক বছর পূর্বে মোটরসাইকেল স্ট্যান্ডের পাশে একটি বেসরকারি (ডাচ বাংলা ব্যাংক) ব্যাংককে আলাদা ভবনে বুথ করার অনুমতি দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে এটি হাসপাতাল ভবনের বাইরে হওয়ায় কোনো ধরনের সমস্যা হচ্ছিল না।  

এরপর বর্তমান পরিচালক আসার পর হাসপাতালের নতুন ভবনের নিচ তলায় অপর একটি বেসরকারি ব্যাংক (মেঘনা ব্যাংক) কে কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেন। তারা বর্তমানে বিশাল জায়গা জুড়ে শাখা খুলে নিয়েছেন।  অথচ সরকারি হাসপাতালের কোনো চিকিৎসক, নার্স কিংবা স্টাফদের বেতন এই ব্যাংকের মাধ্যমে আসে না।

অভিযোগ উঠেছে, হাসপাতালের পরিচালক ডাক্তার সাইফুল ইসলামের ভাই মনির হোসেনকে চাকরি দেওয়াসহ তা স্থায়ী করণে ব্যাংকটির শাখার জন্য হাসপাতালের মধ্যেই তিনমাস পূর্বে ভাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।  

যদিও সম্প্রতি বিষয়টি প্রকাশ পেলে ব্যাংকের হাসপাতাল শাখায় স্কেল অফিসার পদে কাজ করা মনির হোসেন ঝালকাঠির রাজাপুর শাখায় বদলি হন।  

তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে মনির হোসেন সাংবাদিকদের জানান, সবকিছুই কর্তৃপক্ষের ডিসিশনের বিষয়।

এদিকে ব্যাংকের শাখাটি চালু  চুক্তি ভিত্তিতে নেওয়া শতাধিক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন এই ব্যাংকে দেওয়ার ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়েছে।  

চাকরি খোয়ার ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে চুক্তি ভিত্তিক একাধিক স্টাফ জানান, আগে থেকে তাদের অনেকের বিভিন্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকলেও বেতন গ্রহণের জন্য হাসপাতালের নতুন ভবনের নিচতলার বেসরকারি ব্যাংকে (মেঘনা ব্যাংক) অ্যাকাউন্ট খোলার নির্দেশনা দেওয়া হয়। বর্তমানে তাদের বেতন সেই ব্যাংকেই হচ্ছে।

হাসপাতালের নতুন ভবনের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া রোগীর স্বজন কাইয়ুম বলেন, আমার বাবা অসুস্থ হয়ে করিডরের ফ্লোরে নোংরার মধ্যে পড়ে রয়েছেন। আর হাসপাতালের এই ভবনের জায়গা আটকেই ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।  রোগীর সেবা নিশ্চিত না করে ব্যাংকের সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। আর বান্দরোড থেকে হাসপাতালের এই ভবনটির দিকে তাকালে সাইনবোর্ড দেখে তো মনেই হয় না এটা কোনো হাসপাতাল, মনে হয় ব্যাংকের নিজস্ব ভবন। অনেকে তো এটা দেখে ভোগান্তিতেও পড়ছেন।

হাসপাতালের এই ভবনেই চালু হওয়া ডেঙ্গু ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজন মুক্তা জানান, দিন দিন রোগীর চাপ বাড়ছে। আর চাপ বাড়ায় এখন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের জন্য বেড খালি থাকছে না। ফলে বাধ্য হয়ে বারান্দায় গিয়ে ফ্লোরে জায়গা নিতে হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকটি না হলে ওখানে কিছু রোগীর জায়গা হতো, বাথরুমের সামনে কিংবা বারান্দায় তো থাকতে হতো না।

তিনি বলেন, আমার তো মনে হয়ে একটি ব্যাংকের কার্যক্রম চলমান থাকতে আরেকটি ব্যাংকের কার্যক্রম দেওয়াটা নেহাত কোনো ফায়দা লুটার চেষ্টা। এখানে রোগীদের সেবা না দিয়ে ব্যাংকিং সেবা দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে সম্প্রতি ওই ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে হাসপাতালের চিকিৎসার মান উন্নয়ন এবং অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে অবস্থান ও স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি পালন করেছেন বরিশাল নগর উন্নয়ন ফোরাম।  
নাগরিক ফোরামের নেতরা বলছেন, যেখানে রোগীরা জায়গা পায় না, সেখানে ব্যাংক করে জায়গা সংকুচিত করার কোনো মানে নেই।

বরিশাল নগর উন্নয়ন ফোরামের সমন্বয়কারী কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু সাংবাদিকদের বলেন, বেডের জায়গা নষ্ট করে, এ ধরনের সার্ভিসের জন্য ফ্লোর তাদের দিয়ে দেবে, এটা আশা করা যায় না।

এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম বলেন, গোটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মধ্যে কোনো ব্যাংক নেই। আমাদের টাকা আনা নেওয়ার একটা সমস্যা ও রিস্ক থেকে যায়। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দাবি ছিল, আর তার প্রেক্ষিতেই ওই ভবনের মাঝে জায়গা নির্ধারণ করা ছিল। সেখানেই ব্যাংকটি দেওয়া হয়েছে।

তবে সরকারি যে সব ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারের এ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক লেনদেন হয়, তাদের শাখা কেন আনা হলো না এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেককে বিষয়টি বলা হয়েছিল, কেউ আগ্রহ দেখায়নি। তাই যে আগ্রহ দেখিয়েছে তাকে নিয়ম মেনে অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

যদিও উচ্চহারে ভাড়া দিয়ে অনেক ব্যাংকই বরিশাল নগরের ব্যক্তি মালিকানা ভবনগুলোতে তাদের শাখা খুলছে। সেখানে মাসিক মাত্র ২০ হাজার টাকা ভাড়া চুক্তিতে আগ্রহ কেন অন্য ব্যাংকগুলো দেখায়নি সে বিষয়ে জানা যায়নি।

আর ব্যাংকিং সেবাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই এখানে শাখাটি খোলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেঘনা ব্যাংকের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ শাখার ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম।

উল্লেখ্য, ১ হাজার শয্যার বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটিতে গড়ে প্রতিদিন রোগী থাকে ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার।  আর প্রতিদিন বহির্বিভাগে সেবা নেন ৩ হাজার রোগী।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪০ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০২৩
এমএস/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।