১৪ জুন, আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য `এভরি ব্লাড ডোনার ইজ এ হিরো` অর্থাৎ প্রত্যেক রক্তদাতাই একজন নায়ক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৮ সালের তথ্যে বলা হয়, পৃথিবীর ১৫৯টি দেশে আট হাজার রক্তকেন্দ্র রয়েছে। উন্নত দেশের রক্তকেন্দ্র থেকে গড়ে প্রতিবছর ৩০ হাজার ব্যাগ রক্ত সংগৃহিত হয়। সেখানে উন্নয়নশীল দেশে আট ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ গড়ে তিন হাজার সাতশ ব্যাগ সংগৃহিত হয়। ১০৬টি দেশে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন নীতিমালা থাকলেও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে মাত্র ১৩ ভাগ দেশে এ নীতিমালা বিদ্যমান। সমগ্র পৃথিবী থেকে প্রায় ৯ কোটি ২০ লাখ ব্যাগ রক্ত প্রতিবছর সংগ্রহ করা হয় এবং এর মধ্যে অর্ধেকই উন্নত দেশ থেকে।
একটি দেশের তিন ভাগ মানুষও যদি নিয়মিত রক্তদান করে তবে সে দেশের রক্তচাহিদা পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দুর্ঘটনাপ্রবণ দেশে কখনও কখনও তার চেয়ে বেশি পরিমাণ রক্তের দরকার হয়। মূলত সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত মানুষের জন্য বেশি পরিমাণ রক্ত প্রয়োজন। এছাড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের অপারেশন করার জন্যও রক্তের দরকার। থালাসেমিয়া রোগে আক্রান্তদের নিয়মিতই রক্ত নিতে হয়।
পৃথিবীর ৬২টি দেশে বর্তমান প্রয়োজনীয় রক্ত স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের কাছ থেকে সংগৃহিত হয়। অবশ্য যার অধিকাংশই উন্নত দেশ। এক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রয়োজনীয় রক্তের জন্য স্বেচ্ছা রক্তাদাতাদের পাশাপাশি পারিবারিক সদস্যদের উপর নির্ভর করতে হয়, যাদের অধিকাংশই নিয়মিত ও স্বেচ্ছা রক্তদাতা নয়। বাংলাদেশে মূলত তরুণরাই স্বেচ্ছায় রক্তদান করে। শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরাই প্রায় ৭০ ভাগ রক্ত দান করে।
রক্তদাতারা প্রধানত তিন রকম:
১. স্বেচ্ছা রক্তদাতা: স্বেচ্ছা রক্তাদাতা তারা, যারা কোনরূপ সুবিধা (আর্থিক বা অন্যান্য) ছাড়াই কারও প্রয়োজনে রক্তদান করে। উন্নত দেশগুলোতে প্রায় শতভাগ রক্তই স্বেচ্ছা রক্তাদাতাদের কাছ থেকে সংগৃহিত হয়। মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ৭৩ ভাগ রক্ত এবং বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায় ৬৪ ভাগ রক্ত স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের কাছ থেকে সংগৃহিত হয়।
২. পারিবারিক রক্তদাতা: যারা সাধারণত নিয়মিত ও স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন না, কিন্তু পারিবারিক কোনো সদস্যের প্রয়োজনে রক্তদান করেন তাদের বলা হয় পারিবারিক রক্তদাতা। উন্নত দেশে পারিবারিক রক্তদাতা ১ ভাগেরও কম হলেও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে এ হার ২৫ ভাগের বেশি। আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ হার ৩০ ভাগের মতো।
৩. রক্ত বিক্রেতা: উন্নত বা উচ্চ আয়ের দেশে পেশাদার কোনো রক্তদাতা নেই বললেই চলে। কারণ তাদের প্রয়োজনীয় রক্ত স্বেচ্ছ রক্তদাতাদের কাছ থেকেই সংগৃহিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রক্ত বিক্রি হয়। বাংলাদেশে রক্ত বিক্রেতার সংখ্যা অনেক। তবে পেশাদার রক্তদাতাদের অনেকেই মাদকসেবী। সাধারণত বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠা ব্যঙের ছাতার মতো ক্লিনিকে পেশাদার রক্তদাতারা রক্ত বিক্রি করে। অথচ খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে ওইসব ক্লিনিকের রক্ত সংগ্রহ করার অনুমতি নেই। কারণ রক্ত সংগ্রহ করার জন্য বেশ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। এসব ছোট ছোট ক্লিনিকে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রক্ত সংগ্রহ করা হয়। ছোট ছোট এসব ক্লিনিক মাদকসেবীদের কাছ থেকে জেনেশুনেই রক্ত সংগ্রহের পর তা উচ্চমূল্যে বিক্রি করে।
প্রসঙ্গত, একটু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা যেতে পারে। আমার রক্তের গ্রুপ `ও নেগেটিভ`। তুলনামূলক কম মানুষের শরীরেই নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত। সর্বশেষ ২৪ এপ্রিল রক্তদানসহ একজন স্বেচ্ছা রক্তদাতা হিসেবে এ পর্যন্ত ৩১ বার রক্তদান করেছি।
প্রথমবার, রেডক্রিসেন্টের ক্যাম্পে বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় ১৯৯৮ সালের সম্ভবত নভেম্বরে রক্ত দেই। তখন আমি স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র ও নবীণ সাংবাদিক। তারচেয়েও বড় পরিচয়, উদীচীর সঙ্গে যুক্ত একজন নিবেদিতপ্রাণ সংস্কৃতি কর্মী ও মানবতার সেবায় তৎপর তরুণ।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঁধন, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি ও কোয়ান্টাম ইত্যাদি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, কখনও কখনও সরাসরি রোগীর নিকটজনদের আহ্বানে গড়ে প্রতি চার মাস পর পর রক্ত দিয়ে যাচ্ছি।
তবে যাদের রক্ত দিয়েছি তাদের কাউকেই ব্যক্তিগতভাবে আমি চিনি না, জানি না। কিন্তু মানুষের প্রয়োজনে রক্ত দিতে পেরে তৃপ্তি বোধ করেছি। আমার রক্ত দিয়ে যদি কোনো মানুষ সুস্থ্য হতে পারে; তবে মানুষ হিসেবে সেখানেই জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাই।
নায়ক হওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, মানবতার সেবায় গত ১৩ বছর ধরে নিয়মিতভাবে স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়ে আসছি। তারপরও ভাবতে ভালো লাগছে, এ বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমার মতো সারা পৃথিবীর স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের নায়ক হিসেবে অভিহিত করেছে। আমি একজন গর্বিত স্বেচ্ছা রক্তদাতা, আমি একজন নায়ক। আপনি?
বিশেষত, তরুণ প্রজন্মের কাছে আমার আহ্বান- মানবতার সেবায় রক্ত দিয়ে আপনিও নায়ক হতে পারেন। মনে রাখা দরকার, প্রতি তিনমাস পর পর একজন সুস্থ্য মানুষের রক্তের সেল পরিবর্তন হয়। তাই চারমাস পর পর যে কোনো সুস্থ্য মানুষ রক্ত দিতে পারে। বাংলাদেশের তরুণদের অর্ধেকও যদি নিয়মিত রক্ত দেয় তবে বাংলাদেশে কোনো রোগীকেই রক্ত স্বল্পতাজনিত কারণে মরতে হবে না। আসুন, আমরা সবাই রক্ত দেই; মহানুভবতা, মানবিকতা, মনুষত্বের নায়ক হই।
আমিনুল ইসলাম সুজন, সাংবাদিক
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ০৫৪৩ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১২
সম্পাদনা: ওবায়দুল্লাহ সনি, নিউজরুম এডিটর