ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল

ধারণক্ষমতার ৫ গুণ রোগী, নেই পর্যাপ্ত শয্যা-চিকিৎসক 

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৩
ধারণক্ষমতার ৫ গুণ রোগী, নেই পর্যাপ্ত শয্যা-চিকিৎসক 

লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে শয্যার সংখ্যা মাত্র ১২টি। কিন্তু মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুর পর্যন্ত ওই ওয়ার্ডে শিশু রোগী ভর্তি ছিল ১০১ জন।

একেকটি বেডে তিন থেকে চারজন শিশু রোগীকে রাখা হয়েছে। আবার কোনো শিশু রোগীকে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এসব শিশুদের সঙ্গে স্বজন রয়েছে এক বা দুইজন করে। রোগী এবং তাদের স্বজনদের চাপে শিশু ওয়ার্ডে 'ঘিঞ্জি' পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে আছে।  

শুধু শিশু ওয়ার্ড নয়- পুরুষ ও মহিলা সার্জারি ওয়ার্ড, গাইনি ওয়ার্ডসহ পুরো হাসপাতাল রোগীতে ঠাসা। হাসপাতালের বারান্দা, প্রতিটি ওয়ার্ডের মেঝে, করিডর, বাথরুমের সামনে, চলাচলের পথে এমনকি লাশ ঘরের সামনেও বিছানা পেতে রোগীদের চিকিৎসা দিতে দেখা গেছে। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসা হাজারের বেশি রোগীদের ভিড়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। আর রোগীরাও অসন্তুষ্ট সেবা নিয়ে।  

মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শিশু ওয়ার্ডের প্রতিটি শয্যাতে তিন থেকে চারজন করে শিশু রোগী ভর্তি আছে। ওইসব শয্যাতে রোগীর সঙ্গে চার থেকে পাঁচজন করে স্বজন তাদের সন্তানদের কোলে নিয়ে কোনোমতে বসে আছেন। এসব কারণে ওই ওয়ার্ডের সেবিকাদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে সেবা দিতে।

মিশু আক্তার নামে শিশু রোগীর এক স্বজন বলেন, আমাদের রোগীকে যে শয্যা দেওয়া হয়েছে, একই শয্যায় আরও তিনজন শিশু ভর্তি আছে। এ তিন শিশুর সঙ্গে আমরা চারজন স্বজন আছি। শয্যাতে ভালোভাবে বসার কোনো সুযোগও নেই। কোনোমতে আমরা বসে আছি।  

চিকিৎসা সেবার বিষয়ে তিনি বলেন, সকালে চিকিৎসক রোগীদের দেখে যান, পুরোটা দিন নার্সদের (সেবিকা) ওপর ভরসা করে থাকতে হয়। কিন্তু এখানে নার্সেরও সংকট রয়েছে।  

ওই ওয়ার্ডটিতে শিশুদের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত নার্সরাও জানিয়েছেন, রোগীর চাপে তাদের দম ফেলানোর ফুরসত নেই। রোগীদের স্বজনরাও তাদের ডাকাডাকি করতে থাকেন।  

দেখা গেছে, সেবা দিতে দেরি হলে কোনো রোগীর স্বজন বিরক্তি প্রকাশ করেন, আবার কেউ ক্ষোভও প্রকাশ করেন।  

দায়িত্বরত সিনিয়র স্টাফ নার্স শিবানী মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, ১২ রোগীর বিপরীতে ১০১ জন রোগী ভর্তি আছে। সারাদিনে আরও রোগী ভর্তি হবে। কাকে রেখে কাকে চিকিৎসা দেব? প্রত্যেক রোগীর স্বজনরা চাচ্ছে তাদের রোগীকে আগে চিকিৎসা দিতে। কিন্তু সকল রোগীকেই আমাদের সেবা দিতে হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে, তারপরেও আমরা চেষ্টা করছি।

শিশু ওয়ার্ডের পাশেই গাইনি ওয়ার্ড। সদ্য প্রসূতি নারীরাও এ ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালে গাইনি চিকিৎসক থাকলেও নেই গাইনি কনসালটেন্ট। ফলে কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা।  

সরেজমিনে দেখা গেছে, ১২টি গাইনি শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি রয়েছে ৩৪ জন। এদের চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দায়িত্বরত চিকিৎসক ও নার্সদের।  

জোসনা খাতুন নামে এক রোগী বলেন, বেড না থাকায় মেঝেতে বসে চিকিৎসা সেবা নিতে হচ্ছে।  

গাইনি চিকিৎসক জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ওয়ার্ডে ধারণক্ষমতার চেয়েও রোগীর সংখ্যা বেশি। আবার প্রতিদিন আউটডোরের রোগী দেখতে হয়। সব মিলিয়ে আমাদের হিমশিম অবস্থা। চেষ্টা করে যাচ্ছি সাধ্যমতো রোগীদের সেবা দিতে।  

ভয়াবহ অবস্থা দেখা গেছে হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার সার্জারি ওয়ার্ডে। বিভিন্ন রোগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সঙ্গে ডেঙ্গু রোগীরাও একই সঙ্গে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ওই ওয়ার্ডের আনাচে-কানাচে রোগীদের শয্যা বিছানো হয়েছে। চলাচলের পথে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে রোগীদের।  

পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিতে আসা আবু ছায়েদ, নুর আলম, মহিউদ্দিন, বাবলু ও রোগীর স্বজন রোজিনার সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। সেবায় কিছুটা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। তারা বলেন, বেড নেই তাই মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।  অভিযোগ করে তারা বলেন, রোগীদের প্রয়োজনের সময় সেবিকাদের দেখা পাওয়া যায় না।  

লাশ ঘরের সামনের মেঝেতে থাকা সিরাজ নামে আরেক রোগীর স্বজন কোহিনুর বলেন, এখানে ফ্যান নেই। ঘিঞ্জি পরিবেশ, অতিরিক্ত গরম। রোগীর গরম সহ্য হচ্ছে না। তাই সার্বক্ষণিক হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে হচ্ছে। রোগীকে নিয়ে এ পরিবেশে আমরা খুব কষ্টে আছি।  

২য় তলার সার্জারি ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুমা আক্তার বলেন, পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ডে শয্যা ৩০টি। কিন্তু রোগী ভর্তি আছে ১৪৫ জন। নিয়মের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি রোগী আছে এ ওয়ার্ডে। আমরা যথাসাধ্য সেবা দেওয়ার চেষ্টা করতেছি। বেশি রোগী, তাই হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের।  

হাসপাতালে ধারণক্ষমতার তুলনায় ৫ গুণ রোগী: 
লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালটি ১০০ শয্যার হাসপাতাল। এর আগে এটি ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল ছিল। তবে ২০০৭ সালে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যাতে হাসপাতালটিকে উন্নীত করা হলেও বাড়েনি চিকিৎসক এবং জনবলের পরিমাণ। প্রায় ১৮ বছরেও জনবল অনুমোদন পায়নি। সেই ৫০ শয্যার চিকিৎসক ও জনবল দিয়েই চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। নামে ১০০ শয্যার হলেও রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় পাঁচশর উপরে। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ১০০ শয্যার হাসপাতালটিতে রোগী ভর্তি ছিল ৪৩৬ জন।  

জনবল সংকট চরমে: 
৫০ শয্যার বিপরীতে হাসপাতালে জনবলের সংখ্যা ১৪৮ জন হলেও এখন আছে ১০৫ জন। হাসপাতালটিতে অনুমোদিত চিকিৎসকের পদ ২১ টি, কর্মরত আছে ১৭ জন। চর্ম, গাইনি কনসালটেন্ট, নাক-কান-গলা রোগের চিকিৎসক নেই এখানে। ৬৫ জন নার্সের বিপরীতে কর্মরত আছে মাত্র ২৫ জন। আর বিভিন্ন পদে ৩২টি জনবলের বিপরীতে ২২ জন রয়েছে। সব মিলিয়ে ৫০ শয্যা হাসপাতালের জনবলই নেই, সেখানে প্রতিদিন পাঁচ শতাধিক রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে জনবল সংকটে থাকা সদর হাসপাতালটি।  
আউট ডোরে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ক্ষোভ: 
হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের পাশাপাশি প্রতিদিন আউট ডোরে হাজারের ওপর রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। রোগীর চাপের তুলনায় চিকিৎসক এবং জনবল কম থাকায় সেবা ব্যাহত হচ্ছে। হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীরাও ক্ষুব্ধ সেবা নিয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে হতাশ সেবাপ্রার্থীরা।  

আউট ডোরে সেবা নিতে আসা মাসুদ, রুহুল আমিন, বাবুল মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, হাসপাতালে প্রথমে এসে টিকিট কাটতে হয়। টিকিট কাটতে হলে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাইনে দাঁড়াতে হয়। এরপর চিকিৎসকের কক্ষের সামনে অপেক্ষায় থাকতে হয় কয়েক ঘণ্টা৷ অন্য চিকিৎসকের কাছে রেফার্ড করলে সেখানেও গিয়ে লাইন ধরে অপেক্ষায় থাকতে হয়। আবার রোগ নির্ণয়ে টেস্ট করাতে হলে সেখানে টাকা জমা দেওয়ার লাইনেও থাকতে হয় কয়েক ঘণ্টা। টেস্ট স্যাম্পলও দিতে হয় দীর্ঘসময় লাইনে অপেক্ষায় থেকে।  

তারা বলেন, এখানে জনবল কম। সে কারণে শত শত রোগীকে ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। চিকিৎসক এবং জনবল বাড়ানো হলে রোগীদের ভোগান্তি কমে আসবে।  

মহি উদ্দিন নামে একজন বলেন, আমি আমার দুই সন্তান জোবায়ের (৬) ও জাহিদকে (৫) নিয়ে হাসপাতালের আউট ডোরে চিকিৎসা নিতে আসি। দুই সন্তানের জ্বর। তাদের নিয়ে দীর্ঘ সময় তিনটি লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। হাসপাতালের এমন শোচনীয় পরিবেশে আমার সন্তানরা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেবা দেওয়ার সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করাসহ হাসপাতালের পরিবেশ উন্নয়নের দাবি জানাই।  

স্থানীয় সাংবাদিক আবদুল মাজেদ শফিক বলেন, হাসপাতালে এলে অনেক সময় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া যায় না। ফলে বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা ঢাকায় যেতে হয়। এতে জেলার বাসিন্দারা সদর হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।  

জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) আনোয়ার হোসেন বলেন, হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি। শয্যার চেয়ে পাঁচ গুণ রোগী ভর্তি আছে। মেঝেতে শয্যা বিছিয়ে তাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। ভর্তিকৃত রোগীর পাশাপাশি আউট ডোরে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার থেকে ১২শ রোগী সেবা নিতে আসে। আমাদের চিকিৎসক এবং জনবল হলো ৫০ শয্যার। তাও নির্দিষ্ট পদের থেকে কম জনবল আছে। এদের দিয়েই এতো পরিমাণ রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছি। এতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপরও আপ্রাণ চেষ্টা করছি, সেবা দিতে। আড়াইশ শয্যার হাসপাতালের কাজ শুরু হলে তখন ওই পরিমাণ শয্যার বিপরীতে জনবল দেওয়া হবে।  

নির্মাণাধীন আড়াইশ শয্যা হাসপাতালের কাজ শেষ হয়নি ৫ বছরেও: 
২০১৭ সালে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালকে আড়াইশ শয্যায় উন্নীত করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর শুরু হয় হাসপাতালটির নির্মাণ কাজ। গণপূর্তের মাধ্যমে ২০১৮ সালের দিকে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে রুপালী জিএম অ্যাণ্ড সন্স কনস্ট্রাকশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অদ্যবদি কাজ শেষ হয়নি।  

এ বিষয়ে জানতে লক্ষ্মীপুর গণপূর্ত অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী লাবণ্য বড়ুয়াকে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি। তবে সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের জুনের দিকে হাসপাতালের ভবনটি তাদের বুঝিয়ে দেওয়ার কথা রয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৩
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।