ঢাকা, শনিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

২০ বছরেও গড়ে উঠেনি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা

রেজাউল করিম রাজা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০২৩
২০ বছরেও গড়ে উঠেনি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা

ঢাকা: ২০ বছরের অধিক সময়েও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ, আক্রান্ত ও মৃত্যু কমাতে আমাদের দেশে তেমন কোনো সক্ষমতা গড়ে উঠেনি, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

পাশাপাশি একদিকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের যথাযথ উদ্যোগের অভাব, আরেকদিকে ডেঙ্গু চিকিৎসায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গৃহীত পদক্ষেপের ঘাটটিতে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে বলেও সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ।

জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস ডেঙ্গু রোগের মৌসুম হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে সারা বছর জুড়েই ডেঙ্গুরোগের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমের আগেই হানা দেওয়া ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছে না। চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা দেশের ইতিহাসে অতীতের সব বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।

১৯৬৪ সালে ঢাকা জ্বর বা ঢাকা ফিভার নামের অজ্ঞাত এক অসুখের মহামারি হয়ে দেখা দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সিরোটাইপিং হিসেবে পরিচিত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ঢাকা জ্বর আসলে ছিল ডেঙ্গু জ্বর। এরপর ২০০০ সাল থেকে দেশে ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণ শুরু হয়।

বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটলেও যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়ার ফলে ডেঙ্গু ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ইতোপূর্বে ডেঙ্গু রাজধানী কেন্দ্রিক থাকলেও বর্তমানে তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থা খুব দ্রুত অবনতি হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে।  

অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহেও ডেঙ্গুতে প্রতিদিন প্রায় গড়ে দুই হাজারের কমবেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এই সময়ে এতো ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী আমাদের জন্য কতটা উদ্বেগের জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান সময়ে ডেঙ্গুতে যে পরিমাণ রোগী আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে, তা থেকেই ডেঙ্গু পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝা যায়।

তিনি বলেন, ২০০০ সাল থেকে যত মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গিয়েছে, সব যোগ করলেও চলতি বছরের যোগফল তারচেয়ে বেশি হবে। জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় এটা খুব বড় একটা বিষয়। কিন্তু এখান থেকে আমাদের যে শিক্ষাটা নেওয়া উচিত ছিল, সেটা নেওয়া হচ্ছে না। ডেঙ্গু কোনো বিষয় না, এটা প্রমাণের একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাই ডেঙ্গু এ বছরও নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না এবং ভবিষ্যতেও নিয়ন্ত্রণ হবে বলে মনে হচ্ছে না। যেহেতু আমরা ডেঙ্গু থেকে কোনো শিক্ষা নিচ্ছি না, তাই সামনের দিনগুলোয়ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা কম। এটা একটা খারাপ দিক।

এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ডেঙ্গু বিষয়টাকে যদি অত্যন্ত সিরিয়াসলি বলে নেওয়া হতো তাহলে হয়তো বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেত। যেমন আমরা বলছিলাম, জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে। ডেঙ্গুতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলে অনেক বিষয় যুক্ত হত। যেমন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কীটতত্ত্ববিদ এবং কীটতাত্ত্বিক মেশিনপত্র, কীটতাত্ত্বিক ল্যাবরেটরি যুক্ত হতে পারত, কিন্তু কোনটাই হলো না। এর অর্থ হল, আগামী বছর আবার যখন ডেঙ্গুর ভয়াবহতা শুরু হবে, তখন আমাদেরকে শূন্য থেকেই শুরু করতে হবে। তার মানে ডেঙ্গু বিষয়ে ২০ বছরেও আমাদের কোনো সক্ষমতা তৈরি হলো না এবং ভবিষ্যতেও হচ্ছে না।

ডেঙ্গু বিষয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) বর্তমান উপদেষ্টা ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোস্তাক হোসেন বলেন, বৃষ্টি কমে যাওয়ার মাসখানেক পর হয়তো ডেঙ্গু কমে যাবে। কিন্তু ডেঙ্গু এখন থেকে মনে হচ্ছে সারা বছরই থাকবে। কারণ আমাদের দেশে শীতকালের তাপমাত্রা এত নিচে নামে না যে, শীতকালে মশার ডিম পাড়া এবং ডিম থেকে মশার জন্ম নেওয়াটা বাধাগ্রস্ত হবে। শীতকালে বৃষ্টি না হলেও পরিষ্কার পাত্রে পানি জমে থাকার নানান উৎস আমাদের রয়েছে।

অক্টোবর মাসেও ডেঙ্গুতে এমন প্রাণহানি কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাংগঠনিক দুর্বলতা। আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় ডেঙ্গু চিকিৎসায় তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। মাধ্যমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ডেঙ্গু রোগীদের রাখার তেমন কোনো ব্যবস্থা নাই। ডেঙ্গু বিষয়ে ব্যবস্থা রয়েছে টারশিয়ারি লেভেলের হাসপাতালগুলোয়। টারশিয়ারি লেভেলের হাসপাতালগুলোয় ভিড়ের ফলে একদিকে রোগী শনাক্ত হচ্ছে দেরিতে। ঘরের কাছেই ডেঙ্গু সনাক্তকরণের ব্যবস্থা থাকলে ডেঙ্গু আক্রান্তের শুরুতেই জানা যেত। এখন কারো জ্বর হলে সে অপেক্ষা করে দেখি কি হয়, তারপর জ্বর কমে গেলে সে কাজকর্ম শুরু করে দেয়।

তিনি বলেন, হঠাৎ করেই সে অসুস্থ হয়ে গেলে আবার সোজা টারশিয়ারি লেভেলের হাসপাতালে চলে আসে। আবার যাদের ডেঙ্গুতে গুরুতর অবস্থা হওয়ার আগেই হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত, যেমন বয়স্ক মানুষ, শিশু এবং গর্ভবতী নারী, তাদেরও ভিড়ের কারণে হাসপাতালে রাখার জায়গা হচ্ছে না। তাদেরকে সেকেন্ডারি হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার। যেমন গ্রামগঞ্জে রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কিন্তু শহরে তেমন মধ্যবর্তী কোনো হাসপাতাল নেই। ফলে সবাই ভিড় করে টারশিয়ারি লেভেলের হাসপাতালগুলোতে, কেউ হয়তো জায়গা পায় আবার কেউ পায় না। ফলে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে।

তিনি আরও বলেন, টারশিয়ারি লেভেলের হাসপাতালগুলোয়ও দেখা যাচ্ছে ফ্লোরে রেখে রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ফ্লোরে রোগী রেখে চিকিৎসা দেওয়া, তারপর আবার আমরা সবকিছু করে ফেলেছির মত ভাব দেখানো কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সুতরাং চিকিৎসা ব্যবস্থার সাংগঠনিক যে দুর্বলতা সেটা সংশোধন না করে শুধু ডেঙ্গু নয়, যেকোনো পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সিতে আমরা মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে পারব না। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা আমরা জানি। ডেঙ্গু রোগে মৃত্যুবরণ করার সংখ্যাও খুবই কম। সারা পৃথিবীতেই ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার আমাদের চেয়ে অনেক কম।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০২৩
আরকেআর/এসআইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।