ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২৬ জিলহজ ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

শিশুর হাতে মোবাইল ‘সর্বনাশের শুরু’

রেজাউল করিম রাজা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০২৩
শিশুর হাতে মোবাইল ‘সর্বনাশের শুরু’ ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: মোবাইল ফোনের কল্যাণে মানুষের যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেমন অভাবনীয় বিপ্লব ঘটেছে, ঠিক তেমনি কিছু বিড়ম্বনাও তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য স্মার্টফোন বেশ বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

মোবাইল ফোন মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।  

সাম্প্রতিক একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ শিশু স্কুলে ভর্তির আগেই (প্রি-স্কুল) স্মার্টফোনে আসক্ত, যার মধ্যে ২৯ শতাংশের মারাত্মকভাবে স্মার্টফোনের আসক্তি রয়েছে। বাবা-মা সন্তানদের সময় কম দেওয়ার কারণে ৮৫ শতাংশ শিশু স্মার্টফোন আসক্তিতে ভুগছে। খেলার মাঠের অভাবে ৫২ শতাংশ, খেলার সাথীর অভাবে ৪২ শতাংশ শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত হচ্ছে।

৭৯ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু কার্টুন দেখার জন্য, ৪৯ শতাংশ গেম খেলার জন্য, ৪৫ শতাংশ শিশু ভিডিও দেখা বা গান শোনার জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার করে। শুধু ১৪ শতাংশ শিশু পড়াশোনার জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার করে।

গবেষণায় নির্বাচিত ৪০০ শিশুর প্রত্যেকেই স্মার্টফোন ব্যবহার করে। যাদের মধ্যে ৯২ শতাংশ তাদের বাবা-মায়ের স্মার্টফোন ব্যবহার করে ও ৮ শতাংশ শিশুর ব্যবহারের জন্য পৃথক স্মার্টফোন আছে।

বাংলাদেশের শিশুরা প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন ঘণ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সুপারিশকৃত সর্বোচ্চ সময়ের থেকেও প্রায় তিন গুণ বেশি।

৭৩ শতাংশ মা তাদের বাচ্চাদের স্মার্টফোন হাতে তুলে দিয়ে ব্যস্ত রাখেন কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই নিজেদের কাজ করার জন্য। ৭০ শতাংশ মা তাদের বাচ্চাদের স্মার্টফোন দেন কারণ তাদের বাচ্চারা স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পছন্দ করে। ৬৭ শতাংশ মা তাদের সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য ও ৩১ শতাংশ মা শিশুকে ঘুম পাড়ানোর জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার করেন।

গবেষণায় দেখা যায়, যেসব বাবা-মা প্রতিদিন তিন ঘণ্টা বা তার বেশি সময় স্মার্টফোন ব্যবহার করেন তাদের সন্তানরা স্মার্টফোনে আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৯০ গুণেরও বেশি। পেশাজীবী মায়েদের বাচ্চারা অধিকহারে স্মার্টফোন আসক্তিতে ভুগছে, কেননা তারা তাদের সন্তানদের প্রয়োজন অনুসারে সময় দিতে পারছেন না।

স্মার্টফোনে আসক্ত শিশুরা আসক্ত নয়, এমন বাচ্চাদের তুলনায় মারাত্মক মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে। স্মার্টফোনে আসক্ত বাচ্চাদের শারীরিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিও কম নয়, যা স্মার্টফোনে আসক্ত নয় এমন বাচ্চাদের তুলনায় ২৩০ গুণ বেশি।

শিশুদের স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে একটা সময় এটা অভ্যাসে বা আসক্তিতে পরিণত হয়। অনেক দিন ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে শিশুদের কারও কারও শারীরিক ও মানসিক সমস্যাও দেখা দেয়।

শারীরিক সমস্যাগুলো হলো- ঘুমের অসুবিধা, পরিপূর্ণ ঘুম না হওয়া, পিঠ, কোমরে কিংবা মাথা ব্যথা, চোখ ব্যথা বা চোখের জ্যোতি কমে যাওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া, পুষ্টিহীনতা ইত্যাদি রয়েছে।

দীর্ঘ সময় মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন রকম মানসিক সমস্যাও দেখা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে- উদ্বিগ্নতা, অসততা, নিজেকে দোষী বোধ করা, অতিচঞ্চলতা ও হিংসাত্মক আচরণ করা। এসব শিশুরা সারাক্ষণ একা থাকতে ভালোবাসে। ফলে বাইরে যাওয়া, অন্যদের সঙ্গে মেশা, সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা ও সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলার প্রবণতাও কমে যায়।    

শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ নির্ভর করে পরিবেশ ও অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে। শিশুরা দেখে এবং অন্যদের সঙ্গে খেলতে খেলতে সব কিছু শেখে। এক থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে শিশুদের কথা বলা, হাঁটা-চলা ও স্বাভাবিক বুদ্ধির বিকাশ হয়। এ সময়ে শিশুর দীর্ঘসময় স্মার্টফোনে গেম খেলা, ভিডিও দেখা, গান শোনা, আবার স্বাভাবিক খেলাধুলা না করায় শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।    

পাশাপাশি শিশুরা স্মার্টফোনে ভিডিও দেখতে দেখতে খাবার খেলে সেই খাবার শিশুর বিকাশে পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখে না। যেকোনো খাবারের হজম প্রক্রিয়া শুরু হয় মুখের লালা থেকে। খাবার হজম হতে যেমন লালা প্রয়োজন, ঠিক তেমনি মুখে লালা আসার জন্য খাবারটা দেখতে হয়, খাবারে মনোযোগ দিতে হয়। যেমন টক জাতীয় খাবার দেখলেই মুখে লালা আসে। বাচ্চারা যখন ভিডিও দেখতে দেখতে খায়, সে যদি খাবারটা না দেখে তাহলে মুখে লালা আসে না। লালা না এলে হজম প্রক্রিয়ার কিছু অংশ অসমাপ্ত রয়ে যায়। ফলে যেসব বাচ্চারা মোবাইলে ভিডিও দেখতে দেখতে খায় তাদের হজমে সমস্যা হয়, এতে বাচ্চাদের অনেক সময় ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য হয়।    

শিশুর মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব সম্বন্ধে যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আবাসিক সার্জন ডা. আকতারুজ্জামানের কাছে অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে শিশুদের চোখের কী ধরনের ক্ষতি হয় জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, শিশুদের অতিরিক্ত মোবাইল ফোনের আসক্তির কারণে প্রথমেই তাদের ভিশন সমস্যা হয়। বর্তমান সময়ে অনেক শিশুরই অল্প বয়সে অনেক হাই পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করতে হচ্ছে। এমনও দেখা যাচ্ছে, একদম শুরুতেই শিশুদের দুই, তিন, চার, পাঁচ এমনকি ছয় পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করতে হচ্ছে। পাশাপাশি মোবাইলে আসক্ত হওয়ার ফলে শিশুদের চোখে রেটিনায় দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ক্ষতির পরিমাণ এখন হয়তো বোঝা যাবে না, কিন্তু বাচ্চার বয়স যখন ১০-১২ কিংবা ১৫ বছর বয়স হবে তখন তার চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

তিনি আরও বলেন, মোবাইল ফোন আসক্তির কারণে অনেক শিশুর চোখ টেরা (বাঁকা) হয়ে যায়। বাচ্চাদের যখন পাওয়ার যুক্ত চশমার প্রয়োজন হয় তখন তারা তা ব্যবহার করতে চায় না। আবার শিশুরা ঠিকঠাকভাবে চশমা ব্যবহার না করার ফলে চোখ টেরা বা বাঁকা হয়ে যায়। খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন এখন আমাদের দেশে বাঁকা চোখের শিশু অনেক বেশি, এর অন্যতম প্রধান কারণ মোবাইল আসক্তি।

শিশুদের জন্য বিশেষায়িত সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ১৫ বছর পর্যন্ত শিশু-কিশোরদের জন্য মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ। ১৫ বছর পর্যন্ত শিশুদের মোবাইলের কাছেই যাওয়া যাবে না। গ্রোয়িং ব্রেনের ওপর মোবাইলের ইলেকট্রিক ম্যাগনেটিক ওয়েব মারাত্মক ক্ষতি করে। এতে শিশুদের কথা না বলা এমনকি স্পিচ ডিলে (দেরিতে কথা বলা) সমস্যা, শিশুদের অন্যান্যদের সঙ্গে কমিউনিকেশনের সমস্যা দেখা দেয়। মানসিক সমস্যা এমনকি অনেক সময় শিশুরা অটিস্টিকও হয়ে যায়। মোবাইলের রেডিয়েশন থেকে শিশুদের অনেক ক্ষতি হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, মোবাইল থেকে বাচ্চাদের একেবারে দূরে রাখতে হবে। এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। এখন আমরা অনেক শিশু রোগী পাচ্ছি যাদের স্পিচ নেই, কেউ সামান্য শুধু মা-বাবা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারে না। অন্যদের সঙ্গে ইন্টারেকশন করে না। মোবাইল ফোন ব্যবহারের কারণেই এটা হচ্ছে কি না সেই বিষয়ে আরও আমাদের অনেক গবেষণা করা প্রয়োজন। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে বাচ্চাদের জন্য মোবাইল একটি বড় সমস্যা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) শিশু নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু এ বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে মোবাইল ফোনের ব্যবহার অনেকাংশেই বেশি। গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলের শিশুরা বেশি মোবাইল ব্যবহার করে। দেখা যাচ্ছে, এক-দুই বছরের বাচ্চারা বেশি মোবাইল ফোনে আসক্ত হচ্ছে। এক-দেড় বছরে বাচ্চারা কিছু কথা বলা শুরু করে। এ সময়টায় মোবাইলে আসক্ত হলে কথাগুলো হারিয়ে যায়, স্পিচ ডিলে সমস্যা, আবার অনেক বাচ্চা কথাই বলে না। প্রথম পাঁচ বছর একটি বাচ্চার স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে। হাঁটা, বসা, চলা, কথা বলা ও বুদ্ধি হওয়া এগুলোর সবই তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে যায়। এ সময়টাকে যদি কাজে লাগানো না যায় তাহলে সেটা আর কখনোই ফিরে আসবে না। এ বয়সেই বাচ্চার মস্তিষ্কের বিকাশ ও সব ধরনের বৃদ্ধি ঘটে। পাঁচ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে কথা বলতে, মস্তিষ্কের বিকাশে ও আচরণগত বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, প্রথম পাঁচ বছর বাচ্চার মস্তিষ্ক থাকে একেবারে নরম কাদামাটির মতো। এ সময়ে তাকে যেভাবে যা বোঝানো ও শেখানো হবে, তাই শিখবে। পাঁচ বছরের পর বাচ্চার ব্রেন শক্ত হয়ে যায় তখন আর নতুন করে বিকাশ ঘটে না। তিন থেকে পাঁচ বছর বয়স হচ্ছে বাচ্চার ব্রেনের বিকাশে সবচেয়ে ভালো সময়। সেই সময়টাতেই বাচ্চারা মোবাইল ধরার ফলে তাদের বিকাশ অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত হয়।

বিএসএমএমইউয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের এ চেয়ারম্যান বলেন, অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে বাচ্চাদের স্ক্রিন ডিপেন্ডেন্সি সিনড্রোম তৈরি হয়। বাচ্চারা মোবাইলের প্রতি এতো বেশি ডিপেন্ডেন্ট হয় যে, তাদের মোবাইল ব্যবহার থেকে বিরত রাখা যায় না। মোবাইল ব্যবহার করতে না দিলে বাচ্চারা রাগান্বিত হয়ে যায়। কোনো কাজ করবে না, মারামারি করে, মন খারাপ করে থাকে। বর্তমানে অনেক বাচ্চাদের এসব অসুবিধা দেখা যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমেরিকান পেডিয়াট্রিক সোসাইটির গাইডলাইনে বলা হয়েছে, প্রথম দুই বছর বাচ্চাদের মোবাইল দেওয়া যাবে না, তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের এক ঘণ্টা শুধুমাত্র শিক্ষামূলক কাজের জন্য মোবাইল দিতে হবে। পাঁচ বছরের পরে বাচ্চাদের মোবাইল দেওয়া যেতে পারে।

শিশুদের মোবাইল ব্যবহার কমাতে অভিভাবকের করণীয়
মা-বাবা কিংবা অভিভাবকরা বুঝে কিংবা না বুঝে শিশুদের হাতে অত্যধিক শক্তিশালী এ যন্ত্রটি তুলে দিচ্ছেন। তারা কখনো কল্পনাও করতে পারছেন না মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দিয়ে সন্তানের ভয়ংকর সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনছেন। সুতরাং সর্বাগ্রে মা-বাবার সচেতনতাই শিশুর মোবাইল ফোন ব্যবহার কমাতে পারে।

পাশাপাশি শিশুদের মোবাইল ফোনের পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের গল্পের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে হবে। সৃজনশীল কাজে যেমন- ছবি আঁকা, গল্প করা, নাচ-গান করা, পাজল খেলায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মা-বাবাকে বাচ্চাদের সামনে মোবাইল ফোন ব্যবহার কমাতে হবে। শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা ও গল্প করতে হবে। বাইরে প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করতে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। তাহলেই আমাদের শিশুরা মোবাইলের আসক্তি থেকে মুক্তি পাবে ও নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে দেশের উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখতে পারবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০২৩
আরকেআর/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।