ঢাকা: দেরিতে রোগ নির্ণয় ও উন্নত চিকিৎসার অভাবে দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত ৬০ শতাংশ রোগী মাত্র পাঁচ বছরেই মারা যাচ্ছে। আর সূচনাতে রোগ নির্ণয় না হওয়ায় ক্যান্সারে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা চালু, সূচনায় রোগ নির্ণয় এবং ক্যান্সারের সাতটি বিপদ লক্ষণ গণমানুষকে জানিয়ে দিতে পারলেই বহুলাংশে এর প্রতিকার পাওয়া যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে শুধু রাজধানীতে নয়, সারা দেশেই ক্যান্সার নির্ণয় কেন্দ্রের ব্যবস্থা জরুরি।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এনামূল হক মোস্তফা শহীদ বলেন, “সূচনায় ক্যান্সার রোগ নির্ণয়, গরিব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ক্যান্সার রোগীদের বিদেশে যাওয়া নিরুৎসাহিত করতে সরকার ও আহছানিয়া মিশন যৌথভাবে আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। হাসপাতালটি চলবে ‘না লাভ না ক্ষতি’ এই হিসেবে। গরিবদের বিনামূল্যে চিকিৎসারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ”
সমাজকল্যাণ মন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে বর্তমানে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ১০ লাখ। আর প্রতিবছর ২ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। আর দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর ৬০ শতাংশ মাত্র পাঁচ বছরেই মারা যাচ্ছে।
মহাখালী জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যান্সার রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, “দেশে বর্তমানে ক্যান্সার চিকিৎসার সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। তবে ব্যাপকভাবে এর সম্প্রসারণ প্রয়োজন। ”
তিনি বলেন, “ক্যান্সার প্রতিরোধে সাতটি বিপদ লক্ষণ জনগণের কাছে ব্যপকভাবে প্রচার করতে হবে। সূচনাতে রোগ নির্ণয়ে শুধু রাজধানীতেই নয়, সারা দেশে ক্যান্সার সেন্টার করা প্রয়োজন। ছয়টি বিভাগীয় শহরে কমপক্ষে সূচনাতে রোগ নির্ণয়ে উন্নত ব্যবস্থার পাশপাশি উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহারে সরকারের জোরালো ভূমিকা প্রয়োজন। ”
ডা. হাবিবুল্লাহ আরো বলেন, “বিত্তশালীদের অনেকেই বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিলেও চিকিৎসা দেরিতে শুরু হওয়ায় ফল সন্তোষজনক নয়। সে কারণে প্রয়োজন সচেতনতা সৃষ্টি ও প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার রোগ সনাক্ত করা। আর তা হতে হবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ”
পাঠ্যসূচিতেও ক্যন্সার প্রতিরোধে করণীয় ও সচেতনতা সৃষ্টির বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের এ মতামতকে গ্রহণ করে ৫০০ শয্যার আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল স্থাপন করা হচ্ছে রাজধানীতে। রাজধানীর উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের এই হাসপাতালটি হবে আন্তর্জাতিক মানের।
আগামী বছর থেকে ক্যান্সার আক্রান্ত্র রোগীরা বিদেশে নয়, দেশেই উন্নত চিকিৎসা নিতে পারবেন। ত্রিশ শতাংশ গরিব রোগীরাও চিকিৎসা সেবা পাবেন বিনামূল্যে। এই হাসপাতালে শুধু আন্তর্জাতিকমানের চিকিৎসাই নয়; প্রাথমিকভাবে ক্যান্সার রোগ নির্ণয়েও থাকবে উন্নত ব্যবস্থা।
আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব রণজিৎ কুমার বিশ্বাস বলেন, “২০০৮ সালের ২২ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় ১৬৫ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে সরকার দেবে ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ হিসেবে ৩৯ কোটি টাকা এবং ৭৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ হিসেবে আহছানিয়া মিশন দেবে ১২৬ কোটি টাকা। আগামী ডিসেম্বরে এ হাসপাতালটির নির্মাণ কাজ শেষ হবে। এর পরপরই উদ্বোধন করা হবে। ”
সচিব আরো বলেন, ‘প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য হলো দেশে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ক্যান্সার হাসপাতাল স্থাপন, ত্রিশ শতাংশ গরিব রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা, ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে গণসচেতনতা এবং ক্যান্সার চিকিৎসায় বিদেশে যাওয়া নিরুৎসাহিত করা। ”
বৃহস্পতিবার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সরকার ও আহসানিয়া মিশনের পক্ষে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। সরকার পক্ষে সমাজকল্যাণ অধিদফতরের মহাপরিচালক নাসিমা বেগম এবং আহসানিয়া মিশনের পক্ষে জিয়া উদ্দিন সমঝোতা স্মারকে সই করেন।
সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর আহসানিয়া শিশনের পক্ষে জিয়া উদ্দিন বলেন, “আহসানিয়া মিশন মিরপুরের ১৪ নম্বর সেক্টরে ৪২ শয্যার ক্যান্সার ডিটেকশন ও ট্রিটমেন্ট সেন্টার ২০০১ সাল থেকে পরিচালনা করছে। এখানে দরিদ্র অসহায় রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। ”
ক্যান্সারের সাতটি বিপদ লক্ষণ
খুশখুশে কাশি ও গলার স্বর ভাঙা দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হলে ক্যান্সার রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে যেতে হবে। ডায়াবেটিস নেই অথচ সহজে কোনো ঘা না শুকালে সেটিও ক্যন্সারের কারণ হতে পারে। শরীরের কোন স্থানে, বিশেষ করে মেয়েদের স্তনে অস্বাভাবিক চাকার মতো কিংবা মাংসপিণ্ড দেখা দিলে ক্যান্সারের পরীক্ষা করাতে হবে। হজমে বিশেষ ধরণের গণ্ডগোল সৃষ্টি প্রাথমিকভাবে ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
এছাড়া কোন খাবার গিলতে কষ্ট হচ্ছে, এটা স্থায়ী হলে, মলত্যাগের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন পরিবর্তন হলে, শরীরের কোন তিল বা আঁচিলের পরিবর্তন দেখা দিলে এবং মলদ্বারসহ শরীরের কোন স্থান দিয়ে বেশি রক্তক্ষরণ হলে ক্যান্সারের প্রাথমিক কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ে হাসপাতালের যাওয়া প্রয়োজন।
রোগ নির্ণয় কেন্দ্র ও চিকিৎসক বাড়াতে হবে
বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট ছোট ক্যান্সার রোগ নির্নয় সেন্টার করা প্রয়োজন উল্লেখ করে ডা. হাবিবুল্লাহ বলেন, “সারা দেশের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উন্নত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রযুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর হতে হবে। জনগণের সচেতনতা বাড়ানোর পাশপাশি চিকিৎসকও বাড়াতে হবে। ”
হাসপাতাল প্রকল্প
২০০৯ সাল থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। শেষ হওয়ার কথা ২০১২ সালের মধ্যে। সমঝোতা স্মারক অনুষ্ঠানে ডিসেম্বরে শেষ করা ঘোষণা দেওয়া হলেও এ পর্যন্ত প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি ৩১ শতাংশ।
দেশ ও বিশ্বে ক্যান্সারের অবস্থা
বিশ্বে প্রতিবছর এক কোটি ক্যান্সার রোগী সনাক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে ৬০ লাখ মারা যায়। আগামী ২০২০ সালে বেড়ে দুই কোটি হবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ক্যান্সারে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াবে আট কোটি। বর্তমানে বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ১০ লাখ। প্রতি বছর নতুন করে ক্যান্সার আক্রান্ত হচ্ছে দুই লাখ মানুষ। ৬০ শতাংশ ক্যান্সার রোগী পাঁচ বছরেই মারা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ২২০০ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১২
এসএমএ/সম্পাদনা: আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর