বাংলাদেশের কোটি মানুষের হৃদয়ের কথক ও প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক হুমাযূন আহমেদ ইহজগত ছেড়ে চলে গেছেন। তার কাজের ব্যাপকতা এবং বর্ণিল জীবনের গভীরতা নিয়ে মত প্রকাশের যোগ্যতা আমার নেই।
হুমায়ুন আহমেদের চিকিৎসার বিস্তারিত বর্ণনা আমার জানা নেই এবং এ সংক্রান্ত আমার যেটুকু জানা তার সবটাই পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যম থেকে পাওয়া। যতটুকু জেনেছি তা হলো, সিঙ্গাপুরে অনেকটা হঠাৎই একটি চেক আপে ওনার বৃহদন্ত্র বা কোলনে ক্যান্সার শনাক্ত হয়, যা অনেকটাই ছড়িয়ে পড়েছিলো। কোলন ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসায় প্রথমে অপারেশন করে টিউমারটি ফেলে দেওয়া হয়; তবে ক্যান্সার যদি শরীরের অন্যান্য অংশে যেমন যকৃতে অথবা ক্যান্সার যদি টিউমারটিকে আশেপাশের গুরত্বপূর্ণ অঙ্গ বা রক্তনালীর সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ফেলে, তবে এ ধরনের অ্যাডভান্সড পর্যায়ে প্রথমে কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি অথবা উভয়ের পর্যায়ক্রমিক প্রয়োগে অপারেশনের অযোগ্য টিউমারটিকে আকারে ছোট করে আনা হয়। আমি ধরে নিচ্ছি, এজন্যই ওনাকে কেমোথেরাপির চিকিৎসা নেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়, যা তিনি সিঙ্গাপুরে না নিয়ে আমেরিকায় নিতে মনস্থির করেন। তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার জন্য আমেরিকায় উড়ে যান। এখানে অতি মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। শরীরে ছড়িয়ে পড়া অ্যাডভান্সড ক্যান্সারে, প্রতিটি মূহুর্ত জরুরি এবং অতীব মূল্যবান। এছাড়াও আমেরিকার মতো দেশে স্বাস্থ্যবীমা করা না থাকলে একটি উন্নতমানের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া অস্বাভাবিক পর্যায়ের ব্যয়বহুল; যে খরচের ভার তিনি সিঙ্গাপুরে কেমোথেরাপি নিলে অনেক কমিয়ে আনতে পারতেন, এমনকি আমেরিকায় নির্দেশিত কেমোথেরাপি ঔষধগুলোর একটি বড় অংশ তিনি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের কোনো ভাল হাসপাতালে নিলেও বিশাল ব্যয় লাঘব হতো।
যা হোক, কেমোথেরাপি কোর্স সম্পন্ন হবার পরে হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশে কিছুদিনের জন্য আসেন, তবে পরে আমেরিকায় ফিরে গিয়ে অন্য একটি অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়বহুল হাসপাতালে অপারেশনের জন্য ভর্তি হন।
এখানকার এই চিকিৎসাই আমার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ মনে হয়েছে। সকল সার্জনই আমার সাথে একমত হবেন যে, কেমোথেরাপি শরীরের কোষ কলাকে ভঙ্গুর করে তোলে, যার ফলে পরবর্তী অপারেশনে জটিলতার আশংকা বেশি থাকে। স্বাভাবিক নিয়ম হলো, কেমোথেরাপির পরে অপারেশনের আগে অন্ততঃ ৪-৬ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়; হুমায়ুন আহমেদও তদনুযায়ী অপারেশনের আগে এক মাসের বিরতি নিয়েছিলেন। এ ধরনের অপারেশনে টিউমারটি ফেলে দেওয়ার পরে, বৃহদন্ত্র বা কোলনের বাকি অংশটুকু সেলাই করে বা স্ট্যাপলার যন্ত্রের সাহায্যে জোড়া দেওয়া হয়। যে সব রোগী এই অপারেশনের আগে কেমোথেরাপি পেয়েছেন, তাদের বৃহদন্ত্রের কোষকলা অধিকতর ভঙ্গুর হবার কারণে এই আশংকা থেকেই যায় যে, এই জোড়া দেওয়ার প্রয়াস ব্যর্থ হতে পারে এবং পরে জোড়া লাগানো স্থান থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে অন্ত্রের বর্জ্যকনিকা বেরিয়ে আসতে পারে। সার্জারির পরিভাষায়, এই অপারেশন পরবর্তী মারাত্মক জটিলতাকে আমরা বলি এনাস্টোমোটিক লিক, যা শরীরের অন্যান্য অঙ্গকেও অকার্যকর করে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।
এই জটিলতা এড়াতে সাধারণ নিয়ম-ই হলো, অন্ত্রের বর্জ্য ও মলকে শরীর থেকে বের হওয়ার অন্য একটি বিকল্প পথ তৈরি করে পেটের দেওয়ালে একটি নির্গমন ছিদ্র করে দেওয়া, যাকে কোলোস্টোমি বলা হয়; এর ফলে কোলনের জোড়া দেওয়ার অংশটি সুরক্ষিত থাকে। কোলোস্টোমি একটি সাময়িক প্রক্রিয়া, যা পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে বন্ধ করে পূর্বের ধারায় অন্ত্রের গতি ফিরিয়ে আনা হয়।
সম্ভাব্য সকল বিবেচনায়, আমার ধারনা, হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে অপারেশন পরবর্তী জীবন-সংহারী জটিলতা এনাস্টোমিক লিক দেখা গিয়েছিল। যার ফলে এটি পেটে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয় ও জেনারেলাইজড পেরিটোনাইটিসজনিত অসহ্য পেটে ব্যথা নিয়ে তিনি আবার হাসপাতালে ভর্তি হন এবং তাকে আবার অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। এবারে সার্জনেরা পেট থেকে ছড়িয়ে পড়া বর্জ্য পরিষ্কার করে, কোলন জোড়া দিয়ে, নিশ্চয়ই কোলোস্টোমির মাধ্যমে বিকল্প পথ করেছিলেন, কিন্ত ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ষাটোর্ধ্ব বয়সে, ক্যান্সার ও কেমোথেরাপিতে দুর্বল, হুমায়ূনের শরীর, এই মারাত্মক সংক্রমণ জটিলতার সাথে যুদ্ধ করতে পারলো না। সারা শরীরে এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে এবং এর ফলে তিনি সেপটিসিমিয়ায় আক্রান্ত হন। একের পর এক অঙ্গ অকার্যকর হতে থাকে। ওনার ফুসফুস-ও আক্রান্ত হওয়ায় এক পর্যায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যাহত হয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে তাকে আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ভেন্টিলেটরের সহায়তা দেওয়া হয়। ভেন্টিলেটরে রাখা হলে, রোগীর ফুসফুস সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে, বিশেষ করে আইসিইউতে সংক্রমিত জীবাণুগুলোকে কোনো ধরনের ঔষধের চিকিৎসাতেই ঠেকানো যায না।
আমরা দেখেছি, সুস্থ সবল ব্যক্তিরাই এই মারাত্মক আইসিইউ সংক্রমণকে সামাল দিতে পারেন না। ক্যান্সার জর্জরিত হুমায়ূনের জন্য এই সংক্রমণকে পরাস্ত করা দুরূহ ও অসম্ভবই প্রমাণিত হয়। ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত উনি কয়েক দিন লড়ে গেছেন; অবশেষে হার মেনেছেন।
একজন সার্জন হিসাবে হুমায়ূন আহমেদের ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যাপারে আলোকপাত করার পিছনে কয়েকটি বিষয় কাজ করেছে। এটাতো পরিষ্কার যে, চিকিৎসার ব্যর্থতা হতেই পারে, এমনকি তা আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও।
যে কোন রোগের চিকিৎসার ফলাফল বেশ কিছু পরিমাপকের উপর নির্ভর করে। এসবের মধ্যে চিকিৎসকের ভূমিকা প্রধান তবে একমাত্র নয়। চিকিৎসা পরবর্তী জটিলতা যে কোনো দেশের যে কোন হাসপাতালেই হতে পারে। হুমায়ূন আহমেদের বিশাল পাঠক শ্রেণী ও ভক্তকুলের মধ্যে একটা সার্বিক ধারণা জন্মাতে পারে, যেহেতু হুমায়ূন আহমেদের বৃহদন্ত্র বা কোলন ক্যান্সারের চিকিৎসা বিদেশে হয়েছে, কাজেই এই চিকিৎসা বাংলাদেশের চিকিৎসকদের আওতার বাইরে। এই ধারণা একান্তই অমূলক ও সত্য বিবর্জিত। বাংলাদেশের বেশ কিছু হাসপাতালেই অপারেশন ও কেমোথেরাপি দিয়ে কোলন ক্যান্সারের সফল চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এবং সাফল্যের হারও বেশ ভালো। সার্জন হিসাবে আমার গত ২১ বছরের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমার হাতে অপারেশন হয়েছে এমন অনেক কোলন ক্যান্সার রোগী এখনও আল্লাহর কৃপায় সুস্থভাবে বেঁচে আছেন।
আমাদের দেশে একটি নিবেদিত ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি করার ব্যাপারে প্রবল জনমত ও জনসমর্থনও আছে। এটি একটি ভালো প্রয়াস। তবে ১৫ কোটি লোকের এই দেশে, কতজন ক্যান্সার রোগীকে ঐ ক্যান্সার হাসপাতাল চিকিৎসা দিতে পারবে এটাও মনে রাখতে হবে। এখন এই মূহুর্তে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে যে সব সার্জন ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের অবদানকেও খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই।
হুমায়ূন আহমেদের এই মৃত্যু কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। ক্যান্সার দুরারোগ্য ব্যাধি ঠিকই, তবে বিচক্ষণ চিকিৎসা প্রয়োগে হয়তো আমরা এই ক্ষণজন্মা লেখককে অন্তত আরো কয়েকটি বছর বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম। তাঁর এই বেদনার্ত প্রস্থান থেকে আমরা আরেকবার নিজেদের সামর্থ্যের দিকে তাকাতে পারি।
আসুন আমরা আমাদের দেশের চিকিৎসকের প্রতি আস্থা ফেরাতে উদ্যোগী হই। আমাদের হাসপাতালগুলোর অবকাঠামো প্রসারণে এবং সার্জন ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের দক্ষতা উন্নয়নে, আসুন আমরা সবাই সহযোগিতা করি।
হুমায়ূন আহমেদের মহান আত্মা চিরশান্তিতে থাকুক। সাহস, শক্তি ও সমাজের সহায়তা নিয়ে তার স্ত্রী ও সন্তানেরা প্রিয়জন হারানোর এই বিপর্যয়ের মোকাবেলা করুক, এটাই প্রত্যাশা।
প্রফেসর ডাঃ আনিসুর রহমান
এমবিবিএস, এম এস (কানাডা), এফ সি পি এস,
এফ আর সি এস (যুক্তরাজ্য)
কোলোরেক্টাল ও ব্রেস্ট সার্জারিতে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত
কো-অর্ডিনেটর ও সিনিয়র কনসালট্যান্ট
জেনারেল ও ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি বিভাগ
অ্যাপোলো হসপিটাল ঢাকা
বাংলাদেশ সময় ১৭২৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১২
এমএমকে- [email protected];জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর[email protected]