ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

মমেক হাসপাতাল: নির্বাসনে চিকিৎসা সেবা!

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১২
মমেক হাসপাতাল: নির্বাসনে চিকিৎসা সেবা!

ময়মনসিংহ: বৃহত্তর ময়মনসিংহের ৬ জেলার মানুষের চিকিৎসা সেবার প্রধান আশ্রয়স্থল ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মমেক)।

১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালটি ৮শ শয্যার।

কিন্তু এখানে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৮শ থেকে আড়াই হাজার রোগী ভর্তি থাকেন।

ফলে, বাকি রোগীদের ঠাঁই হয়, হাসপাতালের বারান্দায় অথবা মেঝেতে। যারা মেঝেতে ভর্তি থাকেন, তারা হাসপাতালের খাবার পান না। এ খাবার বিক্রি হয় বাইরে।

এছাড়া সরকারি ওষুধ পাচার হয়ে যাওয়ায় ভর্তি রোগীদের কাছে ওষুধ এখন সোনার হরিণ। চিকিৎসকদের দুর্ব্যবহার আর চোর-বাটপারসহ সংঘবদ্ধ দালালদের উৎপাতে রোগীদের এখন চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

এত কিছুর পরেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এসব বিষয়ে কোনো নজর নেই।

ধারণ ক্ষমতার ৩ গুণ রোগী:
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড ২টি। ২ ও ২৫নং ওয়ার্ড। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান ডা. শফিউদ্দিন নিজেই স্বীকার করলেন, এ দুটি ওয়ার্ডে ৩ গুণ রোগী ভর্তি থাকার কথা।

তিনি বলেন, “রোগী যদি শিশু হয়, তবে আমরা তো তাকে ফিরিয়ে দিতে পারি না। ফলে, ইনকিউবেটরেও ভাগাভাগি করে চলে শিশুদের চিকিৎসা সেবা। ”

হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ দুটি ওয়ার্ডের ৩টি ইউনিটে অতিরিক্ত শয্যাসহ মোট শয্যা রয়েছে ৫৪টি। এ ওয়ার্ডে গড়ে প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে নতুন ২০ থেকে ৩০ শিশু রোগী। আর গড়ে ভর্তি থাকছে দেড়শ থেকে ১৬০ জন।

হাসপাতালে ভর্তির পর প্রত্যেক রোগীর সঙ্গে গড়ে ৩ থেকে ৪ জন আত্মীয় অবস্থান করছেন। সব মিলিয়ে ৬ থেকে ৭ হাজার লোক অবস্থান করেন হাসপাতালে। এর বাইরে হাসপাতালের আউট ডোর ও কেবিন তো আছেই। এতে কেবল চিকিৎসাই বিঘিœত হচ্ছে না, পরিবেশও নোংরা হচ্ছে।

এ নোংরা পরিবেশকে আরও বিষিয়ে তুলছে, হাসপাতালের ভেতরে গড়ে ওঠা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের খাবারের হোটেল-রেস্তোরাঁর বর্জ্য।

নিয়মিত না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের রাউন্ড:
ডায়রিয়ার কারণে ১৬ মাস বয়েসী শিশু সানকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের ২নং ওয়ার্ডে ভর্তি করেছেন, মা মজিদা খাতুন চম্পা (৩০)।

ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, “৫ দিন ধরে ছেলেটাকে ভর্তি করছি। এর মধ্যে মাত্র একদিন বড় ডাক্তার (বিশেষজ্ঞ) আইছে। শিক্ষাননিশ (ইন্টার্ন) চিকিৎসকরাই এ ওয়ার্ড চালায়। ”

একই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আরেক শিশুর মা সুজাদা (৪০) বলেন, “বারান্দায় বাচ্চাকে নিয়ে পড়ে আছি। বড় ডাক্তার আইলে তো পোলাডা কবেই সুস্থ হইয়া উঠতো। নার্স আর শিক্ষানবিশ (ইন্টার্ন) চিকিৎসকরা কি আর রোগ ধরতে পারে? পারে না।

সরেজমিন এ ওয়ার্ডের মতো বেশিরভাগ ওয়ার্ডেই একই চিত্র লক্ষ করা গেছে। তবে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি ওয়ার্ডের দায়িত্বরত কেউই।

অচল ইনকিউবেটর, বিকল যন্ত্রপাতি:
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের দামি ইনকিউবেটর মেশিনগুলো বিকল হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। সরেজমিন দেখা গেছে, ১৫টি ইনকিউবেটর মেশিনের মধ্যে ৮টিই নষ্ট।

বিষয়টি স্বীকার করে শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. শফিউদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, যে প্রতিষ্ঠান এ ইনকিউবেটরগুলো সরবরাহ করেছিল, তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে এগুলো মেরামত করে দেওয়ার জন্য।

তবে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে আপত্তি জানান তিনি।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের ৬টি এক্সরে মেশিনের মধ্যে সচল আছে মাত্র ৩টি। এছাড়া জোড়াতালি দিয়ে চলছে রেডিওথেরাপি বিভাগের কোবাল্ট-৬০ মেশিন। হাসপাতালের জেনারেল অপারেশন থিয়েটারের ৮টি অটোক্লেভ মেশিনের অর্ধেকই নষ্ট দীর্ঘদিন ধরে।  
সূত্র জানায়, অপারেশন থিয়েটারের ডায়াথার্মি, সাকার ও এনেসথেসিয়া মেশিনগুলোও ঠিকমতো চলছে না।

হাসপাতালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার্ডিওলজি বিভাগের রোগীদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে থাকার কথা থাকলেও ৯টি এসির মধ্যে ৬টিই নষ্ট। ৩টি চলছে জোড়াতালি দিয়ে।

এ বিষয়ে ওই ওয়ার্ডের সেবিকা আনোয়ারা সুলতানা বাংলানিউজকে জানান, এসিগুলো ছাড়লে পানি পড়ে। ফলে, মেঝেতে থাকা রোগীদের ওপরে পানি পড়ে। এ কারণে সব সময় এ এসিগুলো বন্ধ থাকে।

ফলে, এমন বিকল যন্ত্রপাতি ও মেশিনারিজের আন্দাজনির্ভর পরীক্ষার মধ্য দিয়ে চলছে বৃহত্তর ময়মনসিংহের ৬ জেলার এ সর্বাধুনিক হাসপাতালটি।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ব্রায়ান বঙ্কিম হালদারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার কক্ষ বন্ধ পাওয়া গেছে।

তবে হাসপাতালের উপপরিচালক এমএ আজিজ বলেন, “সব মেশিনই নষ্ট না। গুটিকয়েক নষ্ট। এগুলো মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ”

এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে তিনি আপত্তি জানান।

পাচার হচ্ছে হাসপাতালের ওষুধ-খাবার:
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সামনেই অনেকটা প্রকাশ্যেই পাচার হয়ে যাচ্ছে রোগীদের খাবার ও ওষুধ। অভিযোগ রয়েছে, গুটিকয়েক চিকিৎসক ও কর্মচারী এ অশুভ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত।

ফলে, এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের স্যালাইন, সিরিঞ্জ থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী সব ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীই কিনতে হচ্ছে বাইরে থেকে।

ওয়ার্ড নম্বর ৯। এখানে শয্যা রয়েছে ২৪টি। গড়ে এখানে রোগী ভর্তি হচ্ছেন শতাধিক। এসব রোগীদের জন্য প্রতিদিন দুবেলা বরাদ্দ ৪০ প্লেট খাবার। কিন্তু এ দিয়েই শতাধিক রোগীর খাবার চালানো হচ্ছে।

মেঝেতে থাকা রোগীরা খাবার পান না। ঠিক এমন অবস্থা হাসপাতালের অন্যান্য ওয়ার্ডেও। রোগীদের ২ বেলার খাবার প্রতিদিন পাচার ও বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য মতে, প্রতিবছর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য প্রায় ৬ কোটি টাকার ওষুধ সামগ্রী কেনা হয়।

কিন্তু, হাসপাতালে ভর্তি করা রোগীরা বাংলানিউজকে জানান, তারা বরাদ্দ করা এসব ওষুধ পান না। ওষুধ পাচার হয়ে বাইরে বিক্রি হচ্ছে।

হাসপাতালের সরকারি বরাদ্দের ওষুধ নিয়েও অনুসন্ধানে মিলেছে নানা কারচুপির কাহিনী। হাসপাতালের মূল কাউন্টার, ইন-ডোর কাউন্টার, আউটডোর কাউন্টার, ওয়ার্ড ও অপারেশন থিয়েটার-এ ৫টি পয়েন্ট দিয়ে পাচার হচ্ছে ওষুধ।

অভিযোগ উঠেছে, হাসপাতালের সবচেয়ে দামি ওষুধ পাচার হচ্ছে, হাসপাতালের মেইন স্টোর ও অপারেশন থিয়েটার থেকে। হাসপাতালের মেইন স্টোর থেকেই মূলত অপর পয়েন্টগুলোতে ইনডেন্ট অনুযায়ী, ওষুধ সামগ্রী সরবরাহ করা হয়। আর এ ইনডেন্টই হচ্ছে ওষুধ পাচারের মূল কৌশল। ”

জানা গেছে, রোগীদের নামে ইনডেন্ট করা ওষুধ সামগ্রীর ন্যূনতম ভাগও পান না রোগীরা। একজন রোগীর নামে প্রতিদিন কী পরিমাণ ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী ইনডেন্ট হচ্ছে, কোনও রোগীই তা জানেন না।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক রোগীর মা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানান, তার ছেলেকে শুধুমাত্র ওরাল স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। বাকি সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রোগীদের বাইরে থেকে ওষুধ কেনার কারণে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে প্রতি বছর প্রচুর ওষুধ নষ্ট হচ্ছে হাসপাতালের গুদামে।
 
সেবার এ রকম মান নিয়ে হতাশা ব্যাক্ত করে ময়মনসিংহ-৪-সদর আসনের সংসদ সদস্য প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান বলেন, “গত ৪ মাস ধরে হাসপাতাল সেবা কমিটির কোনো সভা ডাকা হচ্ছে না।

সভা হলে তিনি এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন। ”

উদ্বেগ-আতঙ্কের নাম রোগীধরা

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উদ্বেগ-আতঙ্কের একটি নাম হচ্ছে রোগীধরা। খোদ এ হাসপাতালকে ঘিরেই রয়েছে শতাধিক পেশাদার দালাল।

হাসপাতালের ঢোকার পথ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ওয়ার্ডে, করিডোরে ঘুর ঘুর করে ভদ্রবেশে অনেক ছদ্মবেশী দালাল। রোগীর ভালোমন্দ খোঁজ নেওয়ার অজুহাতে অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলেন তারা। তারপর হাসপাতালের চিকিৎসার সংটের চিত্র তুলে ধরেন। রোগীর সুচিকিৎসা হবে না বলে জানান এ দালাল চক্র।

এর পর সুযোগ বুঝে প্রাইভেট ক্লিনিকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন। রোগীর অভিভাবক তার কথায় কান দিলেই হলো। সুকৌশলে তার মস্তিষ্ক ধোলাই করে রোগী ধরার কাজটিতে অবশেষে সফল করে দালাল চক্রটি। এ চিত্র এখন হাসপাতালে নিত্যদিনের।

হাসপাতালের ১৯নং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার জোরবাড়িয়া গ্রামের ইউনুস আলী খান বাংলানিউজকে জানান, দালালদের যন্ত্রণায় হাসপাতালে টেকা দায়! রোগীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এরা মূলত পকেট কাটে। মধ্যস্বত্ত্বভোগী দালালদের একটি শ্রেণি গড়ে উঠেছে স্বাস্থ্য সেবাখাতকে ঘিরে। এরা রোগী ধরাকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। হাসপাতালকে দালালমুক্ত করতে ইতোপূর্বেও জেলা প্রশাসনে অভিযোগ উঠেছে। ইতোপূর্বে র‌্যাব বা হাসপাতালের পরিচালকও দালালদের হাসপাতাল ছাড়া করেন।

কিন্তু পরে এরা আবার সুসংগঠিত হয়ে তাদের মিশনে সক্রিয় হয়। প্রশাসনের কড়া নজরদারি ফাঁকি দিয়ে চলছে দালালতন্ত্র।

সূত্র মতে, হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে রয়েছে রোগী ধরা দালালদের অঘোষিত সিন্ডিকেট। এদের ঐক্যও বেশ মজবুত।

দালালদের দৌরাত্ম্যের পাশাপাশি হাসপাতালে রয়েছে আয়াদের উৎপাত। বিশেষ করে প্রসূতি রোগীরা আয়াদের দৌরাত্ম্যের কাছে একেবারেই অসহায়। মনখুশি বকশিশ আর আবদার রক্ষা না করলে প্রসূতি মায়ের স্বজনদের নাজেহাল হওয়ার ঘটনাও এ হাসপাতালে নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চোরের উৎপাত:
হাসপাতালে চোরের উৎপাত দারুণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের দাপটে অতিষ্ঠ রোগী ও স্বজনেরা। প্রায় প্রতিদিনই হাসপাতালে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের সোনার অলঙ্কার, নগদ টাকা, মোবাইল ফোনসহ দামি জিনিসপত্র হাসপাতাল থেকে খোয়া যাচ্ছে।

অথচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের রয়েছে মোটা অঙ্কে পোষা নিজস্ব সিকিউরিটি। কিন্তু এ সিকিউরিটি কোনো কাজে আসছে না।

এবিষয়ে হাসপাতালের উপপরিচালক এমএ আজিজকে প্রশ্ন করা হলে তিনি হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। কিন্তু সশরীরে গিয়েও হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ব্রায়ান বঙ্কিম হালদারের নাগাল পাওয়া যায়নি।

উদ্বোধনের অপেক্ষায় ৫শ শয্যার নতুন ভবন:
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৫শ শয্যার নতুন আরেকটি ৯ তলা ভবন উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রায় সাড়ে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ ভবনে চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে নতুন ও আধুনিক সুবিধাগুলোর অনেক কিছুই রয়েছে।

জনবল নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ শেষ হলেও অজানা কারণে এ ভবনটি এখনো উদ্বোধন হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, বর্তমানে এ হাসপাতালটি ৮শ শয্যার হলেও এখানে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৮শ থেকে আড়াই হাজার রোগী ভর্তি থাকে। চিকিৎসাসেবা কিংবা ওষুধ তো দূরের কথা, একটি শয্যা পাওয়ার জন্যও এখানে রোগীদের তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হয়।

সূত্র জানায়, ৫শ শয্যার এ নতুন ভবনে রয়েছে ১শ ৮টি কেবিন। কিন্তু অজানা কারণে এ ভবনটি উদ্বোধন হচ্ছে না।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ব্রায়ান বঙ্কিম হালদারের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর বেহালদশা:

ময়মনসিংহে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে ১০ উপজেলায়। কিন্তু এসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো শুধু নামেমাত্র। সেখানে স্বাস্থ্য সেবার কিছুই নেই এখানে। এ সরকারের সময়ে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর বেশির ভাগই ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়।

বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকট প্রকট। নষ্ট এক্সরে মেশিন। নেই ইসিজি। ফলে, কাঙ্খিত স্বাস্থ্য সেবা বঞ্চিত হচ্ছে তৃণমূল জনগোষ্ঠী।  

হালুয়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
হালুয়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটু বৃষ্টি হলেই এখানে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ৫০ শয্যা বিশিষ্ট এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্সরে ও ইসিজি মেশিন দীর্ঘদিন ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে।

স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অবসরপ্রাপ্ত মুজিবুর রহমান ফকির এমপির নিজ নির্বাচনী এলাকা গৌরীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সই এখন পর্যন্ত ৫১ শয্যায় উন্নীত হয়নি। ৩১ শয্যা বিশিষ্ট এ কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ১৩টি পদের মধ্যে ৫টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য।

৮টি পদের মধ্যে ৬ চিকিৎসক আছেন ছুটিতে। ২ জন পালাক্রমে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। তার পর আবার এ হাসপাতালে ইসিজি মেশিন নেই।

এ কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (টিএইচএ) মো. হাসমত আলী বাংলানিউজকে জানান, বিষয়টি তিনি স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতনদের জানিয়েছেন।

ফুলবাড়ীয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
ফুলবাড়ীয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নানা সংকটে ভারাক্রান্ত। একটি ভাঙা অ্যাম্বুলেন্স চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ইসিজি মেশিন যেমনি নেই, তেমনি এক্সরে মেশিনও প্রায় ৪ বছর ধরে নষ্ট হয়ে আছে।

ইসিজি মেশিন না থাকলেও বসে বসে বেতন নিচ্ছেন টেকনেশিয়ান। আবাসিক মেডিকেল অফিসারের পদটি শূন্য।

এছাড়া এ হাসপাতালের আশেপাশে গড়ে উঠেছে অনেক অবৈধ ক্লিনিক। ফলে, হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী দালাল চক্র। এসব দালালদের কাজ হচ্ছে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে রোগী ভাগিয়ে নেওয়া।

এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আব্দুল কদ্দুস (টিএইচএ) বাংলানিউজকে জানান, একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এসব সংকটের বিষয়টি জানানো হয়েছে।

ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্সরে ও ইসিজি মেশিন দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। এগুলো সারানোর কোনো উদ্যোগ নেই। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের কারণে-অকারণে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় বলে অভিযোগ করেন ত্রিশাল উপজেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীর।

তার মতে, এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি স্থানীয় বাসিন্দাদের কোনো কাজেই আসছে না।

ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
৫০ শয্যা বিশিষ্ট ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যাম্বুলেন্স নেই। এখানে নিয়মিত থাকেন না চিকিৎসকরা। হাসপাতাল এলাকায় কুকুরের অবাধ বিচরণ। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়।

যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (টিএইচএ) লক্ষ্মী নারায়ণ মজুমদার।

নান্দাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
নান্দাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৫১ শয্যা বিশিষ্ট হলেও এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা চিকিৎসকের দেখা পান না। ফলে, বাধ্য হয়েই চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিংবা প্রাইভেট ক্লিনিকে।

গফরগাঁও ও ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
গফরগাঁও ও ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক্সরে মেশিন ঠিকমতো কাজ করছে না। ঠিকমতো কর্মস্থলে আসেন না চিকিৎসকরা। বেশিরভাগ চিকিৎসক ময়মনসিংহ শহরে নিজের বাসাতেই থাকেন। ফলে, রোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন সরকার প্রতিশ্রুত স্বাস্থ্য সেবা থেকে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১২
সম্পাদনা: শাফিক নেওয়াজ সোহান, নিউজরুম এডিটর

আগামীকাল রোববার গাজীপুর জেলা সদর হাসপাতালের প্রতিবেদন পড়ুন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।