শরীয়তপুর: বহুমুখি সমস্যা আর অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত শরীয়তপুর আধুনিক সদর হাসপাতাল।
হাসপাতালে শয্যা সংকট, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব, ওষুধ, পানি ও বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৮৫ সালের ১৬ মার্চ ৫০ শয্যা নিয়ে জেলার একমাত্র হাসপাতাল হিসেবে যাত্রা শুরু করে শরীয়তপুর আধুনিক সদর হাসপাতাল। ২০০৩ সালের ১ জুলাই হাসপাতালটিকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করে তৎকালীন সরকার।
কিন্তু, ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত হওয়ার ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও ১০০ শয্যার হাসপাতালটিতে বাড়তি জনবল নিয়োগের অনুমোদন মেলেনি। ৫০ শয্যার হাসপাতাল থাকা অবস্থায় যে জনবল ছিল, সে জনবল দিয়েই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে শরীয়তপুর আধুনিক সদর হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম।
৫০ শয্যার চেয়ে কম জনবলের এ হাসপাতালে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আসা রোগীদের ভোগান্তির যেন শেষ নেই! জেলার অন্য ৫টি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সও নানা সমস্যায় জর্জরিত বলে জানা গেছে।
হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক-নার্সের সংখ্যা:
১০০ শয্যার হাসপাতাল হলেও শরীয়তপুর আধুনিক সদর হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন ৫০ শয্যা জনবলের হিসেবের চেয়েও কম জনবল। ৫০ শয্যার হিসেব মতে, ১৯ জন মেডিকেল অফিসারের পদ থাকলেও এখানে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ১৩ জন চিকিৎসক।
দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে মেডিসিন, সার্জারি, ইএনটি, কার্ডিওলজি ও মেডিসিন (হোমিও) বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ। ৩৭ জন নার্সের বিপরীতে ২৮ জন নার্স দায়িত্ব পালন করছেন।
১০০ শয্যার হাসপাতালে ৫০ শয্যার জনবলও না থাকায় উন্নত চিকিৎসার আশায় প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা রোগীরা ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছেন। ডাক্তার, নার্স ও বিভিন্ন বিভাগের জনবল সংকটসহ নানা সমস্যায় স্বাস্থ্য সেবা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থার অবনতির ফলে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ক্লিনিকের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
বহির্বিভাগের অবস্থা:
শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আশা নুরজাহান বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ‘সকাল থেকে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন শুনি, ডাক্তার নেই। কাল আসতে বলেছে। ’
পপি আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, `হাসপাতালে আসছিলাম কানের সমস্যার জন্য। ডাক্তার নেই। তাই, ক্লিনিকে চলে যাচ্ছি। এ ছাড়া উপায় কি ?’
এ বিষয়ে নার্স অর্চনা রাণী বাংলানিউজকে বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় জনবল অনেক কম থাকায় ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও মানসম্মত সেবা দিতে পারছিনা। একজন রোগীর কাজ শেষ করতে না করতেই আরও কয়েকজন রোগী এসে ডাকতে থাকেন। কিন্তু, তখন কিছুই আর করার থাকে না। রোগীরা ক্ষেপে যান। অনেক সময় খারাপ ব্যবহারও করেন। ’
এবিষয়ে হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট নাসির মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ হাসপাতাল ৫০ শয্যা থাকাকালে ফার্মাসিতে ৩ জন ফার্মাসিস্ট কাজ করতেন। ৮ বছর হয়েছে, হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। ১০০ শয্যার রোগীর সেবাও দেওয়া হচ্ছে। তবে আমারা এখন কাজ করছি মাত্র ২ জন ফার্মাসিস্ট। কীভাবে এ ফার্মাসি সচল রেখেছি, তা বোঝানো যাবে না। ’
হাসপাতালের রেডিওলজিস্ট ডা. সুমন কুমার পোদ্দার বলেন, ‘৫০ শয্যার হাসপাতালের আউটডোরে ৫ জন চিকিৎসক কাজ করেন। ৫ জন ডাক্তার ২০০ থেকে ২৫০ রোগী দেখতে পারেন। আমাদের হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীত হওয়ায় এখন আউটডোরে প্রতিদিন প্রায় ৫শ থেকে ৬শ রোগী আসেন। ’
তিনি বলেন, ‘৫ জন চিকিৎসককেই তা সামাল দিতে হয়। এতে রোগীদের সেবার মানও আমরা ধরে রাখতে পারছিনা। এছাড়া আউটডোরে নারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। নারী রোগীদেরও আমাদের দেখতে হয়। এত রোগীর চাপ সামলাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। ’
এদিকে, শরীয়তপুর জেলার জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ, ডামুড্যা ও গোসাইরহাট উপজেলায় ১টি করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। চিকিৎসক, নার্স, ওষুধ, অ্যাম্বুলেন্স, বিদ্যুৎ ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে এ হাসপাতালগুলোতে রোগীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।
জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স:
জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৪ জন মেডিকেল অফিসারের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন ১২ জন। ২টি অ্যাম্বুলেন্সের ২টিই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।
নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স:
নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৭ জন মেডিকেল অফিসারের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন ৪ জন। দীর্ঘদিন ধরে ১৩ জন মেডিকেল অফিসারের পদ খালি থাকায় এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
ভেদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স:
ভেদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৫ জন মেডিকেল অফিসারের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন ৫ জন। ১০টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকায় চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা।
ডামুড্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স:
ডামুড্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ জন মেডিকেল অফিসারের মধ্যে রয়েছেন ৫ জন। ৫টি পদ শূন্য থাকায় ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম।
গোসাইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স:
গোসাইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৯টি পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ৬ জন ডাক্তার। এতে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রোগীদের।
এ বিষয়ে শরীয়তপুরের সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল ওহাব হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, `হাসপাতালে জনবল অত্যন্ত কম। এরপরও আমরা সর্বোচ্চ সেবা দিতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সদর হাসপাতালটি ১শ শয্যার হলেও এখন পর্যন্ত ১শ শয্যার জনবলের অনুমোদন না পাওয়ায় ৫০ শয্যার জনবল দিয়েই হাসপাতালের কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বার বার জানানো হলেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। ’
বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১২
সম্পাদনা: রাফিয়া আরজু শিউলী ও শাফিক নেওয়াজ সোহান, নিউজরুম এডিটর, আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর