খুলনা: দালাল চক্রদের হয়রানি, চিকিৎসক নার্সদের অবহেলা এ যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগীদের।
এখানকার রোগীদের অভিযোগ প্রতি মাসেই দায়িত্বে অবহেলার কারণে ২/১ জন রোগী মারা যাচ্ছেন।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে খুলনা বিভাগের সর্ববৃহত এ হাসপাতাল নিয়ে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে রোগীদের কাছ থেকে।
সরকারি এ হাসপাতালে ওষুধ-পথ্যসহ অপারেশন সামগ্রীর কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়। এতে রোগীরা চিকিৎসক, কর্মচারি ও দালালদের মাধ্যমে হাসপাতালের আশপাশে তাদেরই নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্লিনিকে গিয়ে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন। হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা রোগীর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পছন্দের প্যাথলজি কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা।
হাসপাতালের পাশে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক মো. আইয়ুব আলী বাংলানিউজকে জানান, এক শ্রেণীর টাউট ও দালাল চক্র সর্বক্ষণ হাসপাতালে গেটে ওত পেতে থাকে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা হাসপাতালে এলেই দালালচক্র তাদের ওপর হামলে পড়ে। এ চক্রের হাতে প্রায় জিম্মি হয়ে পড়েছেন রোগীরা।
তিনি আরও জানান, হাসপাতালকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ওই দালাল চক্রের সঙ্গে রয়েছে হাসপাতালের পাশে ও মহানগরীর নামি দামি ক্লিনিকগুলোর সুসম্পর্ক। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কোনো রোগী আসলেই শুরু হয়ে যায় দালাল চক্রের আনাগোনা।
এ চক্রের সদস্যরা রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের ভুল বুঝিয়ে বাইরে চিকিৎসা নিতে প্ররোচিত করে। কোনো ক্লিনিকে রোগী নিয়ে যেতে পারলে দালালরা ওই ক্লিনিক থেকে কমিশন পেয়ে থাকেন।
খুলনা মহানগরীর রাইসা, রূপসা ও গুড হেলথ ক্লিনিকে গিয়ে রোগী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা জানা গেছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, দালালদের এখন একটি প্রাতিষ্ঠানিক পদ ও পদবি দেওয়া হয়েছে। তারা বিভিন্ন নিরাময় কেন্দ্রের মাসিক বেতনভূক্ত কর্মচারি-কর্মকর্তা। তাদের একটি মাসিক লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া থাকে এবং তা অর্জনের ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ কর্মচারি-কর্মকর্তাদের সঙ্গে চুক্তি থাকে ওষুধের দোকান, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ছোট ছোট ক্লিনিকের মালিক কর্মচারিদের।
দালালচক্রের পাশাপাশি হাসপাতালে পেশাদার রক্তদাতারাও সক্রিয়। বেশিরভাগ রক্তদাতাই মাদকাসক্ত। যারা দীর্ঘদিন যাবত লাল রক্তে কালো ব্যবসা করছেন। পেশাদার এসব রক্তদাতার রক্ত মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতি ব্যাগ রক্ত তারা ৩শ টাকা থেকে ৫শ টাকায় বিক্রি করেন। পেশাদার রক্তদাতা ছাড়াও হাসপাতাল এলাকার বিভিন্ন ওষুধের দোকান ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এমনকি খাবারের হোটেলেও রক্ত পাওয়া যায়। খুলনা র্যাব-৬ এর বিশেষ অভিযানে এর একাধিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সরেজমিনে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের না পাওয়ার যন্ত্রণার ব্যাথা।
সিটবিহীন বারান্দায় পড়ে থাকা ষাট উর্ধ্ব হালিমা বেগম বাংলানিউজকে জানান, কখন কোন ওষুধ খেতে হয় তিনি তা জানেন না, নার্সদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে তারা ধমক দেয়।
গাইনি বিভাগে ভর্তিকৃত রোগীর আত্মীয় সায়মা ভানু বাংলানিউজকে জানান, বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের নিয়ম থাকলেও নামেমাত্র ২/১টি ট্যাবলেট ছাড়া তেমন কোনো ওষুধ দেওয়া হয় না তাদের। একটি সিরিঞ্জ পর্যন্ত বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মচারি বাংলানিউজকে জানান, সরকারিভাবে হাসপাতালে দুই উপায়ে ওষুধ সংগ্রহ করা হয়। প্রথমটি হচ্ছে ইসেনশিয়াল ড্রাগ যা সরকারিভাবে সরাসরি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পেয়ে থাকে। ২য়টি হচ্ছে টেন্ডারের মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেশের প্রথম শ্রেণীর ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে ক্রয় করে।
অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘ দুই বছর যাবৎ খুলনার জনৈক্য স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (সাচিব) নেতার ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিনছে। যা প্রথম শ্রেণীর ওষুধ কোম্পানির মধ্যে পড়েনা। রোগীরা জানিয়েছেন এ ওষুধের মান নিম্নমানের।
এদিকে, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে মুমূর্ষু রোগীদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা প্রদান বন্ধের কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে।
সূত্র মতে, মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসা প্রদানে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা হামলা ও ভাঙচুরের ভয়ে কোনো ধরনের দায়-দায়িত্ব না নিয়ে সরাসরি সংশ্লিষ্ট বিভাগ কিংবা স্পেশালাইজড হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এতে করে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা না পাওয়ায় হতভাগ্য রোগীটি ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।
অনেক রোগীকে সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন কিংবা কোনো জরুরি চিকিৎসা দিলে হয়তো রোগী জীবন ফিরে পেতে পারে। জরুরি বিভাগে তাৎক্ষণিক চিকিৎসাসেবা দিলে কোনো রোগীর জ্ঞান ফিরে আসে কিংবা অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়।
আবার চিকিৎসাবস্থায় রোগী মারাও যায়। অনেক রোগী মুমূর্ষু অবস্থায় জরুরি বিভাগে আসে। তখন কর্তব্যরত চিকিৎসক রোগী রক্ষায় যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। ওই সময় রোগী মারা গেলে অবহেলা কিংবা ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ তুলে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারিকে মারধর এবং ভাঙচুর শুরু করার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে এ হাসপাতালে।
যার ফলে গত এক বছরে এখানকার চিকিৎসকরা তাদের নিরাপত্তার জন্য কর্মবিরতিসহ নানা আন্দোলন করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাইনি বিভাগের এক চিকিৎসক বাংলানিউজকে বলেন, “অনেক সময় মুমূর্ষু রোগীকে ভর্তি করে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সপ্তাহ খানেক কিংবা এক দুই দিন পর রোগী মারা যায়। ভুল চিকিৎসা অথবা চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তুলে হামলা ও ভাঙচুর করে বিল না দিয়ে রোগীর লোকজন চলে যায়। এটাও রোগীদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসাসেবা প্রদান থেকে বিরত থাকার একটি কারণ বলে তিনি জানান। ”
হাসপাতালের এ সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গে খুলনার বেসরকারি সমাজ উন্নয়নমূলক সংস্থা চলন্তিকা যুব সোসাইটির চেয়ারম্যান খবিরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, “সবার আগে চিকিৎসকদের দায়িত্বের প্রতি সচেতন হতে হবে। সঠিকভাবে সরকারি ওষুধ সরবরাহ এবং বিলি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন বলে মনে করেন। ”
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি সূত্র বাংলানিউজকে জানিয়েছে, হাসপাতালে সর্বমোট ১৩টি ওয়ার্ড রয়েছে। এগুলো হলো গাইনি অ্যান্ড অবস ১ ও ২, লেবার ইউনিট ১ ও ২, মেডিসিন ১ ও ২, সিসিইউ সার্জারি ১ ও ২, অর্থোপেডিক্স, শিশু বিভাগ, ইএনটি এবং অর্থালমোনাজি।
আউটডোরে যে বিভাগ রয়েছে সেগুলো হলো গাইনি, ভায়া, আরএইচ স্টেপ, পরিবার পরিকল্পনা, মেডিসিন পুরুষ ও মহিলা, সার্জারি পুরুষ ও মহিলা, শিশু, চক্ষু, ডেন্টাল, মানসিক, ইএনটি, চর্ম ও যৌন এবং যুববান্ধব।
জানা গেছে, ২০০৮ সালের ১ জুলাই খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি ৫০০ শয্যায় উন্নীত করার প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়া যায়। ৫০০ শয্যার জন্য জনবল অনুমোদন দেওয়া হয় ৭৬০ জন। কিন্তু বর্তমান জনবল আছে ৩৩৪ জন। অর্থ্যাৎ ৪২৬টি পদ শূন্য থাকায় চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক পরিতোষ কুমার কুন্ডু বাংলানিউজকে জানান, হাসপাতালে কিছু সমস্যা রয়েছে। তিনি দায়িত্বে আসার পর এগুলো সমাধানের চেষ্টা করছেন।
জনবল সংটকের বিষয়ে তিনি জানান, ইতিপূর্বে জনবল সংকটের বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। খুব শিগগিরই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে তিনি আশাবাদী।
পাঠক আগামীকাল শুক্রবার থাকছে খুলনা জেনারেল হাসপাতালের নানান অনিয়মের চিত্রসহ প্রতিবেদন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১২
সম্পাদনা: মাহাবুর আলম সোহাগ নিউজরুম এডিটর