দেশে প্রথমবারের মতো পাঁচজনের শরীরে রিওভাইরাস শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। সংস্থাটি জানায়, পাঁচজন রোগীর নমুনায় এ ভাইরাস পাওয়া গেছে।
এসব তথ্য নিশ্চিত করেছিলেন আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন। তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, সম্প্রতি নিপাহ ভাইরাসের মতো উপসর্গ থাকায় ৪৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে পাঁচজনের শরীরে রিওভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। নতুন জীবাণু নিয়ে আইইডিসিআরের নিয়মিত গবেষণার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে এ নমুনাগুলো পরীক্ষা করা হয়। এ ভাইরাস সাধারণত কাশি ও হাঁচির মাধ্যমে ছড়ায়। এর উপসর্গের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, জ্বর, মাথাব্যথা, বমি ও ডায়রিয়া অন্তর্ভুক্ত। গুরুতর ক্ষেত্রে এটি নিউমোনিয়া বা মস্তিষ্কে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। শিশু ও বয়স্করা এ ভাইরাসে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশে প্রথমবার দেখা মিললেও রিওভাইরাস বিশ্বে প্রথমবারের মতো শনাক্ত হয় ১৯৫০ সালে। শীতকালে এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। ভাইরোলজিস্টরা বলছেন, এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে যে লক্ষণগুলো হয় তা অনেকটা অন্যান্য ভাইরাসের মতোই।
এটি মূলত রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (আরএনএ) ভাইরাস। রিওভাইরাস রিও-ভাইরিডি গ্রুপের ভাইরাস। এই ভাইরাস গোত্রের মধ্যে পরিচিত একটি ভাইরাস হলো রোটা ভাইরাস। এ ভাইরাসের আলাদা কোনো লক্ষণ নেই। অন্য ভাইরাসের মতোই স্বাভাবিকভাবে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে জ্বর, সর্দি, মাথায় ব্যথা, হাঁচি কাশির মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কখনো কখনো আক্রান্ত হলে ডায়রিয়ার মতো লক্ষণও দেখা দিতে পারে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, এই ভাইরাস আগেও হয়তো ছিল। কিন্তু কখনো এটা শনাক্তের জন্য কোনো ধরনের পরীক্ষা করা হয়নি।
ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, এই ভাইরাসটা অনেক আগে থেকেই আমাদের মাঝে আছে। নতুন কিছু না। ধরেন যদি ১০০ জনকে পরীক্ষা করা হয় তাহলে ৫০ জনের মধ্যেই এটা পাওয়া যাবে। যদি কোনো সময় কেউ আক্রান্ত হয়ে থাকে এখন ভাইরাসটির এন্টিবডি পরীক্ষা করলে ফলাফল পজিটিভ আসবে। কেউ যদি এই ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তার ঠাণ্ডা জ্বর থেকে শুরু করে পেট খারাপ, প্রদাহসহ বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
ভাইরাসটি নিয়ে বিবিসি বাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন ভাইরোলজিস্ট ও বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী। তার ভাষ্যমতে, রিওভাইরাসটি ইনফেকশন করলেও সে তেমন ক্ষতিকারক না। এমন পৃথিবীতে অনেক ভাইরাস আছে যারা প্রতিনিয়ত ইনফেক্ট করে কিন্তু কোনো ধরনের বড় ক্ষতির কারণ না।
চিকিৎসকদের মতে, এই ভাইরাসে আক্রান্ত তেমন গুরুত্বর কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। যে কারণে এর জন্য আলাদা কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হলে রোগী ও স্বজনদের আতঙ্কিত না হতে পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
বাংলাদেশে রিওভাইরাস শনাক্ত হওয়া প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলা বলছে, সাধারণত শীতকালে কাঁচা খেজুরের রস খেয়ে অনেকে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। আইইডিসিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিপাহ ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে আসা এমন ব্যক্তিদের পরীক্ষা করার পর তাদের ফলাফল নেগেটিভ পাওয়া গেছে। ওই ব্যক্তিদের প্রায় সবাই খেজুরের রস খেয়েছিলেন। পরে গবেষণার জন্য তাদের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। আইইডিসিআর বলছে, ওইসব রোগীদের যেহেতু নিপাহ ভাইরাস নেগেটিভ এসেছে, অন্য কোনো ভাইরাসে তারা আক্রান্ত হয়েছে কিনা সেটি দেখার জন্য তারা এই নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। পরে পরীক্ষার পর কয়েকটি স্যাম্পলের মধ্যে ব্যাট-রিও ভাইরাস কিংবা যেখানে বাদুড়ের সংস্পর্শে ভাইরাস ছড়িয়েছে এমন তথ্য পান আইইডিসিআরের কর্মকর্তারা।
তারা আরও বলছে, সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্য ছিল বাদুড় থেকে অন্য কোনো ভাইরাস খেজুরের রসের মাধ্যমে আসে কিনা সেটি জানা। আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন বলেন, খেজুরের কাঁচা রস খাওয়া যাদের ইতিহাস ছিল তাদের শরীরে এটা পাওয়া গেছে এটা। তারা সাসপেক্টেড নিপাহ ছিল, এমনকি হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছিলেন এটা নিয়ে আমাদের আরও গবেষণা করা প্রয়োজন। গবেষণা শেষে এটা নিয়ে আরও বিস্তারিত বলা যাবে।
রিও ভাইরাস নতুন নয়। প্রাথমিকভাবে আইইডিসিআর মনে করে, রিওভাইরাস ছড়িয়েছে বাদুড়ের মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাসের মতোই।
বাংলাদেশে আইইডিসিআরের পরীক্ষায় যাদের শরীরে রিওভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে তাদের সবাই এখন সুস্থ, লক্ষণও ছিল মৃদু। যে কারণে চিকিৎসকরা বলছেন, এই ভাইরাস নিপাহ ভাইরাসের মতো ভয়াবহ ও ক্ষতিকারকও নয়।
বিশ্বে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে আরও অন্তত ৭৫ বছর আগে। অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, পৃথিবীতে কবে থেকে আছে সেটা সঠিক ভাবে বলা যায় না। তবে এই ভাইরাসটি ১৯৫০ সালে প্রথমবারের মতো পরীক্ষায় ধরা পড়ে।
চিকিৎসা গবেষকদের মতে, বিশ্বে এ পর্যন্ত রিওভাইরাসের নয়টি ধরন শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে চারটি মানবদেহে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। বাংলাদেশে ছড়িয়েছে ব্যাট-রিওভাইরাস। যা বাদুড় থেকে ছড়িয়েছে বলেই ধারণা আইইডিসিআরের। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া দেশগুলোয় এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রয়েছে। রেসপিরেটরি অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস-জনিত ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো উপসর্গ- যেমন হাঁচি-কাশি, জ্বর ও ঠাণ্ডা।
চিকিৎসা ও সতর্কতা
ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, জ্বর, মাথাব্যথা, বমি ও ডায়রিয়া রিওভাইরাসের সাধারণ কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। যেহেতু বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এ ধরনের ভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে, তাই বাড়তি সতর্কতা জরুরি।
ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, এমন পরিস্থিতিতে খেজুরের কাঁচা রস না খাওয়াই ভালো। আক্রান্ত হলে অন্য ফ্লু বা স্বাভাবিক সর্দি-কাশি-জ্বরের মতোই চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করা ভালো।
বাংলাদেশের গবেষণায় নতুন এই ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়ায় এখন পর্যন্ত চিকিৎসকদের কাছে এই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নতুন কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এই ভাইরাসের আলাদা কিংবা নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই।
ভাইরাসটি তেমন বড় কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না, তাই এর জন্য কোনো ভ্যাকসিন বা চিকিৎসা নেই বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সী।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৫
এমজে