ঢাকা, রবিবার, ৫ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

এক ব্যাগ রক্তে স্যালাইন মিশিয়ে ৩ ব্যাগ বানিয়ে বিক্রি করতেন তারা 

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০২৫
এক ব্যাগ রক্তে স্যালাইন মিশিয়ে ৩ ব্যাগ বানিয়ে বিক্রি করতেন তারা  গ্রেপ্তার স্যালাইন মিশিয়ি রক্ত বিক্রি করা চক্রের দুই সদস্য

ময়মনসিংহ: মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করে ময়মনসিংহের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে রক্ত বিক্রি করে একটি চক্র। যদিও তাদের নেই কোনো সরকারি ট্রেনিং বা লাইসেন্স।

চক্রটি রক্তে স্যালাইন মিশিয়ে এক ব্যাগ থেকে দুই বা তিন ব্যাগে পরিণত করতেন। এরপর ভুয়া ক্রসম্যাচিং রিপোর্ট বানিয়ে নিজেরাই রোগীদের শরীরে পুশ করতেন এই ভেজাল রক্ত। এতে রোগীরা সুস্থ হওয়ার বদলে মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়ত।  

এমন অভিযোগে গতকাল শনিবার (১৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন- জেলার তারাকান্দা উপজেলার গোয়াইলকান্দি গ্রামের আবদুর রহমান খানের ছেলে মো. নাঈম খান পাঠান (৩৮) ও নগরীর আকুয়া মড়ল বাড়ি এলাকার আব্দুল্লাহ (২২)।  

রোববার (১৯ জানুয়ারি) দুপুরে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানা কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সফিকুল ইসলাম খান।  

এ ঘটনায় শনিবার রাতে গ্রেপ্তার হওয়া দু’জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৬/৭ জনকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার মো. সেলিম মিয়া।  

মামলায় উল্লেখ করা হয়, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতীয় তলার ব্লাড ব্যাংক থেকে শনিবার বিকালে কৌশলে এক ব্যাগ ব্লাড (রক্ত) চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় কর্মরত সদস্যরা দুজনকে হাতেনাতে ধরেন। পরে পুলিশকে খবর দিলে এক ব্যাগ রক্তসহ তাদের দুজনকে হেফাজতে নেয়।  

সংবাদ সম্মেলনে ওসি মো. শফিকুল ইসলাম খান বলেন, সরকারি হাসপাতাল থেকে রক্ত চুরি করে নিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তাররা জানান, বিভিন্ন ক্লিনিক থেকে তারা রক্ত সংগ্রহ করে বিক্রি করতেন। তাদের এই বিষাক্ত রক্ত শরীরে গ্রহণের ফলে মানুষের জীবনের ক্ষতি হতে পারে।  

ওসি আরও বলেন, গ্রেপ্তার দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পেরেছি, এটি বিশাল একটি চক্র। নগরের বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তারা মানুষের ক্ষতি করছে। মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে এমন ব্যক্তিদের রক্তও সংগ্রহ করেন তারা। সরকার অনুমোদিত ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত না নিয়ে ভুয়া ব্লাড ব্যাংকের কথা বলে তারা এসব রক্ত বিক্রি করছিলেন। এক ব্যাগ রক্তে স্যালাইন মিশিয়ে তিন ব্যাগ রক্ত বানাতো চক্রটি। এই চক্র নির্মূল করা না গেলে মানুষের জীবনের অনেক ক্ষতি হতে পারে। চক্রটির বাকি সদস্যদেরও আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। যে দুজন গ্রেপ্তার করা হয়েছেন তাদের রক্ত বিক্রি করার কোনো বৈধতা নেই। কিছু ব্লাড ট্রান্সফিউশন সেন্টারের রশিদ পাওয়া গেছে, যার মধ্যে শুধু উল্লেখ করা চরপাড়া। তাতে যে ঠিকানা ও ফোন নম্বর রয়েছে সবই ভুয়া।  

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ময়মনসিংহে সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক, কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ব্লাড ব্যাংক, ময়মনসিংহ ব্লাড ব্যাংক অ্যান্ড ট্রান্সফিউশন সেন্টার ও নিরাপদ ব্লাড ট্রান্সফিউশন সার্ভিস সেন্টার।  

নিরাপদ ব্লাড ট্রান্সফিউশন সার্ভিস সেন্টারের পরিচালক আব্দন নূর বলেন, নগরীতে অনেক অবৈধ ব্যাংক পরিচালিত হয়। যেগুলোর সঠিক কোনো ঠিকানা কাগজে ব্যবহার করে না। তারা সুবিধামতো বিভিন্ন ক্লিনিকে ব্লাড ট্রান্সফিউশন করে রোগীদের কাছে বিক্রি করেন। তারা স্যালাইনের মাধ্যমে এক-দুইটি ব্যাগ রক্তকে তিন-চার ব্যাগ রক্ত বানিয়ে বিক্রি করেন। নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে। দীর্ঘদিন এ চক্রটি তৎপরতা চালালেও দেখভালকারী কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যার কারণে, দিনে দিনে চক্রটি বড় হয়েছে ও মানুষ প্রতারিত হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।  

ময়মনসিংহের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. ফয়সল আহমেদ বলেন, চক্রের তৎপরতা সম্পর্কে আমাদের জানা ছিল না। নগরে নিবন্ধিত তিনটি ব্লাড ট্রান্সফিউশন সেন্টার রয়েছে। এসব সেন্টারের বাইরে থেকে যদি কেউ রক্ত নিয়ে যায় তাহলে সেই রক্ত রোগীর শরীরে প্রবেশ করানো উচিত নয়। কারণ, রোগী ভালো হওয়ার জন্য রক্ত দিতে গিয়ে এইডস, হেপাটাইটিস-বিসহ বিভিন্ন মরণঘাতী রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।  

তিনি আরও বলেন, অনিরাপদ রক্ত নেওয়ার কারণে রোগীর শরীরে বিষক্রিয়া, এইডস এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এজন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে বেশি সচেতন হতে হবে।  এতে এ সমস্যা অনেকটা কেটে যাবে। বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে।  

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোহাম্মদ মাইনউদ্দিন খান বলেন, একজন রোগীর কাছ থেকে এক ব্যাগ রক্তের জন্য ২২০০ টাকা নিলেও রক্ত দিচ্ছিল না। পরে বিষয়টি নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তৎপরতা শুরু করলে চক্রের সদস্যরা আটক হয়। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।  

তিনি আরও বলেন, রক্ত বিনিময়ে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। তা না হলে রোগীদের ভয়াবহ পরিণতি হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২০১৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০২৫
এসএএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।