ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

মাতৃদুগ্ধ সম্মেলন

শিশু খাদ্য তৈরি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা

নয়াদিল্লি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১২
শিশু খাদ্য তৈরি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা

নয়াদিল্লী: দিল্লী ঘোষণার মাধ্যমে শেষ হয়েছে প্রথম বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সম্মেলন। শিশুর জন্যে মাতৃদুগ্ধের আবশ্যকতার প্রচার, বিকল্প শিশু খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রাসী বাণিজ্য প্রচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রত্যয় নেওয়া হয়েছে এ সম্মেলনে।



রোববার ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীর হেবিটেট সেন্টারে ৪ দিনব্যাপী সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে দিল্লী ঘোষণা দেওয়া হয়।

মাতৃদুগ্ধকে মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক, জাতীয় এবং কমিউনিটি পর্যায়ে মাতৃদুগ্ধের প্রচার, প্রসার ও সহযোগিতার আহবান জানানো হয় দিল্লী ঘোষণায়। ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আইবিএফএএন’র আফ্রিকা অঞ্চলের প্রধান জয়সী চেস্তা।

দিল্লী ঘোষণার মধ্যে আরো রয়েছে, ওয়ার্ল্ড ব্রেস্ট ফিডিং ট্রেন্ডস ইনিশিয়েটিভ (ডাব্লিউবিটি) এর মাধ্যমে প্রতিটি দেশে নবজাতক ও ২ বছরের কম বয়সী শিশুর খাদ্য প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা, বাজেট প্রণয়নের সময় শিশুর মাতৃদুগ্ধের ব্যাপারটি নীতি ও পরিকল্পনা নির্ধারণে থাকতে হবে।

দিল্লী ঘোষণাতেও উঠে এসেছে শিশুর বিকল্প খাদ্য বাজারজাতকরনে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী বাণিজ্য প্রচার বন্ধের কথা। এ লক্ষ্যে শিশু খাদ্যের প্রচারে আর্ন্তজাতিক বাজার কোড অনুসরনের জন্য জোর দাবি জানানো হয়েছে কোম্পানিগুলোর প্রতি।

দিল্লী ঘোষণায় আরো বলা হয়, স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি খাতে মতামত তৈরিতে এবং পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করতে হবে।

মাতৃত্বকালীন সময়ে সকল মায়েদের জন্যে সমন্বিত সহযোগিতা করতে হবে, যেখানে অর্থনৈতিক ব্যাপারটিও থাকবে।

জাতীয় ও কমিউনিটি পর্যায়ে সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের গর্ভধারণে পূর্বের এবং পরে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবার ওপর যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।

কম ওজনের শিশুর দিকে বিশেষ নজরদারি রাখতে হাসপাতালগুলোকে মা ও শিশু বান্ধব করে তোলার উপর জোর দেওয়া হয় ঘোষণায়।

কমিউনিটি পর্যায়ে সকল মায়েদের জন্য দক্ষ মাতৃদুগ্ধ পরামর্শক নিয়োগ করতে হবে।

শিশুর জন্মের ৬ মাস পর থেকে ২৪ মাস বয়স পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধের পাশাপাশি অকৃত্রিম খাদ্য বাড়িতে তৈরি করে খাওয়ানোর কথা বলা হয়েছে।

সবশেষে শিশুর জন্যে কৃত্রিম খাবারের ঝুঁকি ব্যাপকহারে প্রকাশ করার কথা বলা হয় দিল্লী ঘোষণায়।

ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, প্রতিবছর সারাবিশ্বে ৫ বছরের কমবয়সী শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ৭০ কোটি, যার বড় অংশই নিরাময়যোগ্য। আবার এ সংখ্যার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ১ বছর বয়সের আগেই মৃত্যুবরণ করে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া এবং নবজাতক সংক্রমনে।

৫ বছরের কমবয়সী মৃত্যু হওয়া এসব শিশুদের এক তৃতীয়াংশের মৃত্যু অপুষ্টির সঙ্গে সর্ম্পকিত।

সম্মেলনের ঘোষণা বলা হয়, মাতৃদুগ্ধ বিষয়টি শখ বা অভ্যাস নয় বরং স্বাস্থ্যের জন্যে অপরিহার্য। মাতৃদুগ্ধের চেয়ে ক্ষমতা সম্পন্ন ও উপযুক্ত কোন খাদ্য তৈরি করা সম্ভব নয়।

কৃত্রিম খাদ্য শুধুমাত্র শিশুর জন্যেই ক্ষতিকর নয়, পরবর্তী জীবনে অসংক্রমিত রোগ, ডায়াবেটিস, স্থূলকায় হওয়া, কার্ডিওভাস্কুলার ও ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। অথচ প্রতি তিন শিশুর মধ্যে ২ জন শিশু অর্থাৎ ১৩৬ মিলিয়ন শিশুর মধ্যে ৯২ মিলিয়ন শিশুকেই কৃত্রিম খাবার খাওয়ানো হয়।

শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পানের হার কম থাকার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, মায়েদের সুযোগ সুবিধার অভাব।

অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় শিশুখাদ্য তৈরি প্রতিষ্ঠানগুলো শিশুর মা-বাবার কাছে ভুল তথ্য পৌঁছে দেওয়াকে।

হেবিটেট সেন্টারের স্টেইন মিলনায়তনে সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরইমধ্যে নারীদের জন্যে বেতনভাতাসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস ঘোষণা করেছেন। দেশের এক লক্ষ মাকে এ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
তবে শুধু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কর্মরত নারী নয়, অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে কর্মরত মায়েদের কাছেও এ সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে।

পৃথিবীর অল্প কিছু দেশের মধ্যে বাংলাদেশেও ব্রেস্ট মিল্ক সাবস্টিউট আইন রয়েছে। এ আইনটিকে আরো যুগোপযোগী করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।

নবজাতকের জন্যে মাতৃদুগ্ধ নিশ্চিতক করতে হলে চিকিৎসক এবং সেবিকাদের গুণগত প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন তিনি।

রুহুল হক বলেন, শুধুমাত্র শক্তিশালী আইন দিয়ে বিকল্প শিশু খাদ্য বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচার বন্ধ করা যাবে না। আইনের বাস্তবায়নও থাকতে হবে।

এসব কোম্পানির ব্যাপারে সকলকে সতর্ক করে দিয়ে মন্ত্রী বলেন, পুরো বিশ্বে শিশু খাদ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর ১০০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা রয়েছে। এর অর্ধেকই লাভ হয়। তারা তাদের লাভের জন্য যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত। তাই পর্যবেক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ইন্টারন্যাশনাল ব্রেস্টফিডিং অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (আইবিএফএএন) এর এশিয়া অঞ্চলের সম্বন্বয়ক ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পুষ্টি বিষয়ক কার্যক্রমের সদস্য অরুন গুপ্তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, ভারতের স্বাস্থ্য পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ডা. সৈয়দা হামিদ।

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন, ভারতে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হোমি ইভিন্দ, হেলথ সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভলেপমেন্ট কো-অপারেশন এজেন্সি (এসআইডিএ) এর দলীয় সমন্বয়ক সুসানি লোকারাঞ্জ, ভারতের নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব প্রেম নারায়ন।

বহুজাতিক বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি শিশুখাদ্য ২১ টির বেশি রোগ ছড়াচ্ছে। শিশুর জন্যে চাই মায়ের তৈরি খাবার, মানুষের তৈরি খাবার নয়। কিন্তু বিকল্প শিশুখাদ্য বাজারজাতকরণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করছে। তাদের প্রভাবের কারণেই সঠিক ও সময় উপযোগী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে বিভিন্ন দেশ।

নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কোম্পানিগুলোর প্রভাব বন্ধ এবং দুই বছর পর্যন্ত শিশুখাদ্য প্রচার ও প্রসার নিষিদ্ধ করতে হবে।

বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর এ প্রভাব বন্ধের আহবান জানানো হয়েছে “ওয়ার্ল্ডব্রেস্ট ফিডিং কনফারেন্স-২০১২”তে।

“বেবিস নিড মম-মেড নট ম্যান-মেড!” প্রতিপাদ্য নিয়ে এবারের সম্মেলন শুরু হয়েছে ৬ ডিসেম্বর। সরকারি, বেসরকারি, সুশীল সমাজ, স্বাস্থ্যকর্মী, গণমাধ্যম প্রতিনিধি এবং দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজ নিজ দেশের অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর হার বাড়ানো এবং শিশুকে সঠিকভাবে সম্পূরক খাবার খাওয়ানোর ভবিষ্যৎ করণীয় ঠিক করা।

প্রথমবারের মতো বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সম্মেলন যৌথভাবে আয়োজন করছে ইন্টারন্যাশনাল বেবি ফুড এ্যাকশন নেটওয়ার্ক (আইবিএফএএন), ওয়ার্ল্ড এ্যালায়েন্স ফর ব্রেস্টফিডিং অ্যাকশন (ডব্লিউএবিএ), গ্লোবাল ব্রেষ্টফিডিং ইনিশিয়েটিভ ফর চাইল্ড সালভাইবাল (জিবিআইসিএস)।

চারদিন ব্যাপী এ সম্মেলনে ৮৬টি দেশের হাজারের বেশি প্রতিনিধি অংশ নেয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১২
এমএন/সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।