বরিশাল: বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের স্বাস্থ্য সেবার অন্যতম ভরসা শের-ই বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতাল আজ নিজেই মুমূর্ষ হয়ে পড়েছে।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই শুধু নাই আর নাই।
বরিশাল বিভাগের একমাত্র নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র ৫শ শয্যার শেবাচিম হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার দৃশ্য দেখে সম্প্রতি বিষ্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান দু’জনই।
নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ বন্ধ: দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের উন্নত চিকিৎসার জন্য ৪৪ বছর আগে ১৯৬৮ সালে নির্মাণ করা হয় ৫শ শয্যার বরিশাল শের-ই বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতাল। এরপর থেকে প্রতিদিনই এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকছেন প্রায় তিনগুণ রোগী। তাই রোগীর বাড়তি চাপ মোকাবেলা ও সেবার মান বাড়াতে ২০০৮ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ‘মর্ডানাইজেশন অ্যান্ড এক্সটেনশন অব এসবিএমস্থি’ প্রকল্পের আওতায় সব আধুনিক সুবিধা ও ৫শ শয্যা ধারণক্ষমতার ৫ তলা একটি নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। নতুন ভবনের নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু ৪ বছরেও ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। অথচ দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী ২৭ মাস অর্থাৎ ২০১০ সালের জুনে ভবনসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে এটি গণপূর্ত বিভাগ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। এদিকে কাজ বন্ধ থাকায় এ খাতের সাড়ে ৪ কোটি টাকা ফেরত চলে গেছে।
বরিশাল গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান জানান, প্রায় ২ সপ্তাহ আগে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ডা. আফম রুহুল হকের নির্দেশে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আজাদ কনস্ট্রাকশন ও মার্কেন্টাইল করপোরেশন কাজ থেকে অব্যহতি দিয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি কাজে গাফিলতি করায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দু’টির সিকিউরিটি মানি সরূপ জমা দেওয়া দেড় কোটি টাকাও আটকে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আরও অর্ধকোটি টাকা অর্থদ- দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আজাদ কনেস্ট্রাকশন’র ম্যানেজার বাদী হয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক, গণপূর্ত বিভাগের তত্তবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলীসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তিন মাসের জন্য ভবন নির্মাণে স্থগিতাদেশ দিয়েছেন।
চিকিৎসা হয় না আইসিইউতে: হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) অথবা নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ভবন নির্মাণ করা হয়েছে সাত বছর আগে। প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় আজও ১০ শয্যার এ ইউনিটটি চালু করা সম্ভব হয়নি। অবকাঠামোগত কারণে সেখানে অন্য কোনো ইউনিটও চালু করা যাচ্ছে না। ফলে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ ভবনটি অব্যবহৃত রয়েছে। হারিয়ে গেছে ভবনের তালার চাবিটা পর্যন্ত। ফলে কয়েক মাস আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক পরিদর্শনে গিয়ে তালাবদ্ধ আইসিইউ ভবনে ঢুকতে পারেননি। আইসিইউ চালু করার জন্য মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হলেও এ পর্যন্ত কোনো অনুমতি পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
চিকিৎসা সেবা: সরজমিনে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, শয্যা সংকটের কারণে অর্ধেকের বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন মেঝেতে। বিশেষ করে মহিলা, মেডিসিন, সার্জারি ও লেবার ওয়ার্ডের অবস্থা খুবই করুণ। লেবার ওয়ার্ডের বারান্দায় ঠাঁই হয়েছে প্রসূতি রোগীদের। হাসপাতালে প্রতিদিনই রোগী থাকছেন ১২শ এর মতো। ফলে অনেক বৃত্তবান রোগী এখানে কাঙ্খিত সেবা না পেয়ে ছুটে যান রাজধানীতে। এছাড়া চিকিৎসা খরচের অভাবে ধূকে ধুকে মারা যাচ্ছে হাজার হাজার গরীব রোগী। রোগীরা শত অনুনয় বিনিনয় করলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা মেলেনা ওয়ার্ডে। তাদের সাক্ষাত পেতে হলে ৪ থেকে ৫ শ টাকা ব্যয় করে যেতে হবে চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারে। যদি কখনো ভাগ্যক্রমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ওয়ার্ড পরিদর্শনে যান তবে রোগী দেখার নামে চলে ইন্টার্নি চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা বাড়ানোর মহড়া। ওয়ার্ডে রোগীদের কাতরানী-গোঙানীর শব্দ কানে যায়না নার্সদের। কাঁচ ঘেরা কক্ষে তারা মশগুল থাকেন গল্পে ও পারিবারিক আলাপচারিতায়। এমনই অভিযোগ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া রোগীদের।
কিডনি বিভাগ: কিডনি রোগীদের জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। এদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকরা। ২০০১ সালে কিডনি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. আবুল কাশেম বদলি হয়ে যাওয়ার পর নতুন কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না আসায় বন্ধ হয়ে যায় কিডনি ইউনিট। অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে ডায়ালিসিস মেশিন ও ট্রিটমেন্ট প্লান্ট। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে হাসপাতালের ৩য় তলায় ৮/১০ লাখ টাকা ব্যায়ে একটি ডায়ালইসিস ইউনিটও তৈরি করা হয়। কিন্তু ইউনিটটি চালু করার জন্য মন্ত্রণালয়ের আজো ন্যাফলোজির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কিংবা জনবল নিয়োগ দেয়নি। ফলে সরবরাহ করা মেশিন দু’টি প্যাকেট বন্দি অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
মানসিক বিভাগ: একজন সহকারী রেজিস্ট্রার পদের চিকিৎসক দিয়ে চলছে মানসিক রোগীদের বর্হিবিভাগ ও ওয়ার্ডের চিকিৎসা। ২০০৪ সালে প্রফেসর ডা. সরোজ কুমার দাস বদলি হয়ে যাওয়ার পর থেকে মানসিক বিভাগে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। মানসিক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত একমাত্র চিকিৎসক (সহকারী রেজিস্ট্রার) ডা. তপন কুমার সাহা বলেন, কলেজে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিয়ে ওয়ার্ড এবং বহির্বিভাগ চালাতে হিমশিম খেতে হয়। মানসিক বিভাগের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নিরাপত্তার অভাবে গত এক বছরে এ ইউনিট থেকে কমপক্ষে ১০ রোগী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপশি এখানকার চিকিৎসা সেবায় মানসিক রোগী পুরোপুরি ভাল হয়েছে এমন নজির নেই।
নিউরো সার্জারি: নিউরো সার্জারি রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় রোগীদের বিপাকে পরতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ বিভাগের একমাত্র চিকিৎসক ডা. সুকৃতি দাস ঢাকায় বদলি হওয়ায় নিরাশ হয়ে পরেছে নিউরো সার্জারির রোগীরা। তবে দুই সহকারী অধ্যাপককে বদলি করে আনা হয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে এক জন ডা. নুরুজ্জামান সপ্তাহে ৫ দিনই থাকেন ঢাকায়। আর যে দুই দিন বরিশালে থাকেন তাও হাসপাতালে নয় কাজ করেন নগরীর বিভিন্ন ক্লিনিকে। আর অন্য নিউরো সার্জন ডা. এহসানুল হককে বরিশালের রোগীরা দেখেছেন এমন প্রমাণ দিতে পারবেন না কেউ। তাদের কর্মকা- নিয়ে বিপাকে পরেছেন এখানকার সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যপক ডা. এএসএএম সরফুজ্জামান রুবেল। তিনি বলেন, তাদেরকে শত অনুরোধ করা সত্তেও তারা কর্মস্থলে থাকছেন না। তাই চিকিৎসক থাকতেও অনেকটা বাধ্য হয়ে রোগীদের ঢাকায় পাঠাতে হচ্ছে।
নিউরো মেডিসিন: একই অবস্থা নিউরো মেডিসিন বিভাগেরও। একদিকে যেমন এ রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় রোগীরা বিপাকে পড়েছেন, অন্যদিকে সরকার কর্তৃক সরবরাহকৃত কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়েছে। এ বিভাগের একমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. তকিব উদ্দিন আহম্মেদ ঢাকায় বদলি হওয়ার পর থেকে দুর্ভোগে পড়েন এই অঞ্চলের নিউরো মেডিসিন বিষয়ক রোগে আক্রান্ত রোগীরা। তবে এক মাস আগে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে ডা. অমিতাব সরকার নামে এক চিকিৎসককে ঢাকা থেকে বদলি করে আনা হয়েছে। বর্তমানে একমাত্র জুনিয়র এ চিকিৎসক দিয়ে নিউরো মেডিসিন সংক্রান্ত সাধারণ রোগ নিরাময় সম্ভব হলেও কোন জটিল রোগের চিকিৎসা দিতে পারছে না তিনি।
ক্যান্সার: বরিশালে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য অন্যতম ভরসা ছিল ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. তড়িৎ কুমার সমদ্দার। তিনি শেবাচিম হাসপাতালে থাকা কোটি টাকা মূল্যের কোভাল্ড সিক্্রট্রি মেশিনের সাহায্যে রোগীদের থেরাপী দিতেন। কিন্তু হঠাৎ করে তিনি পরিবারিক কারণে বরিশাল থেকে ঢাকায় বদলি হন। এরপর আর কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে একদিকে যেমন ক্যান্সার রোগীরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অন্য দিকে ব্যবহার না করায় কোটি টাকার মেশিন অকেজো হয়ে পড়েছে।
বন্ধের পথে প্যাথেলজি বিভাগ: জনবল সংকটের কারণে হাসপাতালের প্যাথেলজি বিভাগ বন্ধ হওয়ার পথে। প্যাথলোজী বিভাগে প্রতিদিন ৫ শতাধীক রোগীর পরীক্ষা নিরীক্ষা করানো হয়। এর মধ্যে রক্তের রুটিন পরীক্ষা হয় ১২০ রোগীর, রক্তের বায়োকেমিস্ট্রি ও সিরোলজী ২৫০ এবং মলমূত্র পরীক্ষা করানো হয় ১২০ রোগীর।
সিটি স্ক্যান বঞ্চিত রোগীরা: কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে এমআরআই, সিটিস্ক্যান ও হাড় ভাঙ্গার অস্ত্রপচারের ডিজিটাল সিঅর্থ মেশিন স্থাপন করা হলেও তা রোগীদের তেমন কোনো উপকারে আসছে না। প্রতিদিন অর্ধশতাধিক রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হলেও জনবল সংকটসহ নানা অজুহাতে হাতে গোনা কয়েকজন রোগী সেখান থেকে সেবা পাচ্ছে। তাই বাকি রোগীরা ছুটছেন বেসরকারি ল্যাব গুলোতে। জানা গেছে, ২০১০-১১ অর্থ বছরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজস্ব টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেড় কোটি টাকার মেশিনারি ক্রয় করে। এর মধ্যে প্রধান ছিল অর্ধ কোটি টাকা মূল্যের সিঅর্থ ডিজিটাল মেশিন। এ মেশিনের সাহায্যে রোগীর হাড় ভাঙ্গার পর কোন এক্সরে ছাড়াই ডিজিটাল মনিটরে ভাঙ্গা হাড়ের অবস্থান দেখে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা করা সম্ভব। কিন্তু মেশিনটির মাধ্যমে যেভাবে রোগীদের সেবা পাওয়ার কথা তা পূরণ হচ্ছে না।
সরকারের আশ্বাস: বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আশার পর থেকেই বরিশালের স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নে নানা আশ্বাস দিয়ে আসছেন। তবে সরকারের প্রায় ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও একটি আশ্বাসেরও বাস্তবায়ন দেখতে পায়নি বরিশালের মানুষ। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর শেবাচিম হাসপাতালসহ দেশের ১৭টি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগ চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ বিভাগ চালুর জন্য বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৫৬ চিকিৎসকের পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। প্রতিটি বিভাগে ১ জন করে অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, রেজিস্ট্রার ও সহকারী রেজিস্ট্রার থাকবে। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
বর্জ্য ধ্বংসকারী মেশিন বিকল: এ হাসপাতালে প্রতিদিন চিকিৎসাধীন রোগী থাকে ১২শ থেকে ১৫শ। ফলে হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল বর্জ্য অপসারণ নিয়ে কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হয়। এক বছর আগে সেন্ট্রাল মেডিকেল ও সার্জারি (সিএমএসডি) দফতর থেকে শেবাচিম হাসপাতালে দেওয়া হয় ক্লিনিক্যাল বর্জ্য ধ্বংসকারী মেশিন। কিন্তু দক্ষ অপারেটর না থাকায় প্রায় এক বছর আগে ওই মেশিনটি বিকল হয়ে যায়।
চিকিৎসকদের রাজনীতি: বরিশালে যে সব চিকিৎসক কর্মরত আছেন তাদের মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিক দল সমর্থিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, ডক্টরস এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ ও ন্যাশনাল ডক্টরস ফেডারেশনের সঙ্গে জড়িত। এর ফলে অনেক সময় চিকিৎসকরা রোগীদের সেবার কথা ভুলে গিয়ে সংগঠনের কর্মকা- ও রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এছাড়া রাজনৈতিক মনভাব ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় কারণে এক চিকিৎসকের সঙ্গে অন্য চিকিৎসকের সমন্বয় থাকে না। সব মিলিয়ে চিকিৎসকদের রাজনীতির কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন রোগীরা।
ইন্টার্নি সন্ত্রাস: হাসপাতালের ইন্টার্নি চিকিৎসকরা শিক্ষিত সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়েছে। যখন তখন যে কারো সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরছে এরা। রোগীর অসুস্থতার কারণ না যেনেই ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছে ইচ্ছে মতো। তাদের ভুল ব্যবস্থাপত্রের কারণে গত কয়েকমাসে একাধিক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হাসপাতালে বেশ কয়েকবার বিক্ষুব্ধ স্বজনরা ভাঙচুরও চালিয়েছে। আবার ইন্টার্নিদের ভুল চিকিৎসায় অসহায় রোগী মারা যাওয়ার পর স্বজনরা ক্ষুব্ধ হলে উল্টো তাদেরকে মারধর করে তুলে দেওয়া হয় পুলিশের হাতে।
প্রতিটি ক্ষেত্রে টাকা: হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ভর্তি হওয়া থেকে ছাড়পত্র নেওয়া পর্যন্ত প্রতি পদে পদে গুণতে হয় টাকা। জানা গেছে, অসুস্থ রোগী নিয়ে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে বা বর্হিবিভাগে রোগী দেখাতে হলে ১১ টাকার টিকেটের স্থলে রাখা হয় ১৫ থেকে ২০ টাকা। ওয়ার্ডে রোগী ভর্তির টিকেটের দাম ২৬ টাকা হলেও খুচরা না থাকার অজুহাতে সবাইকে ৩০ টাকা দিতে হয়। ভর্তি স্লিপ নিয়ে অসুস্থ রোগীকে ট্রলিতে করে ওয়ার্ডে পৌঁছে দিতে সংশ্লিস্ট কর্মচারীকে খুশি করার নামে দিতে হয় ২০ থেকে ১শ টাকা। না দিলে তাদের দুর্ব্যবহারের সীমা থাকেনা। টাকা ছাড়া সিটও পাওয়া যায় না। আবার চিকিৎসা গ্রহণ শেষে ছাড়পত্র পেতে হলেও রোগীদের গুণতে হয় টাকা।
দর্শনার্থী ফি: বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে প্রবেশ করতে হলে প্রতিজন দর্শনার্থীকে গুণতে হয় ১০ টাকা। টিকেট না কাটলে রোগীর কোনো স্বজন বা দর্শনার্থী হাসপাতালে প্রবেশ করতে পারবেন না। হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছিলেন ‘পৃথিবীর অন্য কোনো হাসপাতালে এভাবে টাকা আদায় করা হয় না। ’
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে দর্শনার্থীদের অতিরিক্ত চাপ কমাতে ২০০৭ সালের জুন মাসে দর্শনার্থী কার্ড চালু করেন তৎকালীন স্বাস্থ্য সেবা উপদেষ্টা কমিটি। দর্শনার্থী ফি নির্ধারণ করা হয় ১০ টাকা। সে লক্ষ্যে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হাসপাতালে চুক্তিভিত্তিক নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে র্যাব সদস্যরা হাসপাতালে দর্শনার্থী কার্ডের ব্যবহার সম্পর্কে দায়িত্ব পালন করে। তবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর র্যাব দায়িত্ব থেকে সরে গেলে এটি অবৈধ ব্যবসার রূপ নেয়।
মানসম্মত খাবার: হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের তিন বেলা খাবার দেওয়ার কথা থাকলেও তা শুধুই ‘থাকার’ মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। যে স্বল্প পরিমাণ খাবার দেওয়া হয় তাও নিম্নমানের। তালিকা অনুযায়ী খাবারও জোটে না রোগীদের কপালে। এমন অভিযোগ শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের। জানা গেছে, রোগীদের তিন বেলার খাবার নিয়ে এক প্রকার ব্যবসায় মেতে ওঠে হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা। রোগীর স্বজনদের কাছে খাবার বিক্রির পাশাপাশি অনেক কর্মচারী ও তার পরিবারের খাবার যোগান হয় রোগীদের ভাগ থেকে। আবার হাসপাতালের সামনের অনেক হোটেলে বিক্রি হচ্ছে হাসপাতাল থেকে পাচার হওয়া ভাত, মাছ, মাংস ও তরি-তরকারী । তাই রোগীর কপালে জোটে না তাদের প্রাপ্য সিকিভাগ। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সেভেন স্টার নামের একদল ঠিকাদার হাসপাতালের রোগীদের খাবার সরবরাহ করে যাচ্ছে। যে পরিচালকই দায়িত্বে থাকুক না কেনো তাকে রহস্যজনক ভাবে ম্যানেজ করে প্রতি অর্থ বছরে ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গুলো খাবার সবরাহের কাজ ভাগিয়ে নেয়। তাই বছরের পর বছর আর যুগের পর যুগ একই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান খাবার সরবরাহ করায় রোগীদের প্রাপ্ত খাবার থেকে খুব সহজেই বঞ্চিত করা হচ্ছে।
ওষুধ চুরি: হাসপাতালের ওষুধ চুরি এখন ‘অপেন সিকরেট’ একটি বিষয়। আর এ ওষুধ চুরির সঙ্গে জড়িত রয়েছে হাসপাতালের অধিকাংশ কর্মচারী। কয়েক দিন আগে অপারেশন থিয়েটার থেকে ওষুধ পাচার কালে হাতে নাতে ধরা পরে হাসপাতালে-ই ঝাড়–দার হাসান। তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্তও করা হয়েছে। হাসপাতালের স্টোর থেকে ওয়ার্ডে এবং অপারেশন থিয়েটারে রোগীদের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত ক্যান্সারের ৩ হাজার টাকা মূল্যের এটপাস ইনজ্যাকশন, আড়াই শ’ টাকার প্যাথেড্রিন, ৩৫০ টাকার ক্যাটগাট (বিশেষ সুতা), ৬৫ টাকার ভ্যাসোভেক্স, আড়াই শ’ টাকার সিল্ক সুতা, ১২০ টাকার ট্রাকশন ইনজাকশন, ৩৫ টাকার সেফিক্সিন ট্যাবলেট, গজ-ব্যান্ডেজসহ মূল্যবান সব ওষুধ বাইরে বিক্রি করছে এরা। ওষুধের রেজিস্টারে চিকিৎসকের নাম ও হালনাগাদ ওষুধের তালিকা না থাকায় হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান।
দালালদের দৌড়াত্ম: শেবাচিম হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম দিনে দিনে বেড়েই চলচ্ছে। জরুরী বিভাগ থেকে শুরু করে প্রতিটি বিভাগে অবাদে চলছে দালালদের বিচরণ। প্যাথলজি, এক্সরে, ইসিজিসহ বিভিন্ন বিভাগ থেকে নানা কৌশলে রোগীদের ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দালাল চক্র। ফলে রোগীরা প্রতারিত হওয়ার পাশাপাশি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও রোগীর স্বজনরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন এই দালাল চক্রের হাতে। বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জ থেকে আসা অনেকেই দালালদের খপ্পড়ে পরে সর্বশান্ত হচ্ছেন।
এ ব্যাপারে শেবাচিম হাসপাতালের উপ-পরিচালক পরিচালক ডা. অনিল চন্দ্র দত্ত বলেন, হাসপাতালে যে কোনো প্রকার অস্ত্র পচারের জন্য সব ধরণের উপকরন রয়েছে। রোগীকে কোনো ওষুধ কিনতে হয় না। তিনি আরও বলেন, শেবাচিম হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যে যন্ত্রপাতি সচল আছে তা বাহিরের প্যাথলজি কিংবা ডায়াগোনস্টিক সেন্টারে নেই। তাই এ বিষয়ে রোগীকে জানাতে হবে।
চোরের উৎপাত: শেবাচিম হাসপাতালে চোরের উৎপাতও কম নয়। রোগী ও স্বজনদের জুতা খেকে শুরু করে মোবাইল সেট, পরনের পোশাক, ওষুধ-পত্র, নগদ টাকা যখন যা পাচ্ছেন সুযোগ বুঝে তাই নিয়ে যাচ্ছে চোর। একাজের জন্য শেবাচিম হাসপাতালে রয়েছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র।
বিক্রয় প্রতিনিধিদের উৎপাত: সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে বিক্রয় প্রতিনিধিদের উৎপাত। হাসপাতালই যেন তাদের ঘর-বাড়ি। হাসপাতালের সাইকেল স্ট্যান্ডে মোটরসাইকেলের ভিড় দেখলেই বোঝা যাবে হাসপাতালে বিক্রয় প্রতিনিধির উপস্থিতি। তারা সারা দিন চিকিৎসকদের পিছু পিছু ঘুরে বেড়ায়। ফলে বাধাগ্রস্থ হয় চিকিৎসা সেবা। বর্হিবিভাগে চিকিৎসা নিতে রোগীদের অভিযোগ, বিক্রয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে চিকিৎসকরা খোসগল্পে ব্যস্ত থাকেন। ফলে চিকিৎসকরা ঠিকভাবে রোগী দেখেন না।
প্রাইভেট ব্যবসা: হাসপাতালে কর্মরত প্রত্যেক চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রয়েছে প্রাইভেট ব্যবসা। অনেক চিকিৎসক তাদের কর্তব্য পালনে অমনোযোগী থাকেন। তবে এরাই আবার তাদের প্রাইভেট চেম্বারে রোগীর প্রতি হয়ে উঠেন যত্নবান। জানা গেছে, অনেক চিকিৎসক দীর্ঘদিন ধরে বরিশালে কর্মরত থাকায় তারা নিজেরাই ক্লিনিক খুলে বসেছেন। তাই নিজেদের ক্লিনিক চালু রাখার জন্য হাসপাতাল থেকে দালালদের মাধ্যমে রোগী ভাগিয়ে নিচ্ছে। এছাড়া অধিকাংশ চিকিৎসক বিভিন্ন প্যাথলোজী ও ডায়াগোনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে চুক্তিবধ্য হয়ে থাকেন।
জনবল সংকট: সংকট আর শূন্যতায় ভরা বরিশাল শের-ই বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতাল। হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ বিভিন্ন স্তরের প্রায় একশ চিকিৎসকের পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। এ ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারী সংকটও তীব্র। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের প্রায় ২শ পদ শূন্য থাকায় হাসপাতালের দৈনন্দিন কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। শেবাচিম হাসপাতালে শূন্য থাকা ৯২ চিকিৎসক পদের মধ্যে ২৪ অধ্যাপক, ১৭ সহযোগী অধ্যাপক, ৮ সহকারী অধ্যাপক, ১৩ রেজিস্ট্রার, ১১ সহকারী রেজিস্ট্রারের পদ বছরের পর বছর ধরে শূন্য রয়েছে।
হাসপাতাল পরিচালকের বক্তব্য: এত বড় প্রতিষ্ঠানে সব সমস্যা এক দিনে সমাধান করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন শের-ই বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের পরিচালক ডা. ফেরদাউস আলম শিবিব। তবে অচিরেই বড় সমস্যাগুলো সমাধান করা হবে বলে জানান তিনি।
তিনি জানান, ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো চিহিৃত করে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে হাসপাতালের সব সমস্যা সমাধান করা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন পরিচালক ডা. ফেরদাউস আলম শিবিব।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১২
সম্পাদনা: মাহাবুর আলম সোহাগ, নিউজরুম এডিটর