ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

পরিবার পরিকল্পনায় অনীহায় জনসংখ্যা বাড়ছেই

মাজেদুল নয়ন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫২ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৩
পরিবার পরিকল্পনায় অনীহায় জনসংখ্যা বাড়ছেই

ঢাকা: পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার গত ৩৭ বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র আট গুণ। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ব্যয়ের তুলনায় পদ্ধতি ব্যবহারকারীর এ বৃদ্ধির হার মোটেও সন্তোষজনক নয় বলে মনে করছেন জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা।



পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের হিসেব মতে, ১৭৭৫ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর পদ্ধতি ব্যবহারকারী গড়ে মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ড্রপআউটের হার এখনো ৪২ দশমিক ২ শতাংশ। ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ দম্পতির মধ্যে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

কাগজে-কলমে পরিবার পরিকল্পনায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প ও কার্যক্রম চালু থাকলেও বাস্তবে চিত্র ভিন্ন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের অন্যতম পদ্ধতি জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারে এখনো অজ্ঞতা আর অনীহা রয়েছে নারী ও পুরুষের মধ্যে।

এদিকে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে, বিনামূল্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী বিতরণের জন্য বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রকল্প থাকলেও, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার দরিদ্র মানুষগুলোর কাছে এসব সামগ্রী পৌঁছায় না বলে জানা গেছে।

আবার দেখা গেছে, অনেকেই জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের কৌশল সর্ম্পকে এখনো অজ্ঞ। লজ্জার কারণে এসব নিয়ে জানতেও চান না তারা। আর এসবের সামগ্রিক ফল হিসেবেই জন্মনিয়ন্ত্রণে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

অসচেতনতা ও পদ্ধতি উপকরণের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে অনেক দম্পতির বেশি সংখ্যক সন্তান নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। কিশোরী অবস্থায় সন্তান ধারণের জন্য দারিদ্র ও অশিক্ষাকে দায়ী করেছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার প্রত্যাশিত নয়।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর জানায়, পদ্ধতি গ্রহণকারীর হার ১৯৭৫ সালের ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ২০১০ সালে ৬১ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার সন্তোষজনক হারে বাড়েনি। ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ দম্পতির মধ্যে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

অপূর্ণ চাহিদার ক্ষেত্রে একটি উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের মধ্যেই চাহিদার হার সবচেয়ে বেশি। এ হার ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ। এই বয়সীদের মধ্যে মাত্র ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার করছেন।

১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশের ৬৬ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়। আর বিবাহিতদের মধ্যে কিশোরী অবস্থাতেই গর্ভধারণ করেন শতকরা ৬৪ দশমিক ৩ ভাগ। এই হিসেবে দেশের ১ কোটি ৬০ লক্ষ কিশোরী প্রতি বছর সন্তান জন্ম দেন।

শহরের তুলনায় গ্রামে কিশোরী অবস্থায় মা হওয়ার প্রবণতা বেশি। রাজশাহী বিভাগে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি, শতকরা ৩২ দশমিক ৮ ভাগ। সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে, ১৯ দশমিক ৭ ভাগ। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ১ কোটি ৬০ লক্ষ কিশোরী প্রতিবছর সন্তান জন্ম দেন, যাদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনেরই ইতোমধ্যে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। দেশের জনসংখ্যার শতকরা ২৩ ভাগই ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরী।

এদের মধ্যে আবার ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ে হয় ৬৬ শতাংশের। এসব কিশোরীর আবার এক-তৃতীয়াংশ এবং ১৮ থেকে ১৯ বছর বয়সে তিন-চতুর্থাংশ কিশোরী সন্তান ধারণ করেন। স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি গ্রহণের হারও তুলনামুলকভাবে অনেক কম। শতকরা ৫ দশমিক ৭ ভাগ স্থায়ী এবং ৮ দশমিক ৬ ভাগ দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি গ্রহণ করছেন।

তবে নারীদের তুলনায় পুরুষদের পদ্ধতি গ্রহণের হার এখনও অনেক কম। শতকরা ৫ দশমিক ২ ভাগ পুরুষ স্থায়ী এবং অস্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করছেন।

অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হার ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করে ৯৭৯ জন মানুষ। বর্তমান হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে।

১৯৭৫ সাল থকে প্রতি বছর পরিবার পরিকল্পনা ব্যবহারকারীর হার গড়ে ১ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬৫০ সালে ১ কোটি ছিল। দু’শ বছর পর ১৯৫১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ অর্থাৎ ২ কোটি ৩ লাখ হয়। এই জনসংখ্যা ৪ কোটি ২০ লাখ হয় ৯০ বছরে (১৯৪১ সালে )।

পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির ব্যবহারে এই অনীহার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর-উন-নবী বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের দেশে যৌন সর্ম্পক নিয়ে মুক্ত কোনো শিক্ষা দেওয়া হয় না। এ কারণে কিশোর-কিশোরীরা তাদের বন্ধুদের আড্ডা থেকে এ সর্ম্পকে যা তথ্য পায়, তাই তাদের অবলম্বন। এটা নারী-পুরুষ উভয় ক্ষেত্রেই সমান।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ঊর্ধ্বগামী। ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমতে শুরু করলেও তা ছিল পূর্বের বৃদ্ধির তুলনায় একেবারেই নগণ্য।

এদিকে, প্রতি বছর পরিবার পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের পেছনে সরকার ও বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছেন। কিন্তু ব্যয়ের তুলনায় পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম কাজ দেখাতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সফলতার মুখ দেখছে না পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। মাঠ পর্যায়ে পর্যাপ্ত জনবলের অভাব রয়ে গেছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে আগের মতো সেবা দিচ্ছেন না মাঠকর্মীরা। দুর্বল হয়ে পড়েছে প্রচারণাও।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে খুব শীঘ্রই দেশে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটবে এবং জাতীয় জীবনে মহাবিপর্যয় নেমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ সময়: ১০২৩ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৩
এমএন/ সম্পাদনা: জনি সাহা, নিউজরুম এডিটর/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।