ঢাকা: মধ্যবয়সী পিতাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এসেছেন বগুড়ার রানা। দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে তিনি।
ডাক্তার দেখা শেষ করলেও, শেষ হলো না রানার ভোগান্তি। চেম্বার থেকে বের হতেই তাদের ঘিরে ধরলেন কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ। প্রেসক্রিপশন নিয়ে রিপ্রেজেন্টেটিভদের টানাটানিতে বিরক্ত হয়ে অভিযোগ করতে গেলেন বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টারের পাশেই সাইন বোর্ড লাগানো ‘অভিযোগ কেন্দ্রে’। সেখানেও আধাঘণ্টার উপরে দাঁড়িয়ে থেকেও পেলেন না কাউকে।
হতাশা নিয়ে গেলেন হাসপাতাল প্রাঙ্গণের ফার্মেসিতে। এখানে এসে তার হতাশা আরও বেড়ে গেল। ওষুধের দাম দিতে পকেটে হাত দিয়ে দেখেন মানিব্যাগ উধাও। নেই মোবাইল ফোনও।
কোনো নাটক বা সিনেমার কাহিনী নয়, দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)’র এটি একটি বাস্তব ঘটনা।
শুধু রানা নয়, প্রতিনিয়তই এ ধরনের অসংখ্য হয়রানির শিকার হচ্ছেন বিএসএমএমইউতে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীরা।
কর্তৃপক্ষের সবকিছু জানা থাকলেও প্রতিকারে কেউ নেই। বিএসএমইউ কর্তৃপক্ষের সহজ স্বীকারোক্তি চুরি-অনিয়ম থাকবেই। এটি কখনও বন্ধ করা যাবে না।
বিরামহীনভাবে রোগীদের প্রেসক্রিপশন দেখে যাওয়া প্যাসিফিকের সার্ভেয়ার রনি বলেন, কোম্পানি থেকে আমাদের পাঠানো হয়। ডাক্তার ওষুধ লিখছে কী-তা পরীক্ষা করার জন্য। কারণ প্রেসক্রিপশনে কোম্পানির ওষুধ লেখার জন্য রিপ্রেজেন্টেটিভের মাধ্যমে ডাক্তারদের বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয়।
কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রতিদিন সকাল থেকে কেউ না কেউ এখানে দায়িত্বে থাকে বলে জানান রনি। বললেন, শুধু আমাদের কোম্পানি না, সব কোম্পানির প্রতিনিধি এসে প্রেসক্রিপশন পরীক্ষা করে।
যোগাযোগ করা হলে বিএসএমএমইউ’র পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া (অব.) বাংলানিউজকে বলেন, ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভদের উপর চাপ থাকে তাদের ওষুধ ডাক্তার লিখছে কী? তাই তারা রোগীদের প্রেসক্রিশন দেখে। তবে তাদের শুধু শনিবার ও মঙ্গলবার দুপুর একটার পরে আসার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিন বা সময় তারা আসতে পারবে না।
অথচ বাংলানিউজের পক্ষ থেকে সকাল সাড়ে ১০টা থেকেই অসংখ্য রিপ্রেজেন্টেটিভকে দেখা গেছে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সৌদিতে চোরদের হাত কেটে দিয়েও চুরি বন্ধ করা যায়নি। চুরি কখনো বন্ধ হয় না। তারপরও তারা চুরি অনিয়মের
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, রিপ্রেজেন্টেটিভদের আনসার দিয়ে ধরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আটকে রাখা হয়েছে। থানায় দেওয়া হয়েছে।
তারপরও তারা চুরি করে আসে। যারা চোরাই পথে ওষুধ আনে তারই মূলত এসব করছে।
‘দুর্নীতি আর অনিয়ম বন্ধে আমি যেভাবে শাসন করেছি তা আর কেউ করতে পারবে না’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিএসএমএমইউ প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেছে, বহির্বিভাগের পাশাপাশি রিপ্রেজেন্টেটিভদের প্রেসক্রিপশন দেখার অভিযান চলছে ওয়ার্ডের রোগীদের ক্ষেত্রেও। আর বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে ডাক্তারদের সহযোগীদের হাতে। টাকার বিনিময়ে চেম্বারে ঢোকানো হচ্ছে রোগী। কেউ তার প্রতিবাদ করলে জুটছে চরম দুর্ব্যবহার।
স্ত্রীকে নিয়ে আসা আমিনুল বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। অথচ আমার পরে এসে অনেকেই ডাক্তার দেখিয়ে চলে গেছে। আমি তাদেরকে গেটে যে আছে তাকে টাকা দিতে দেখেছি। গেটে থাকা ব্যক্তিকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ওরা স্যারের(ডাক্তারের)আত্মীয়।
রোগীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে বিএসএমএমইউ’র পরিচালক বলেন, রোগীদের সব অভিযোগ সত্য নয়। ডাক্তারের চেম্বারে স্টাফ ঢুকলে তারা মনে করে রোগী ঢুকেছে। নিয়ম অনুযায়ী তিনজন রোগীর পর একজন স্টাফ ঢুকবে। এখানে ৮০০-৯০০ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী রয়েছে। তাদের ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা, আত্মীয় স্বজন রয়েছে। তাই সব সময় সিরিয়াল অনুযায়ী রোগীরা ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করতে পারেন না।
এদিকে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টারের পাশে স্থাপন করা অভিযোগ কেন্দ্রের চেয়ার-টেবিল খালি পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএসএমএমইউতে দায়িত্বরত আনসারের এক সদস্য বলেন, এমন কোনো অনিয়ম নেই যা এখানে হয় না। তবে এসব অভিযোগ নিয়ে লিখে কোনো লাভ হবে না। কারণ সব অনিয়মের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ জানে।
তিনি বলেন, অনিয়ম রুখতে কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই অভিযোগ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তবে এখানে খুব একটা কাউকে বসতে দেখা যায় না। আবার কেউ বসলে তার কাছে অভিযোগ করে ফলে পাওয়া গেছে- এমন উদাহরণ আমার জানা নেই।
অভিযোগ কেন্দ্রের বিষয়ে বাংলানিউজের কাছে কোনো মন্তব্য করেননি বিএসএমএমইউ’র পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া (অব.)।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৯ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০১৪