ঢাকা: আপনার নিত্য দিনের খাদ্য তালিকায় আপনি কোন জিনিসগুলোকে প্রাধান্য দেন?
খাদ্যের পুষ্টিমানের কথা মাথায় রেখে আপনি প্রতিদিন সকালে বাজারে গিয়ে কিনে আনছেন টাটকা শাক-সবজি, মাছ, দুধ এবং ফলমূলসহ আরো বিভিন্ন রকমের জিনিস। সেগুলো রান্নার পর মজা করে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর গিলছেন।
কিন্তু আপনি কি জানেন, যে মজাদার খাবার খেলেন এর সাথে আরো একটি জিনিস আপনার গলা বেয়ে পাকস্থলিতে গিয়ে পড়ল? আপনি হয়তো কল্পনাই করতে পারছেন না এর সাথে আপনি প্রতিদিন গ্রহণ করছেন ফরমালিন নামের এক মারাত্মক বিষ। জানলেও হয়তো তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ভাবছেন এগুলো হয়তো খুব বেশি ক্ষতিকর নয়।
কিন্তু বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, ফরমালিন আপনার শরীরে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে আপনার শরীরে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন মরণব্যাধি সৃষ্টি করে আপনাকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর পথে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ ও বাংলাদেশ ভোক্তা সমিতির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪০০ টন ফরমালিন মেশানো হচ্ছে মাছ, দুধ, শাকসবজি, ফলমূলসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে। যার পুরোটাই বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করছে আপনার শরীরেই।
ক্যান্সার মানুষের অন্যতম প্রধান মরণব্যাধি। যা কখনোই পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য নয়। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে যে মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টিতে ফরমালিন দায়ী।
১৯৮৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীন ‘ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার’ গবেষণা করে দেখিয়েছে যে ফরমালিন অত্যন্ত বিষাক্ত পদার্থ যা মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সি’ ১৯৯৪ সালে এক গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে ফরমালিন ফুসফুস ও গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টি করে। একই তথ্য জানা যায় বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। যেটি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালের ১ অক্টোবর। যুক্তরাষ্ট্রেরই স্টেট অব ক্যালিফোর্নিয়া ১৯৯২ ও ১৯৯৪ সালে দুটি আলাদা গবেষণায় প্রমাণ করে যে ফরমালিন ক্যার্সিনোজেন বা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী।
মানবদেহের বিভিন্ন অংশে ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য যে ফরমালিন দায়ী তা আরো জানা জানা যায় ‘ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ এন্ড হিউম্যান সার্ভিস’র ন্যাশনাল টক্সিকোলজি প্রোগ্রামের ১২ তম রিপোর্টে। যেটি কার্সিনোজেন এর ওপর করা হয় ২০১১ সালে।
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আরো প্রমাণিত হয় যে ফরমালিন খাদ্য পরিপাকে বাধা দেয়, পাকস্থলির ক্ষতি করে, লিভারের এনজাইমগুলো নষ্ট করে এবং কিডনির কোষ নেফ্রনগুলোকে ধ্বংস করে । ফলে গ্যাস্ট্রিক ও আলসার বাড়ে এবং কিডনি ও লিভারে বিভিন্ন জটিল ও দুরারোগ্য রোগ সৃষ্টি হয়।
মহিলাদের শরীরে ফরমালিনের ক্ষতিকর প্রভাবও মারাত্মক। তাদের শরীরে ফরমালিন প্রবেশ করলে মাসিক ঋতুস্রাবে সমস্যা হয়।
গর্ববতী মহিলাদের জন্য ফরমালিনের ক্ষতির প্রভাব আরও ভয়াবহ। অন্যান্য সমস্যা ছাড়াও ফরমালিনের কারণে গর্ভস্থ শিশু বিকলাঙ্গ হয় বলে গবেষকরা প্রমাণ করেছেন।
আইওয়াইএম হেলথ ২০১২ সালে ‘ফরমাল্ডিহাইড হ্যাজার্ড ইন ফুড’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখিয়েছে, ফরমালিন খাওয়ার পর গলা ও পাকস্থলি জ্বালাপোড়া করা, পেট ব্যথা, মাথাব্যথা, বমিভাব, বমি, ডায়রিয়া, রক্তক্ষরণ, পেটে তীব্র ব্যথা, রক্তচাপ কমে যাওয়া, খিঁচুনি ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটতে পারে।
এ গবেষণার ফলাফলে আরো বলা হয়, দীর্ঘদিন খাদ্যের সাথে ফরমালিন খেলে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, কাশি, ঝিমুনি, কিডনির ক্ষতি, ঘুমের অসুবিধা, খিটখিটে মেজাজ, মনোযোগে অনীহা সহ মনে রাখার ক্ষমতা কমে যাওয়ার ঘটনাও ঘটতে পারে।
ফরমালিনের বিষ থেকে নিজেদের রক্ষা করার উপায় কি? আসলেই কি কোন উপায় আছে?
গবেষকরা বলছেন, একবার খাদ্য দ্রব্যে ফরমালিন মিশ্রিত হলে তাকে আর কোনভাবেই নির্মূল করা যায়না, এমনকি রান্না করলেও ফরমাল্ডিহাইডের অনুগুলো থেকে যায়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন এবং বাংলাদেশ ফার্মাসিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক বাংলানিউজকে বলেন, ‘ফলমুলসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যে একবার ফরমালিন মিশ্রিত হলে তাকে কোনভাবেই আর ফরমালিন মুক্ত করা সম্ভব নয়। রান্না করলেও ফরমাল্ডিহাইডের অনুগুলো থেকে যায়। ’
তবে খাদ্যদ্রব্য থেকে ফরমালিনের পরিমাণ কিছুটা কমানো যায় বলে জানান তিনি।
অধ্যাপক ফারুক বলেন, ‘ফরমালিনযুক্ত খাদ্যদ্রব্য দীর্ঘক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রাখলে ফরমালিনের প্রভাব কিছুটা কমানো যায়। ’
তাই নিজেকে সুস্থ্য রেখে স্বাভাবিক জীবন যাপণ করতে চাইলে ভুলেও ফরমালিন নয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১১ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৪