পার্বতীপুর(দিনাজপুর): জরুরি বিভাগ। মারামারিতে মাথা ফেটে ও হাত কেটে যাওয়ায় শহরের গুলপাড়ার আকবর আলী(৫৫) ও রহমান(৩০)চিকিৎসা নিতে এসেছেন।
মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্টের বদলে ওয়ার্ড বয়ের এই সেলাইয়ের ঘটনা দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্ট শফিউর রহমান বাংলানিউজকে জানান, কাটা-ফাটা সেলাইয়ের কাজটি ওয়ার্ড বয়ের নয় তারই। কিন্তু ওয়ার্ড বয় আব্দুস সালাম দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে থেকে কাটা-ফাটা সেলাই কাজে অভিজ্ঞতা অর্জন করায় রোগীর চাপ বেড়ে গেলে কখনও কখনও তাকে দিয়ে এসব কাজ করানো হয়।
ওয়ার্ড বয় আব্দুস সালাম জানান, জরুরি বিভাগে সব সময় তিনি কাটা-ফাটা সেলাই কাজ করে থাকেন। এতে রোগীর কোন সমস্যা হবে না বা হয় না।
হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডাক্তার মাকসুদা আফরিন বাংলানিউজকে জানান, প্রতিদিন আউডডোরে প্রায় তিনশত এবং ইনডোরে ৬০/৭০ জন রোগীকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে তারা হাঁপিয়ে উঠেন। তাছাড়া রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি না থাকায় গ্রামগঞ্জের অনেক গরীব-অসহায় রোগীকে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে না পারায় নিজের খারাপও লাগে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পার্বতীপুরের হলদীবাড়ীতে ১৯৬১ সালে ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটি স্থাপিত হয়। ১৯৮২ সালে তা ৩১ শয্যায় উন্নীত করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হিসেবে আপগ্রেড করা হয়। সর্বশেষ ২০০৮ সালের জুলাইয়ে তা ৫০ শয্যায় উন্নিত করা হয়। ৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার ও রোগ নির্ণয় যন্ত্রপাতি না থাকায় জনসাধারণ এর সুফল পাচ্ছেনা।
এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৯ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ ২১ জন চিকিৎসকের স্থলে রয়েছে মাত্র ৮ জন। এরমধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা একজন, কনসালট্যান্ট দুইজন, আরএমও একজন, ডেন্টিস্ট একজন ও মেডিকেল অফিসার তিনজন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে প্রশাসনিক কাজসহ বিভিন্ন ধরনের কাজে সব সময় ব্যস্ত থাকতে হয়। বাকি সাত চিকিৎসক দিয়ে ইনডোর ছাড়াও প্রতিদিন আউটডোরে প্রায় তিনশত রোগীকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়।
হাসপাতালে তিনটি অপারেশন থিয়েটার থাকলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সার্জন না থাকায় রোগীদের দিনাজপুর বা রংপুর যেতে হয়। দু’টি অ্যাম্বুলেন্স বরাদ্দ থাকলেও রয়েছে একটি। সেটিও ছয় মাস ধরে অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে হাসপাতালটিতে ৩শ’ এমএল ক্ষমতা সম্পন্ন একটি এক্সরে মেশিন বসানো হলেও সেটি প্রায় ৮ বছর ধরে অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। এক্সরে সুবিধা না পেয়ে রোগীদের বাহির থেকে এক্সরে করে নিয়ে আসতে হয়। ইসিজি মেশিনটিও দীর্ঘদিন থেকে অকেজো। দন্ত চিকিৎসক থাকলেও ডেন্টাল চেয়ার অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকায় দাঁতের রোগীরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছে না।
তাছাড়া, পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধা থাকার পরও আট জন ডাক্তারের মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার আতিয়ার রহমান, কনসালট্যান্ট (নাক, কান ও গলা) ডাক্তার রাজু আহমেদ, কনসালট্যান্ট (চর্ম ও যৌন) ডাক্তার মাহবুবুল আলম চৌধুরীসহ চার চিকিৎসক হাসপাতাল ক্যাম্পাসে থাকেন না। ফলে অনেক সময় প্রয়োজনের মুহূর্তে রোগীরা চিকিৎসককে খুঁজে পান না। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার আতিয়ার রহমান তা মানতে নারাজ।
গত সোমবার (১৮ আগস্ট) সরজমিন হাসপাতালে গেলে দাঁতের চিকিৎসা নিতে আসা রোগী আঞ্জুমান বানু বলেন, দাঁতের ব্যথায় তিনি অস্থির। কিন্তু ডাক্তার তাকে শুধু ব্যথার ওষুধ দিয়ে বললো দিনাজপুর-রংপুর গিয়ে চিকিৎসা নিতে।
ইনডোরে ৩ দিন ধরে চিকিৎসাধীন মহিলা ওয়ার্ডের ১৬ নম্বর বেডের রোগী তহমিনা খাতুন (২৬) বলেন, পড়ে গিয়ে তার পিঠে আঘাত লাগে। এখানে ভর্তি হওয়ার পর ডাক্তার তাকে বলেন এক্সরে করতে। কিন্তু টাকা জোগাড় না হওয়ায় এখন পর্যন্ত বাহির থেকে এক্সরে করে আনতে পারেননি।
পার্বতীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার আতিয়ার রহমান বাংলানিউজকে জানান- হাসপাতালের একমাত্র এক্সরে মেশিনটি ২০০৭ সাল থেকে অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। অনেক পত্র চালাচালির পর এক্সরে মেশিনটি মেরামতের জন্য কেন্দ্রীয় ঔষধাগার তেজগাঁও ঢাকা থেকে ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ করে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত ঠিকাদার আসেনি।
তিনি বলেন, তিন লাখ টাকায় নতুন এক্সরে মেশিন কেনা যায়। কিন্তু চেয়েও এ মেশিন কেনার টাকা মেলেনি। অথচ অকেজো এক্সরে মেশিনটি মেরামতের জন্য ৮ লাখ টাকা কেন বরাদ্দ করা হলো তা তার বোধগম্য নয়।
এছাড়া সার্জারি ও গাইনি এবং এনেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (কনসালটেন্ট) না থাকায় হাসপাতালের তিনটি অপারেশন থিয়েটার দীর্ঘ ছয় বছরেও সচল করা যায়নি। ইসিজি মেশিন ও ডেন্টাল চেয়ার অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। ফলে ইচ্ছা থাকলেও চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের কাঙ্খিত সেবা দেওয়া সম্ভব হয়না বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক এবং এক্সরে, ইসিজি মেশিন ও ডেন্টাল চেয়ার মেরামত করে দু’জন টেকনিশিয়ার দেওয়া হলে এখানে অল্প খরচে গরীব রোগীরা চিকিৎসাসেবা নিতে পারত।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রয়োজনের মুহূর্তে তিনি হাসপাতাল ক্যাম্পাসেই থাকেন। তবে কনসালট্যান্ট ডাক্তার রাজু আহমেদ ও কনসালট্যান্ট ডাক্তার মাহবুবুল আলম চৌধুরীর কথা ভিন্ন। তারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। গ্রামগঞ্জে এসে চিকিৎসা দিচ্ছেন তাইবা কম কিসে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৪