ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

বেহাল দশায় স্বাস্থ্যসেবা

ফুলবাড়িয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স: চিকিৎসক আসেন ফোন পেলে!

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৪
ফুলবাড়িয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স: চিকিৎসক আসেন ফোন পেলে! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ময়মনসিংহ: রাত ৮টা। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগ।

রোগীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন কক্ষের ভেতরে-সামনে। চিকিৎসক নেই। পাশাপাশি দু’টি চেয়ারে বসে আছেন একজন ব্রাদার ও এমএলএসএস। ভিড় সামাল দিতে না পেরে তারা ফোন দিলেন দায়িত্বরত (অনুপস্থিত) চিকিৎসককে।

ফোন পেয়ে মিনিট বিশেক পর মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে ছুটে এলেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) আশরাফুল কবির।

নিজের কক্ষে প্রবেশ করতেই রোগীর স্বজনরা তেঁতিয়ে উঠলেন। ক্ষুব্ধ হয়ে এদেরই একজন চিকিৎসককে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, কোনো সময়ই জরুরি বিভাগে চিকিৎসক পাওয়া যায় না। আপনারা হাসপাতাল ফেলে ক্লিনিকে রোগী দেখেন।

স্বাস্থ্য সবল এ চিকিৎসক ভ্রু-কুচকে পাল্টা জবাব দিলেন, বাইরে কাজে ছিলাম। ক্লিনিকে নয়।

এরপর আধা ঘণ্টা জরুরি বিভাগের রোগীদের দেখভাল করে তিনি আবার ছুটলেন ফুলবাড়িয়া উপজেলা সদরের লাইফ লাইন মেডিকেল কমপ্লেক্স ক্লিনিকের উদ্দেশে।

সম্প্রতি এমনই চিত্র দেখা গেল ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে। অথচ সরকারি চিকিৎসা সেবার এ প্রতিষ্ঠান উপজেলার প্রায় পাঁচ লাখ বাসিন্দার একমাত্র ভরসাস্থল।

৫০ শয্যার এ হাসপাতালে দিনে চিকিৎসক-নার্সদের মোটামুটি দেখা মিললেও রাতের বেলায় এখানে থাকেন না তারা। ওই সময়টাতে ব্রাদার-এমএলএসএসরাই চালিয়ে নেন গোটা হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম। শুধু তাই নয়, এখানে চিকিৎসাধীন রোগীরা পান নামমাত্র ওষুধ। তিন বেলা তাদের ভাগ্যে জোটে নিম্নমানের খাবার!

সরেজমিন দেখা গেল, উপজেলার আন্ধারীয়াপাড়ার এক যুবক এসেছেন জরুরি বিভাগে। চিকিৎসক কিছুক্ষণ আগে চলে যাওয়ায় তাকে ইনজেকশন দিচ্ছেন হাসপাতালের এমএলএসএস রুহুল আমিন। পাশ থেকে তাকে সহযোগিতা করছেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ব্রাদার কামরুজ্জামান।

এগিয়ে গিয়ে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই কামরুজ্জামানের সোজাসাপ্টা উত্তর, আস্তে আস্তে ও কাজ শিখছে। আর আমি তো পাশেই আছি। কোনো সমস্যা হবে না।

‘হঠাৎ চিকিৎসক’ রুহুল আমিন এ বিষয়ে বলেন, চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতে আমরাই কাজ চালিয়ে নিচ্ছি।

জানা গেছে, ফুলবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে সম্প্রতি ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। তবে লোকবলের অভাবে এখনো নতুন ভবনের ১৯ শয্যার কার্যক্রম শুরু হয়নি। ৩১ শয্যাতেই প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৭০ জন রোগী ভর্তি থাকেন। পর্যাপ্ত শয্যা না থাকায় তাদের ঠাঁই হয় হাসপাতালের মেঝেতে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ মোট নয়জন চিকিৎসক রয়েছেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে। এর মধ্যে একজন ডেপুটেশনে আছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আর নয়জন নার্স থাকলেও একজন রয়েছেন শহরের এসকে হাসপাতালের কালাজ্বর রিসার্চ সেন্টারে।

সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও নার্সদের দায়িত্বহীনতা, অবহেলা ও ফাঁকিবাজির কারণে ভেঙে পড়েছে এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবা। নারী ও পুরুষ ওয়ার্ডে রোগীরা যন্ত্রণায় কাতরালেও বেশিরভাগ সময়েই এখানে মেলে না চিকিৎসক। রাতের বেলার পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ।

সম্প্রতি পুরুষ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন উপজেলার পুঁটিজানা ইউনিয়নের দাউসা গ্রামের ওসমান গণি বলেন, সকালে একবার চিকিৎসক এসে খোঁজ নিলেও রাত অবধি আর কেউ আসেননি। তার কথায় সায় দেন এ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অন্যান্য রোগীরাও।

শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার জোরবাড়িয়া খামারবাড়ি গ্রামের রেজিয়া খাতুন (৫৫)। শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় ২০ সেপ্টেম্বর রাত সোয়া ১১টার দিকে তাকে এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসেন তার স্বজনরা। কিন্তু কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক এম জি মোস্তফা হাসপাতাল ফেলে বাসায় ঘুমাচ্ছিলেন।

জরুরি বিভাগের স্টাফ ও রোগীর স্বজনরা তাকে দফায় দফায় ফোন দিলেও তিনি সাড়া দেননি।   প্রায় আধা ঘণ্টা পর মারা যান রেজিয়া খাতুন। রোগীর মৃত্যুর খবরে ছুটে এসে সংক্ষুব্ধ স্বজনদের তোপের মুখে পড়েন চিকিৎসক এম জি মোস্তফা।  

মৃত নারীর ছেলে মুজিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, সময়মতো চিকিৎসক পেলে আমার মা হয়তো বেঁচে যেতেন। আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য চিকিৎসক দায়ী। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এলে কোনো সময়ই ঠিকমতো চিকিৎসক পাওয়া যায় না।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আব্দুল কদ্দুস জানান, নিয়ম অনুযায়ী নাইট ডিউটিরত চিকিৎসক সকালে একবার রাউন্ড (রোগীদের দেখবেন) দেবেন। বিকেলে রাউন্ড দেবেন আবাসিক মেডিকেল অফিসার। রাতে যদি নার্স কোনো রোগীর অবস্থা খারাপ দেখে চিকিৎসককে কল দেন তবে চিকিৎসক ওই রোগীকে দেখবেন।

আরো জানা যায়, এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য সরকারি কোয়ার্টার থাকলেও সেখানে থাকেন না তারা। কেউ থাকেন ময়মনসিংহ শহরে, কেউ কেউ আবার উপজেলা সদরে বাসা ভাড়া করে থাকেন। আবার কোনো কোনো চিকিৎসক নিয়ম রক্ষার জন্য হাসপাতালে আসা-যাওয়া করেন।

এ বিষয়টি স্বীকার করেন দায়িত্বরত নার্স মমতাজ বেগম (৩৫)। তিনি জানান, চিকিৎসকদের বেশিরভাগই ময়মনসিংহ কিংবা ফুলবাড়িয়া উপজেলা সদরে থাকেন। তিনিসহ তিনজন নার্স কোয়ার্টারে থাকেন। বাকিরা থাকেন ময়মনসিংহে।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীরা মাত্র কয়েক ধরনের ওষুধ পান। বেশিরভাগ ওষুধ তাদের বাইরে থেকে কিনতে হয়।

হাবিবুর রহমান (৪০) নামে এক রোগী জানান, সব ওষুধই বাইরে থেকে কিনে খেতে হচ্ছে। ডাক্তার শুধু ইনজেকশন পুশ করে দেন। এছাড়া হাসপাতাল থেকে আর কিছুই পাই না।

আরেকটু পরিষ্কার করে আবু বক্কর সিদ্দিক নামে এক রোগীর বাবা জানান, তার ছেলে শিপন পায়ে ফোঁড়া নিয়ে নয়দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। এ সময়ে মাত্র দুই ধরনের ওষুধ তিনি ফ্রি পেয়েছেন। বাকি চার/পাঁচ ধরনের ওষুধ ও ইনজেকশন বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়েছে।

হাসপাতাল থেকে তিন বেলা খাবার দেওয়া হয় রোগীদের। কিন্তু সেই খাবার খাওয়ার উপযোগী নয়। অথচ প্রতি রোগীর জন্য সরকার থেকে প্রতিদিন তিন বেলার খাবারের জন্য বরাদ্দ ১২৫ টাকা। সকালে সাগর কলা-রুটি, দুপুর ও রাতে রুই-কাতলের বদলে সস্তার সিলভার কার্প মাছ, আর ভাত দেওয়া হয়। এছাড়া দুপুরের রান্না করা খাবার গরম করে রাতে সরবরাহ করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান অফিস সহকারী মোফাজ্জল হোসেন ও আবাসিক মেডিকেল অফিসারের সঙ্গে যোগসাজশ করে সংশ্লিষ্ট খাবার সরবরাহকারী ঠিকাদার রোগীদের নিম্নমানের খাবার দিয়ে নিজেদের পকেট ভারি করছেন।

খাবারে নয়-ছয়ের অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আব্দুল কদ্দুস জানান, খাবারের মান খারাপ দেখে কয়েকদিন আগে আমি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। ভবিষ্যতে আর এরকম হবে না বলে তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন।

এদিকে, এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যে নয়জন চিকিৎসক রয়েছেন, তারা দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করেন। বেশিরভাগ সময় উপজেলার ১২টি ক্লিনিকে রোগী দেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তারা।

এর মধ্যে আবাসিক মেডিকেল অফিসার আশরাফুল আলম কবির ও ইশরাত জাহান স্বর্ণা লাইফ লাইন মেডিকেল কমপ্লেক্স ক্লিনিকে, ডা. হারুন আল মাকসুদ ও মুশাহিদা আল নূর রেনু গ্রামীণ সাথী ক্লিনিকে, ডা. নজরুল ইসলাম বাবু মেডিকেল হাউজে, ডা. এম জি মোস্তফা পপুলার ডায়াগোনস্টিক সেন্টার এবং ডা. মাজাহারুল ইসলাম মেডিকেয়ারে রোগী দেখেন।

নয় চিকিৎসকের বেশিরভাগই যখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকেন, তখন তাদের কক্ষে দালালদের অবাধ বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। দালালদের মাধ্যমেই তারা হাসপাতালের রোগী ক্লিনিকে পাঠিয়ে দেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আব্দুল কদ্দুস বলেন, চিকিৎসকরা অফিস টাইম শেষে বিভিন্ন ক্লিনিকে রোগী দেখেন। এটা তো দোষের কিছু না। আমি নিজেও ক্লিনিকে প্র্যাকটিস করি। এটা এখন সবাই করে।

এসব ব্যাপারে ময়মনসিংহ জেলা সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সামাদ বলেন, আমার কাছে কেউ এ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ করেনি। টুকটাক যদি কোনো অনিয়ম থেকেই থাকে তবে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবো।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।